কবি সুপ্তি জামান‘এর ছ‘টি কবিতা

0
243
Shupti Jaman

জয়ন্তী নদী

কবি সুপ্তি জামান

পুকুরের মাছ, খোয়ারের ছাগল
ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তজবার লাল রঙ
পুলের ওপর ঝরে পড়া শিউলি ফুল
সকলেই ভালো আছে
ওদেরতো মানুষের মতো চোখ নেই
বুক নেই
স্মৃতি নেই
ওদের বিছানার ওপর কোলবালিশ থাকে না
যে বালিশের গায়ের জামাটি প্রয়াত মায়ের হাতে সেলাই করা
কেন ফিরে ফিরে ব্যাথাতুর নদীর কূলে ফিরে আসা!
কেন আসি?
গলাজলে শাপলা
পাখির ফুরুৎ ফুরুৎ উড়ে যাওয়া
বয়জেষ্ঠদের দুচোখ জুড়ে ছুঁয়ে থাকা শূন্যতা
টান ধরে আসা বিলের পানি
জলের উপর বিছানো কচুরিপানা ফুলের বেগুনি গালিচা
আর সুপর্ণনখা ফুলের গাঢ়ো বেগুনি আভা
সবকিছু ছাপিয়ে আমার দুচোখের কোলে ভেজা কুয়াশা
এখানে আমার সব আছে
এখানে আমার কিছু নেই
এখানে আছে এক নদী
জয়ন্তী তার নাম
বয়ে যায় নিরবধি
গিলে খায় আমার সব স্মৃতিময় পথ ঘাট মাঠ
জলা-জঙ্গল কিছু বাদ নাই
আমি ফিরে যাই
পালিয়ে যাই
কতদূর আর যাওয়া যায়
সময় ফুরিয়ে যায়
কতকিছু রয়ে গেল বাকী
ভুল করেও দেখা হয় না ভুল মানুষের সাথে!
চোখে তারায় নামে ঘোর
সবকিছু বিবর্ণ
ঘোলা জল,
মানুষগুলো খুঁজে পায় না জীবনের তল।

তাকিয়ে আছ স্থির

কবি সুপ্তি জামান

চোখে চোখে রাখবে বলে হারিয়ে গেছ
চিরতরে চোখ বুঝলেই তোমায় দেখি
তাকিয়ে আছ আমার দিকে স্থির
যখন তুমি ছিলে
ক্ষেদ ছিল মনে
আমিই কেন হলাম না তোমার সকল ভালবাসা
আজ তুমি যখন নেই কোনখানে
তুমি আছ কেবল আমার হয়ে
চোখ বুঝলেই দেখতে পাই
তাকিয়ে আছ স্থির
কথা কোন হয় না যদিও
তোমায় আমি দেখতে পাই
সকল সময় থাক আমার সাথে সাথে।

নির্বাসন

কবি সুপ্তি জামান

তুমি বলতে এই অজপাড়াগাঁয় মানুষ থাকে নাকি
বিদ্যুতের আলো নেই, পত্রিকা নেই, টেলিভিশন নেই
রাস্তাঘাট নেই
গায়ের মানুষদের প্রতিও ছিল বিস্তর অভিযোগ
লেখাপড়া জানে না, কুসংস্কার আঁকড়ে ধরে থাকে,
মেয়েগুলোকে বিয়ে দিয়ে দেয় ফুল হয়ে ফুটবার আগে,
সন্তান বিয়োয় বছর বছর, শিশুগুলো অপুস্টির শিকার,
আরো বিরক্ত হতে ওরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে না বলে
আমাকে বলতে মস্তবড় এক শহর আছে
ওখানে শিশুরা গান শেখে, নাচ শেখে, ছবি আঁকে
আরোও কত কী জানে
মানুষ গাড়িতে চড়ে, ওখানে শিশুদের
মানুষের মতো মানুষ হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি
আলোর দিকে যেমন ছুটে চলে পতঙ্গ
আমরাও ছুটলাম শহরের দিকে
যেন সেই মস্তবড় শহর আমাদের উজ্জয়নীপুর
তুমি আর সুরমা ফুল রয়ে গেলে সেই অজপাড়াগাঁয়
মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্নে ছিলাম বিভোর
একদিন দেখি তোমার আর কোন স্বপ্ন নেই
আমাকে ছাড়াই গুছিয়ে নিয়েছ তোমার একলা জীবন যাপন
তোমায় বললাম – এবার শহরে চলো
মস্তবড় সেই উজ্জয়নীপুরে চলো
ওখানে আমার ঘর আছে
তুমি বললে নারে
আমি এখানেই এই অজপাড়াগাঁয়ই মরতে চাই-
যদি তুমি নাইবা রইবে আমার সাথে তবে কেন
আমায় নির্বাসিত করলে আমায় তিলোত্তমা এই নগরে?
আমার যে খুব একলা লাগে
কত কাল হয়ে গেল গত
কত দিন দেখি না তোমায়
কত দিন—

কোন এক মৃত্যু সংবাদ

কবি সুপ্তি জামান

চাকুরী থেকে অবসরের অল্প কিছুদিন আগে
তাঁর সাথে আমার পরিচয়
বয়স্ক তরুণ!
ঢাকা ছেড়ে খুলনায় ফিরে যাবেন বলে চকচকে স্বপ্ন তাঁর চোখে
তিন বিঘা জমি আছে পৈত্রিক
ছোট একটা পুকুর আর পুকুরের চারপাশ ঘিরে-
সব্জীর বাগান করবেন বলে জানিয়েছিলেন আমায়
অবসরের পরেও দু একবার দেখা হয়েছে
সকালের ঝলমলে একখন্ড রোদ যেন
ছুঁয়ে থাকতো তাকে, পরিতৃপ্ত এক মানুষ
জীবনে যা পেয়েছেন তারচেয়ে বেশি কিছু ছিল না চাইবার
সেওতো অনেকদিন হলো
ভুলেও আর মনে পড়েনি তাকে
কোন লেনদেন ছিল না তাঁর সাথে
চলতিপথে দেখা হয়েছিল, যেমন দেখা হয় অনেকের সাথে
আজ সকালে কেউ একজন তাঁর সেই সকালের রোদমাখা
হাস্যজ্জল মুখের একখানা ছবি ছেপে দিয়ে বলল, তিনি আর নেই
পৃথিবী থেকে একখন্ড সকালের রোদ হারিয়ে গেল চিরতরে

যে আমারে ছেড়ে গেছে

কবি সুপ্তি জামান

তুমি ওপাশে রেললাইনের ওপরে
আমি এপাশে ছুটছি তোমায় ধরবো বলে
শত শত মানুষ তখন ওভার ব্রিজের পারাপারে ব্যস্ত
ফাঁক- ফোকর গলে ছুটছি তোমায় ধরবো বলে
ছেড়ে চলে গেলে নির্দয় প্রেমিকের মতো
একবারও ভাবলে না আমি রইলাম পড়ে পশ্চাতে
তোমার অপসৃয়মান পথের দিকে চেয়ে রইলাম নিরুদ্বেগ
ছেড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে বয়স বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে
যে চলে যায় তাহার তরে এক দীর্ঘশ্বাস বুকের পরে থাকে চুপ করে।

কার্তিকের মরা বিকেল

কবি সুপ্তি জামান

কার্তিকের মরা বিকেলে
আমার ঘুমের ভেতরে জেগে ওঠে একদল মানুষ
যারা একদিন ব্রজমোহন গ্রামে আহন বাড়ির বাসিন্দা ছিল
তাঁরা একে একে গত হয়েছেন
কেউ কেউ আমার ভীষণ জ্ঞাতসারে।
জয়ন্তী কেবল ভাঙ্গে বরষায়
আর আমি এই মরা কার্তিকেও
কেমন নির্লিপ্ত ছিলাম কোন কোন মৃত্যু সংবাদে—
আজ তাঁরা সকলেই নির্ঘুম
জেগে থাকেন, হেঁটে যান ছোট পুকুরের পশ্চিম পাড়ে
দু একটা খেঁকশিয়াল বেড়িয়ে আসে
হাজারিভিটার গহীন জঙ্গল থেকে
পুকুরের পানি নেমে গেছে তলানিতে,
ভেদামাছ শয্যা নিয়েছে পুকুরের কিনারার কাঁদায়
আর আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি সেইখানে
সেওতো আজ বিয়াল্লিশ বছর গত হলো।
কার্তিকের মরা বিকেলে শত শত বিগত মুখ হেঁটে আসে
যেমন আসতো ভর সন্ধ্যায় হাঁট থেকে সদায়পাতি নিয়ে
সূর্য এসে হেলে পড়ে, বিপন্ন আলো ছড়ায় আমার ঘুমের ভেতর
সকলেই বিগত হলো যদি
তবে কেন এমন করে আমায় জাগিয়ে রাখা!

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধপায়ূপথেই ছিল ১০ লাখ টাকার হেরোইন
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের সিংড়ায় ৯ চেয়ারম্যান প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে