[নোংরা মনে হলে পড়বেন না।]
আমার বন্ধু শবনম – জাকির তালুকদার
লোকটা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেয়ালে সাঁটা বিজ্ঞাপন পড়ছে। রাতের বেলা এইভাবে মনোযোগ দিয়ে পোস্টার পড়তে দেখলে কৌতূহল জাগে। কিসের বিজ্ঞাপন? তবে কাছে যাওয়ার আগেই মনে মনে একটা আন্দাজ করি। বোধহয় যৌনক্ষমতাবর্ধক ওষধের বিজ্ঞাপনই হবে। ঠিকই। লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে আমিও বিজ্ঞাপনটা পড়ি। মালিশ এবং ক্যাপসুল। মালিশ করলে পুরুষাঙ্গ লোহার মতো শক্ত হবে, আগামোটা গোড়া চিকন লিঙ্গ ঠিক হয়ে যাবে। সেইসাথে ক্যাপসুল খেলে যৌনসঙ্গমের সময় রয়েল বেঙ্গল টাইগার হয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা।
শবনম দূর থেকে খেয়াল করছিল। কাছে গিয়ে বিজ্ঞাপনের কথা বলতেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে– লাগবো নাকি আপনের?
আমি হাসি। বলি– নাহ! তেমন অবস্থায় পড়লে বরং একেবারে পারা খেয়ে নেব।
পারা?
শবনমের প্রশ্নের উত্তরে বলি– পারা মানে পারদ। এক ধরনের ধাতু। ঐ যে জ্বর দেখার থার্মোমিটারের মধ্যে থাকে।
ঐডা খাইলে কী হয়?
আমাদের স্কুলের ঠিক উল্টোদিকে, মানে নারদ নদের ঐ পাড়ে ছিল কোর্ট-কাচারি। উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় মাঝে মাঝে আমাকে আর বাপ্পীকে ক্লাস থেকে বের দিত আরবিশিক্ষক বশীরউল্লাহ স্যার। আমরা লিয়াকত ব্রিজ পেরিয়ে কোর্টের চত্বরে ক্যানভাসারদের মজমা শুনতে যেতাম। সেখানেও অনেককিছুর মতো যৌনতার ওষুধও বিক্রি হতো। ক্যানভাসারদের মুখ থেকে খুব মজার মজার গল্প শুনতে পাওয়া যেত। তখনই শুনেছিলাম যৌনতা বাড়ানোর জন্য পারা বা পারদ খাওয়ার কথা। পারদ পেটে হজম হয় না। কেউ খেলে ওটা শরীর থেকে বেরিয়ে আসবে। তো বের হওয়ার রাস্তা দুটো। এক মুত্রনালী বা লিঙ্গপথে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে পায়ুপথে। লিঙ্গ দিয়ে বের হলে সে হবে সঙ্গমের মহারাজা। বাকি জীবন এতই তীব্র থাকবে তার পাওয়ার যে বিছানায় সে ইচ্ছা করলে অবিরত সঙ্গমের মাধ্যমে মেরেও ফেলতে পারবে নারীকে। কিন্তু যদি পায়ুপথে বের হয় তাহলেই সেরেছে। তার তখন পায়ুতে অন্যের লিঙ্গ ছাড়া চলবেই না। শুনতাম আমাদের শহরের এক ধনী ব্যবসায়ীর কথা। তার নাকি পায়ুপথে বেরিয়েছিল পারদ। তাই সবসময় যে পয়সা দিয়ে পুষত তরুণ কোনো ছেলেকে। পারদ-বেরোনো পায়ু বলে কথা! তাকে শান্তি দেওয়া তো যার-তার পক্ষে সম্ভব না। বেশিদিন থাকত না কোনো ছেলে। তবে যতদিন থাকত, ততদিন অঢেল খরচ করত লোকটা সেই তরুণের পেছনে।
এইবার পুরো এলাকাকে শব্দে ভরিয়ে দিয়ে হেসে ওঠে শবনম। আমিও। হাসির শব্দে আশপাশের সব নারী-পুরুষই ঘুরে তাকায় আমাদের দিকে। তবু আমাদের হাসি থামতে চায় না। হাসতে হাসতে শবনমের চোখে পানি চলে আসে। দমক থামাতে পারার পরে বলে– ব্যাডা মানুষরা খালি ঐ এক চিন্তা নিয়া পইড়া থাকে। তয় খবদ্দার আপনে কিন্তু খাইবেন না পারা! খাইলে আপনেরে দেইখা বেবাক ব্যাডাবিডি পলাইবো। সামনে দিয়া বারাইলে মাইয়ারা পলাইবো, আর পিছন দিয়া বারাইলে ব্যাডারা পলাইবো।
একটু বিরতি নিয়ে বলে– মানুষ কী ভাবে? মাইয়া মানুষ কি খালি পোন্দানি চায়? মন বইলা কি কিছু নাই?
আছে তো বটেই। সেই জন্যই তো প্রেম-ভালোবাসার জন্ম।
প্রেমের কথা উঠতেই আলোচনা অন্য দিকে ঘুরে যায়। শবনম প্রশ্ন করে– আচ্ছা, আপনেরা ভদ্দরলোকেরা তো অনেকদিন প্রেম-পিরিতি কইরা বিয়া করেন। তা বিয়ার পরে সেই পিরিতি সব উধাও হয়া যায় ক্যান?
আমি একটু দ্বিমত করি– একেবারে উধাও হবে কেন? তবে কিছুটা কম-বেশি হতে পারে।
শবনম প্রশ্ন থেকে নড়ে না– ক্যান হয়? এতদিনের পিরিত, বিয়ার লগে লগে কমতে থাকে ক্যান?
উত্তর দেবার আগে ভাবতে হয় অনেকক্ষণ। আসলে পুরো উত্তর তো আমার জানাও নেই। কিছুটা ধারণা করতে পারি, কিছুটা নিজের এবং অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে সংশ্লেষণ করতে পারি। বলি– বিয়ের আগে, মানে প্রেম করার সময় প্রেমিক-প্রেমিকা তো চব্বিশ ঘণ্টা একসাথে থাকে না। তারা মিলিত হয় দিন-ক্ষণ ঠিক করে। সেই সময়টুকুতে তারা একজন আরেকজনের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করে সবচেয়ে সুন্দরভাবে। খেয়াল রাখে তাদের আচরণে বা কথায় অপরজন যেন কোনোভাবেই আহত না হয়। তারা অনেক মিথ্যা কথাও বলে। নিজের সম্পর্কে, পরিবার সম্পর্কে, নিজের অবস্থান সম্পর্কে। অপরজন যা পছন্দ করে, নিজে না করলেও সেটাকেও পছন্দ করার ভান করে। যেমন একজন কবিতা পছন্দ করে হয়তো। অপরজন পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্য কোনো কবিতা কোনোদিন উল্টেও দ্যাখেনি। সে মিথ্যামিথ্যি নিজেকে কবিতার অনুরাগী বলতে থাকে। এমনকী কবিতার বইও উপহার দেয় অপরজনকে। কিন্তু বিয়ের পরে সব ফাঁক এবং ফাঁকিগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একসঙ্গে থাকতে গিয়ে একজন আরেকজনের মুদ্রাদোষ এবং মানসিকতা খুব ভালো করে চিনে ফেলে। জানো তো, মানুষকে বড় কাজ দিয়ে চেনা যায় না। বড় কাজ করার সময় মানুষ খুব সতর্ক থাকে। মানুষকে চেনা যায় ছোট ছোট আচরণ দিয়ে, কথা দিয়ে, বিভিন্ন বিষয়ে তার মতের প্রকাশ দিয়ে। তখন দুইজনের কোনো একজনের অথবা দুইজনেরই স্বপ্নভঙ্গ হয়। দূরত্ব তৈরি হয়। নিজেকে সংশোধন না করলে সেই দূরত্ব বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তারা চেষ্টা করে একজন আরেকজনের সাথে যতখানি সম্ভব কম সময় কাটাতে, বা কম কথাবার্তা চালাতে। সেই ফাঁক দিয়েই ঢুকে পড়ে তৃতীয় জন। অথবা নিজেরাই খুঁজে নেয় তৃতীয় জনকে।
খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনে শবনম। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে– পিরিতের সময় মিছা কথা কয় ক্যান? বুঝবার পারে না যে পরে তো ধরা পড়াই লাগবি?
এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে সময় লাগে আমার। আমাকে ভাবতে দেয় শবনম। বেশ কিছুক্ষণ পরে বলি– মিথ্যা তো বলতেই হয় শবনম। সব সম্পর্কের সাথেই কিছুটা মিথ্যা থাকে। তাছাড়া সেই মিথ্যাগুলো সবসময় খুব বড় মিথ্যা নয়। তারা সবাই যে খুব বড় মিথ্যাবাদী, তা নয়। প্রেমের সম্পর্ককে মধুর করার জন্যও মিথ্যা বলে। ইংরেজিতে তাদের বলা যায় ইমাজিনারি লায়ার।
সেইডা কী?
কল্পনা করে নিজেকে এমন একভাবে, যা সে নয়। অথবা ভাবে, এখন যে হয়তো সেই অবস্থানে নেই, কিন্তু বিয়ের আগেই সেই অবস্থানে পৌঁছে যেতে পারবে। তখন তার এখনকার বলা মিথ্যাটা আর মিথ্যা থাকবে না। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই তো সেটা করতে সফল হয় না শেষ পর্যন্ত। তখন সেই রোমান্টিক মিথ্যা পরিণত হয় বিষাক্ত মিথ্যাতে।
শবনম নিজের মতো করে বুঝে নেয় হয়তো। এই বিষয়ে আর প্রশ্ন করে না। কিন্তু তার পরের প্রশ্নটা আসে খুব স্থূলভাবে, এবং তীক্ষ্নভাবে– তা তো গেল পিরিতের বিয়ার কথা। কিন্তু এমনে এমন যেসব বিয়া হয়, সেইগুলান ক্যান এত হারামি হয়? তাগোর পোলা-মাইয়ারাও খুব হারামি হয় ক্যান?
বুঝতে পারিনি কথাগুলো পরিষ্কার। জিগ্যেস করি– যেমন? বুঝিয়ে বলো।
শবনম বলে– কইতাছি শোয়াশুয়ির কথা। ভদ্দরলোকেরা বাছ-বিচার তো কেউ করে না দেখি। আমার বইনে যেসব বাসাবাড়িত কাম করছে, সব বাড়িত একই অবস্তা দেখছে। বাড়ির মরদ যায় অন্য মাইয়ার লগে ফস্টিনস্টি করতে, বউডা যায় আরেক ব্যাডার লগে একই কাম করতে, জুয়ান পোলা ফাঁকাবাড়ি পাইলে লইয়া আসে কুনো মাইয়ারে, আবার জুয়ান মাইয়াও জামা-কাপুড় বদলানোর লাহান বয় ফেরেন্ড বদলায়। এইগুলান তো আর পিরিত না। খাউজানি মিটায় খালি।
তোমার বোন আর কয়টা বাড়ি দেখেছে। সব পরিবারে তো এমনটি হয় না।
বলি বটে। কিন্তু নিজের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হই, পরিস্থিতি সত্যিই অনেকটাই এই পর্যায়ে চলে গেছে। বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষণশীল মনে করে সবাই। বিশেষ করে যৌনতার ব্যাপারে। কিন্তু পরিসংখ্যান তো অন্য কথা বলে। দুই হাজার সালের শুরুর দিকে এইচআইভি-এইইডস প্রিভেনসন প্রোগ্রামে কাজ করতে গিয়ে কেয়ার বাংলাদেশের জরিপ দেখেছিলাম। শতকরা ৫০ জন নারী-পুরুষ বলেছে যে তাদের এক্সট্রা ম্যারাইটাল সেক্স বা বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা আছে। আর শতকরা ৭৩ জন বলেছে যে পূর্ণ যৌনকর্ম না থাকলেও তারা চুম্বন, আলিঙ্গন, স্পর্শ এইসব করেছে বা করে।
শবনম মাথা দোলায় একটু আক্ষেপে– দোষ খালি আমাগের। কিন্তুক আমরা তো মিছা-টিছা না কইয়া ব্যবসা চালাই। ব্যবসা পাপের হইবার পারে। কিন্তু মিছা নাই এই ব্যবসাত। ভদ্দরলোকেরা সব হালায় মিছা সংসার চালায়। মিছা সম্পর্ক করে।
তারপর হঠাৎ করে একটা তীর ছুটে আসে আমার দিকে প্রবল বেগে। শবনম খরচোখে আমাকে বিদ্ধ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়– আপনের সম্পর্কও কি ঐ রকমই?
প্রশ্নের উত্তর এড়াই আমি– অন্য সম্পর্কের কথা বাদ দাও। তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে একটুও তো মিথ্যা নাই।
খুশিতে শবনমের সমস্ত শরীর যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমার হাতের ওপর আলতো আঙুল বুলিয়ে হয়তো কিছু বলতে চায়। কিন্তু উপযুক্ত শব্দ খুঁজে না পেয়েই হয়তো চুপ করে বসে থাকে।
প্রায় আধাঘণ্টা পরে শুকুর আলিকে দেখা যায় এগিয়ে আসতে। শবনমের খদ্দের পাওয়া গেছে।