করোনাকালের বাজেট: একটি পর্যলোচনা
রেজাউল করিম খান
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অনেক জাতীয় গরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা, অধ্যয়ন ও মন্তব্য করতে উৎসাহবোধ করেন না। বাজেট তার মধ্যে একটি। দেশ পরিচালনায় অপরিহার্য বিষয় জাতীয় বাজেট একটি বার্ষিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। রাজনীতির সঙ্গে এর ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। আপনি বাজেট মানেন বা না মানেন, অথবা অবজ্ঞা করেন, বাজেট কিন্তু আপনাকে ছাড়বে না। যেমন রাজনীতি আপনাকে ছাড়ে না। জনগণের জীবন ও জীবিকার সমস্যা, সংকট এবং সম্ভাবনার অনেকটাই নির্ভর করে বাজেটের ওপর। সাধারণত, বাজেট ঘোষিত হয় বিগত বছরের নমুনা দেখে। পরে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়, স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ বা চাপের মুখে। বাজেটে আরোপিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে কেউ কেউ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও অনেক সময় সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। গৃহহীনরা ঘর পাবে কিনা, গরিবের সন্তান শিক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পেরোতে পারবে কিনা, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে সুস্থ হওয়া যাবে কিনা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে কিনা, তা নির্ভর করে রাজনৈতিক বজেটের ওপর। এসবই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। যে সংবিধান রচিত হয়েছে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে। এবারে করোনাকালের এই বাজেটটিও গতানুগতিক, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও জাতীয় সংসদে বাজেট অনুমোদিত হবে আরও দুই সপ্তাহ পর। কিন্তু কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা এখনই শুরু হয়ে গেছে। এরমধ্যে আমি নিজেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি, মোবাইল সেবার কর বৃদ্ধির খবরটি নিয়ে।
দৈনিক প্রথম আলো গত ১১ জুন একটি খবরের শিরোনাম করে, “কর বাড়ল, মোবাইলে ১০০ টাকায় ২৫ টাকা নেবে সরকার”। খবরে বলা হয়েছে, বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর কর আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার। এই দফায় সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা গত বছরও একই হারে বাড়ানো হয়েছিল। বাজেটের কর প্রস্তাব ঘোষণার পরপরই কার্যকর হয়। ফলে বাড়তি কর টেলিযোগাযোগ কোম্পানি নিজেরা বহন না করলে গ্রাহকের ওপর চাপবে। নতুন করহারে মোবাইল সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ১৫ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ ও সারচার্জ ১ শতাংশ। ফলে মোট করভার দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। শীর্ষ দুই মোবাইল অপারেটর গ্রামীনফোণ ও রবির হিসাবে, তাদের মোট রাজস্ব আয়ের ৫৩ থেকে ৫৬ শতাংশই সরকারের কোষাগারে বিভিন্ন কর ও ফি বা মাশুল হিসেবে চলে যায়। দেশে মার্চ শেষে মোবাইল গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫৩ লাখের বেশি। এ তালিকায় শীর্ষ ধনীরা যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন দরিদ্র মানুষ।
অপরদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় মোবাইল ব্যবহারে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানোকে ‘সহনীয়’ বলে মনে করছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। শুধু তাই নয়, দেশে মোবাইল কলরেট কম বলেই মানুষ অকারণে মোবাইলে কথা বলে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। শুক্রবার ১২ জুন বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোনের কলের ওপর আগে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ছিল। সেটা আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এটা নিয়ে অনেকেই না বুঝে নানা ধরনের কথাবার্তা বলছেন। আমাদের সমস্যা হলো আমরা অনেক সময় ঠিকমতো না বুঝেই মন্তব্য করতে থাকি। তিনি বলেন, মোবাইল ফোনের সেবায় কর বেশি বাড়ানো হয়নি। ১৫ শতাংশ করের জন্য সাধারণ মানুষের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ সাধারণ মানুষ ফোনে প্রচুর কথা বলে।’ এখন আপনারাই বলুন, কোন্টি ঠিক!
এদিকে রবিবার প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, পাসের আগে মোবাইলের কথা বলা ও ইন্টারনেটে বাড়তি শুল্ক কেন আরোপ করা হয়েছে, তা জানতে চেয়ে মোবাইল অপারেটরদের কড়া ভাষায় ই-মেইল পাঠিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সংস্থাটি অপারেটরদের বলেছে, বাজেটে যে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, তা ইতিমধ্যেই আরোপ করা শুরু করেছে অপারেটরেরা। বিষয়টি বিটিআরসির নজরে এসেছে। এটা প্রমাণিত হলে নজিরবিহীন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাজেট বিষয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। করোনাভাইরাস সঙ্কটে এবারের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হয়েছে অনলাইনে। নিজের দেওয়া দ্বিতীয় বাজেটকে ‘মানুষকে রক্ষা করার’ বাজেট হিসেবে বর্ণনা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, “সেই চিন্তা থেকেই আমরা প্রথমে টাকা খরচ করব; পরে আয় করব। আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। তারপর টাকা জোগাড় করব।” অর্থমন্ত্রী বলেন, সবার আগে মনে রাখতে হবে, এই বাজেট ‘স্বাভাবিক বাজেট নয়’।
এবারে আমরা দেখি, প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে দুই অর্থনীতিবিদ কী মন্তব্য করেছেন। সিপিডির ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, “করোনার কারণে আমরা একটি অসাধারণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই সময়ে বাজেটে নতুন কিছু প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সরকার একটি সাধারণ বাজেট দিয়েছে। সরকারি ব্যয় বাড়ানো, বিশেষ ঋণ সুবিধা দেয়া, নিরাপত্তাবলয় সম্প্রসারণ এবং বাজারে তারল্য সঞ্চালন। এই ৪টি লক্ষ্য খুবই সঠিক। কিন্তু যে বাজেট কাঠামোর ওপর এটিকে দাঁড় করানো হয়েছে, সেটি একেবারেই বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়া বাজেট তৈরিতে যে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ছিল, সেটি অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেই ঘাটতি স্বীকার করেও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে কোনো সংযম প্রদর্শন করলেন না। রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তব নয়। করোনা সংকট নিরসনে নতুনভাবে কোনো কর্মসূচি এখানে দেখছি না। করোনা নিয়ে আমরা দেখেছি, দরিদ্র মানুষের সহায়তা এবং কেনাকাটার ক্ষেত্রে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এর পাশাপাশি অর্থনীতিতে বৈষম্য বেড়েছে। এর মধ্যে আয়, ভোগ ও সম্পদ তিন খাতেই বৈষম্য বেড়েছে। আর ধনী-গরিবের পার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য আমরা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখিনি।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, “অবাস্তব বাজেট। করোনার কারণে সব খাতেই আয় কমছে। সংকটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। রফতানি আয় নেতিবাচক। এরপরও ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা একেবারে অসম্ভব। ফলে এই বাজেটে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কিছু কাল্পনিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। বাজেট ঘাটতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আর ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের কথা বলা হয়েছে। এই পরিমাণ ঋণ দেয়ার সক্ষমতা ব্যাংকের নেই। বিভিন্ন খাতই নেতিবাচক। এর মধ্যে রফতানি, রেমিটেন্স, আমদানি এবং বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি, কোনো কিছুতেই স্বস্তির খবর নেই। আয়ের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা আয় করার লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এনবিআর চেয়ারম্যান নিজেই সরকারকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, এই পরিমাণ আয় করা সম্ভব নয়।
ফলে ঘাটতি আরও অনেক বাড়বে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হবে। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই রাজস্ব আদায়ের হার নিম্নমুখী থাকবে। কিন্তু সরকারের ব্যয় খুব একটা কমবে না। রাজস্ব আদায়ের বড় খাত ভ্যাট। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবির অবস্থা চলছে, তাতে ভ্যাট আদায় কমবে। রাজস্ব আয়ের আর একটি খাত হচ্ছে ব্যক্তি কর ও প্রাতিষ্ঠানিক কর থেকে প্রত্যক্ষ রাজস্ব আদায়। কিন্তু চলতি সংকটের কারণে সবাই প্রণোদনা বা কর মওকুফ চাইছে। স্বাভাবিকভাবেই করোনার কারণে অনেক লোক চাকরি হারাবে। নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। এসব মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকা জরুরি ছিল। এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শুধু গ্রামকেন্দ্রিক নয়, এবার শহরেও আনতে হবে। এ ছাড়া প্রবাসী অনেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরবেন। তাদের দিকেও বিশেষ নজর দেয়া জরুরি। এ ছাড়া কৃষিতেও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। কারণ, এ সময়ে যেন খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে না পড়ে।”
বাজেট সম্পর্কে দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও রাজনীতিকদের অনেকেই বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, নিবন্ধ লিখছেন, টিভি চ্যানেলের টক শোতে সংবাদ সম্মেলনে নানা প্রস্তাব রাখছেন, অনেকে দাবির পাশাপাশি ফরিয়াদও জানাচ্ছেন, কেউ কেউ উপদেশ ও পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু ইতিহাস বলছে, তাঁদের এইসব দাবি-প্রস্তাব-পরামর্শ বাজেটে তেমন প্রতিফলিত হয় না। স্বীকৃত যে, সরকারের শ্রেণি অনুযায়ী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। বাজেটে থাকে তার কর্মপরিকল্পনা। সেই কারণে ভারতের বাজেট আর ভিয়েতনামের বাজেট একরকম হয় না।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থামানো যাচ্ছে না; প্রথমাবস্থায় কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ভাইরাসটি রাজধানীর বাইরে গেছে। জনসাধারণের ওপর তেমন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বরং প্রভাবশালীরাই ছড়ি ঘুরিয়েছে। ফলে করোনা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতি হতে থাকে। এখন প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এমতাবস্থায় করোনা মোকাবেলায় বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দসহ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। আরও অনেক কিছুই চাওয়ার আছে। গবেষণা ও প্রযুক্তিনির্ভর গণমুখী শিক্ষার জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ, দুর্নীতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনের ক্ষমতা ও লোকবল বৃদ্ধি, খাদ্য ও বাসযোগ্য সামাজিক নিরাপত্তা তৈরিতে গুরুত্বারোপের কথা বলা যায়। বিদেশে যারা গাধার মতো পরিশ্রম করে বছরে দুই লক্ষ কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা সভ্যতা নির্মাণ করছে, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যারা মাঠ থেকে খাবার তুলে আনছে, যাদের রক্ত পানি না হলে চাকা ঘোরে না, তারাই আবার সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিচ্ছে। তাদের কথা একটু ভাবতে হবে বৈকি!
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট e-mail: rezaul.natore@yahoo.com