নাটোর কন্ঠ : উত্তরাঞ্চলে ট্রেনের ডাবল লাইন না থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে এ পথে চলাচলকারী যাত্রীদের। নাটোরের আব্দুলপুর জংশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইনে প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত ট্রেন যাতায়াত করছে। এতে করে উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীসহ দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো যাত্রীদের সময়ের অপচয় হচ্ছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অতিরিক্ত জ্বালানি খরচও গুনতে হচ্ছে। ডাবল লাইন নির্মাণ হলে উত্তরাঞ্চলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পাশাপাশি যাত্রী ভোগান্তি অনেকাংশে কমে আসবে।
যদি প্রশ্ন করা হয়, সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ ও সুলভ বাহন কি? তাহলে এ উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষই একবাক্যে স্বীকার করবেন রেলই সবচেয়ে নিরাপদ সাশ্রয়ী ও পরিবেশ বান্ধব বাহন। আজ থেকে প্রায় শত বছর পূর্বে এ অঞ্চলে রেলপথের সূচনা করেন তৎকালীন বৃটিশ সরকার। ভারতীয় উপমহাদেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের বিশাল দূরত্বের কারণে সবচেয়ে সহজ বাহন হিসাবে রেলপথের মাধ্যমে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের লক্ষ্য নিয়ে বৃটিশ রেলওয়ের সূচনা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) বিভিন্ন অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণ করা হয়। সে সময়ে প্রধান প্রধান রেলপথ গুলি ডাবল লাইনে নির্মাণ করা হয় যাতে একটি ট্রেন যাওয়ার সময়ে বিপরীতমুখী ট্রেনের ক্রসিংয়ের জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় না হয়। সে সময় শিলিগুড়ি থেকে কোলকাতা যাওয়ার প্রধান রেলপথ ছিল পার্বতীপুর, সান্তাহার, নাটোর, ঈশ্বরদী, দর্শনা হয়ে কলকাতা।
উক্ত রেলপথটি ডাবল লাইনে নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার আব্দুলপুর থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ডাবল লাইনের, একটি লাইন রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশী হওয়ার অজুহাতে তুলে নেয়। যার কারণে বর্তমানে পার্বতীপুর হতে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতে অতিরিক্ত সময় লাগছে। বর্তমানে মানুষ অল্প সময়ে অধিক দূরত্বে যেতে চায়। কিন্তু সিঙ্গেল লাইনের কারণে একটি ট্রেনকে অন্য একটি ট্রেনের অতিক্রমের সময় ষ্টেশনে দাড় করিয়ে রাখতে হয়। এতে মানুষের চরম ভোগান্তি সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে পার্বতীপুর থেকে সান্তাহার, নাটোর, ঈশ্বরদী হয়ে ঢাকা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। সড়কপথের ঝুঁকি ও ভোগান্তির কারণে মানুষ ট্রেনের প্রতি দিন দিন আগ্রহী হচ্ছেন। কিন্তু সিঙ্গল লাইনের কারণে ট্রেনগুলি সময়মত গন্তব্যে পৌছতে না পারায় অনেকেই ট্রেনের প্রতি বিরূপ হচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন সরকার অনেক রাজস্ব হারাচ্ছে। অপরদিকে তেমনি সড়ক পরিবহন মালিকের কাছে সাধারণ যাত্রীগণ জিম্মি হয়ে পড়ছেন। এমতাবস্থায় পার্বতীপুর থেকে ঈশ্বরদী হয়ে ঢাকা পর্যন্ত এবং আব্দুলপুর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত লাইনসহ প্রধান প্রধান রেলপথগুলি ডাবল লাইনে রূপান্তরের জন্য যাত্রী সাধারণ দীর্ঘদিন থেকে দাবী করে আসছেন।
ভুক্তভোগি এক যাত্রী আকাশ চক্রবর্ত্তী জানান, ট্রেনের একক লাইনের কারণে ট্রেন আসতে দেরি হয়। অনেক সময় বসে থাকতে হয়। যদি ডাবল লাইন থাকত তাহলে ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ত। আমাদের হয়রানির শিকার হতে হত না। সরকারের রাজস্বও বৃদ্ধি পেত বলে মনে করেন তিনি।
নাটোর রেলওয়ের স্টেশন মাষ্টার অশোক কুমার চক্রবর্তী জানান, তৎকালিন ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৯ সাল পর্যন্ত পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রীজ থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার দুই লেনের রেললাইন স্থাপন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার নাটোরের আব্দুলপুর জংশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ডাবল লাইন উঠিয়ে সিঙ্গেল লাইন করে। বর্তমানে এই পথে সিঙ্গেল লাইনে ভর করেই যাত্রী সেবা দিয়ে যাচ্ছে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল।
তিনি আরো জানান, প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত ট্রেন উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানী এবং দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত করছে। কিন্তু ট্রেনের লাইন ডাবল না থাকায় প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। সিঙ্গেল লাইনের কারণে এক স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে অপর ট্রেনটি পাসিং করছে রেলওয়ে বিভাগ। এতে করে ট্রেন বিলম্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত জ্বালানি খরচও গুনতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। সময় অপচয়ের পাশাপাশি সময়মত গন্তব্যস্থানে যাত্রীদের পৌঁছাতে পারছেনা ট্রেনগুলো। সময় অপচয়, অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ কমানোসহ সকল সমস্যা সমাধানের জন্য ডাবল লাইনের বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
আব্দুলপুর জংশনের স্টেশন মাস্টার সাইফুল ইসলাম জানান, রেলের আধুনিকায়নের জন্য উত্তরাঞ্চলে ডাবল লাইনের বিকল্প নেই। যমুনা সেতু হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। রেলের ডাবল লাইন হলে এই অঞ্চলের অর্থনীতির আরো পরিবর্তন ঘটবে। রেলের ডাবল লাইন না হওয়ার কারণে ঠিকমত যাত্রী সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কোন স্থানে ট্রেন লাইনচ্যুত হলে পুরো রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ডাবল লাইন থাকলে বিকল্প হিসেবে অন্য আরেকটি লাইন ব্যবহার করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সেটা হয়ে উঠছে না।
এ বিষয়ে নাটোর-০১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল জানান, উত্তরাঞ্চলে রেলের যাত্রী ভোগান্তির কথা চিন্তা করে , আব্দুলপুর জংশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ট্রেনের ডাবল লাইন নির্মাণের বিষয়টি সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে। এবিষয়ে খুব দ্রুতই ইতিবাচক ফলাফল আসবে বলে তিনি জানালেন।
নাটোরের আব্দুলপুর জংশন থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ট্রেনের ডাবল লাইন নির্মাণ হলে, একদিকে যেমন যাত্রীদের হয়রানি দূর হবে, অন্যদিকে রেলের পিছনে সরকারের ব্যয়ও অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন সাধারণ যাত্রীরা।