স্মৃতিকথা : অতল জলের জলাধার
লেখক : সুপ্তি জামান
সুপ্তি জামান : শৈশবের দূরন্তপনাকে ছুটি দিয়ে, কৌশরের বারান্দায় পা রাখবো রাখবো করছি, এমনি একটা সময় আমি দূরে এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাই। দূরত্বের জন্যই আগে কখনো সে বাড়িতে যাওয়া হয়নি। আঁকা বাঁকা গ্রামের পথ, কখনো নদীর পাড়, কখনো জঙ্গলের ধার, কখনো সুপ্রস্থ টানা দীঘল পথ পায়ে হেঁটে সে বাড়িতে পৌঁছাই।
আমরা তিন জন সমবয়সী শিশু কিশোর কথা বলতে বলতে, হৈ হুল্লোর করতে করতে পথ চলেছিলাম, এর মধ্যে একটি ছেলে, ওর পীড়াপিড়িতেই ওদের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছিলাম আমরা দু বোন। সে বাড়িতে আমরা আনন্দ ভেলায় ভেসে সপ্তাহখানেক থেকেছিলাম। প্রচন্ড গরমের সময়, আম কাঁঠাল খাওয়ার মৌসুম, সচ্ছল গৃহস্ত বাড়ি, কখনো যাইনি তাই খাতির যত্নের কমতি ছিল না।
সে বাড়ির সামনে পিছনে শান বাঁধানো পুকুরের সিঁড়িতে খড়খড়ে রোদ, পুকুরের তলানির পানি পঁচে ভুড়ভুড়ি ছড়াচ্ছে। বাড়ির সকলে সেই পানিতে ধোয়া মোছার কাজ সারলেও গোসল করতেন অন্য একটি পুকুরে। আমিও মেহমানের মর্যাদায় অন্যদের সাথে অন্য পুকুরটিতে গোসল করতে যাই। বাড়ি সংলগ্ন চারপাশের বেশিরভাগই নিবিড় জঙ্গলে আবৃত।
ঘনজঙ্গলের বুকের শীতলতায় চিকন একটা পায়ে চলা পথ প্রেয়সীর মতো গা এলিয়ে দিয়েছে, পথটি একটি পুকুরের ঘাটে এসে জলের সাথে মিশে গেছে। ঘাট বলতে বড় বড় গাছের দৃঢ় মূল আশ্রয় করে জলে ওঠা নামা করা। পুকুরটি দেখে মনের মধ্যে আপনাতেই সমীহভাব জাগে। তৃষিত গ্রীষ্মে জলে টইটুম্বর পুকুর!
কানায় কানায় ভরা! পুকুরটিতে কোন পাড় নেই, স্হল যেন নত হয়ে তাকে বুক পেতে ঠাঁই দিয়েছে, পুকুরের চারধারের মাটি ভেজা ভেজা সজীব। এই পুকুরে কেউ সাঁতার কাটে না, কিনার থেকে মাঝে যায় না, এমনকি কেউ সেখানে একলা যায় না। কোন রকম টুপ করে ডুব দিয়ে উঠে যায়।
গ্রীষ্মে বাড়ির পুকুরে জল থাকে না বলে এক রকম বাধ্য হয়ে মানুষ এই জঙ্গলের পুকুরে নাইতে আসে। সেই পুকুরটি সারাবছর একা থাকে। পুকুরের জল সারা বছর একই রকম থাকে বলে এর তল কেউ জানে না। সবাই অনুমান করে পুকুরের বড় বড় মাছরা বুড়ো হতে হতে এক সময় আঁচড়া হয়ে যায়।
তাই ভয়ে কেউ নামে না। পুকুরটির আয়তন কিন্তু সে রকম বড় নয়, কুয়ো বলা না, আবার পুকুর বলাটাও ঠিক যায় না। বলা যায় অতল জলভান্ডার! বন তলে কি গুরুগম্ভীর ভার বুকে নিয়ে সুস্থির তার পড়ে থাকা! সেই জলাধারটি বুকের গভীর অতল থেকে আমার শৈশবের সীমানা পেড়োনো কৌশর বেলায় এক মুঠো অসীম মোহময় উপলব্দী বা বোধের উন্মষ ঘটিয়েছিল।
দুপুর বেলায় গভীর বনের শান্ত জলাধারটি যেন নতুন আমার দিকে জলভরা চোখে চেয়েছিল, আমি কত দিন যে সেই জলাধারটিকে নিয়ে স্মৃতিকাতর হয়েছি। কি এক মায়াময় সৌম্য সুগভীর সমীহ জাগিয়েছিল আমার চেতনায়, যা ঠিক বলে বোঝানো যায় না।