কবিতা -চন্দনা রায় চক্রবর্তী
পরিস্থিতির একটা অদৃশ্য আগুনে ক্রমশ গা সেঁকে নিচ্ছি। শরীরের জাগতিক নিবিড় অনুভূতি গুলো একটু একটু করে, শরতের মেঘ সাঁকোয় ভর করে, বাষ্পের প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসছে। হাওয়ায় ভাসছে লাখো লাখো রঙিন প্রজাপতি।
ওরা সবাই যবনিকার ওপারে, শুঁয়োপোকাই ছিল। কাঁটাতারের অন্তিম মাধুর্যতা, ওদের প্রজাপতিতে রুপান্তরিত করেছে। কারো কারো রুপান্তর দ্রুত হয়েছে। সময় আমায় বড় দেরী করিয়ে দিল। কোন রকমে ছুট্টে অবশেষে, শেষ ট্রেনের সর্বশেষ কামরাটা ছুঁতে পেরেছি।
দীর্ঘদিন ধরে উদারতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। দেবী হওয়ার তাড়নায়, একটা আশ্চর্য প্রদীপ জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছিলাম অগ্নিশুদ্ধির। একটা সময় মনের ঘোর কাটল। অসূর্যস্পশ্যা মন চেতনার আলোয় আলোকিত হল। সে আলো আমার অন্ধ চোখেও স্বপ্নের কাজল টেনে দিল।
সেই শুরু। রুপান্তরের দিনক্ষণ, বিধি, নির্ঘণ্ট তখনই স্থির হয়েছিল। শুধু আমি জেনেছিলাম অনেক পরে। ততদিনে শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন-লীলা শেষ করে মথুরার পথে যাত্রা করেছেন। বিরহিণী রাই অনন্ত বিরহের শয়ানে শায়িত। কৃষ্ণ বিনে খাঁ খাঁ করছে বৃন্দাবন। কোথাও সেই সুতীব্র, সুতীক্ষ্ণ বিরহের ঢেউ আমাকেও আছন্ন করে ফেললো।
বিরহের ফুল ফুটল শব্দ হয়ে। অনুভূতিগুলো শীতঘুমের প্রচ্ছন্নতা কাটিয়ে চোখ মেলে তাকালো। সূর্যকে স্বাক্ষী রেখে, অনুভূতির কণ্ঠিবদল করেছি আমি, কবিতার সাথে। তাই আমি কবিতার দাসানুদাস।
আমার দ্বৈতসত্বা। সংসারের সেবাধর্ম, সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন করে ভাগশেষে পাওয়া, উচ্ছিষ্ট সময়ে, কবিতার অপলক সেবা করি। বড়ো মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে সে আমায়। তাকে ভর করে আমার নিঃস্ব, উচাটন মন উড়ে বেড়ায়, পৃথিবীর এক দিগন্ত থেকে আর এক দিগন্তে, এক কক্ষপথ থেকে অন্য এক কক্ষপথে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।
শরতের পানসি মেঘ আর বিস্মিত বালক রোদ্দুর আশ্চর্যজনক ভাবে, আমার কক্ষপথে সঙ্গী হয়। ঘাসফড়িং হয়ে যাওয়া মনটা কখনও মেঘলা হয় অনুভূতির বিড়ম্বনায়। কোথায় যেন একটা সর্বত্যাগী অভিমানী মন, রাইকিশোরী হয়ে আঁকড়ে ধরে শ্যাম রুপি কবিতাকে। আর তারপর….
তারপর, অনন্ত যাত্রার গল্প। কবিতার বুকে মাথা রেখে আমি, পৃথিবীর শেষ ট্রেনের অনির্দিষ্ট যাত্রী, কাঁদি, হাসি, হাওয়ায় ভাসি, মেঘপঙ্খীরাজে চেপে একটু একটু করে, আবারও…. একটু করে, এগোতে থাকি, সেই না-ফেরার দেশের পানে…….