শাহারা খান : ভদ্রমহিলার সাথে আমার পরিচয় ছেলের স্কুল থেকে। আমার ছোট ছেলে আর উনার ছেলে একই ক্লাসের ছাত্র। মাঝে,মধ্যে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে দেখা হতো,কথা হতো। উনি থাকেন আমাদের পাশের দু’রাস্হার পরে। প্রবাসে থাকি,বাঙালী দেখলেই কথা বলতে মন চায়,তারপর উনিও সিলেটি। সেই থেকে আন্তরিকতা।
উনি মাঝে,মধ্যে বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের বাসায় আসতেন,আমিও সময়,সুযোগে যেতাম। দেখা গেছে ভালো কিছু রান্না করলে আমিও দিতাম,উনিও পাঠিয়ে দিতাম। অল্পদিনেই আমাদের মধ্যে বেশ ঘনিষ্ট সম্পর্ক হয়ে যায়। পরিচয়ের পর থেকে যে জিনিসটা আমি লক্ষ্য করলাম,সংসারের সব দায়িত্ব ভদ্রমহিলা একাই সামাল দিতেন।
বাচ্চাদেরকে স্কুলে আনা-নেওয়া,পার্কে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো,এমনকি হলিডে তে উনি একাই বাচ্চাদের নিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে আমি জিজ্ঞেস করতাম, ভাবী আপনি একা কেন যান? ভাই সাথে যায় না? উনি বলতো,আপনার ভাই তো ব্যস্হ, সময় পায় না। ভদ্রমহিলার মুখ থেকে কখনো স্বামীর বিরুদ্ধে কোন কম্পপ্লেইন নেই।
আমার সাথে কথা প্রসংঙ্গে প্রায় সময় স্বামীর তারিফ করতেন। উনার স্বামী এটা খেতে পছন্দ করে,উনার স্বামী খুব ধার্মিক,দান খয়রাত করেন। নফল রোজা রাখেন। বছর,বছর উমরা করেন,হজ্জ করেছেন। অথচ নিজের ব্যাপারে ভদ্রমহিলা কখনো কোন অহংকার নেই। অতি সাধারান চলাফেরা। কথা বার্তায় মার্জিত।সবার সাথে ভালো ব্যবহার করেন। অত্যন্ত অতিথি পরায়ন।
যে কয়দিন ভদ্রমহিলার বাসায় গিয়েছি,উনার স্বামীকে দেখে আমার কাছে ভালো মনে হলো না। ভদ্রলোক দেখতে অবশ্যই স্মার্ট। বয়স অনুযায়ী চুল,দাড়ি পাকা থাকার কথা হলেও, কালার দিয়ে এখনও কাঁচা রেখেছেন। এবং আমার ধারনা মিথ্যে না। উনার অশোভন কথা বার্তায় উনাকে ভালো চরিত্রের লোক মনে হলো না। সেই থেকে ভদ্রলোক বাসায় থাকলে,আমি কখনো উনাদের বাসায় যেতাম না। তবে আমি ব্যাপারটা ভাবীকে বলিনি,হয়তো উনি কষ্ট পাবেন।
এক শনিবার বিকালে বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে গেছি। দেখি দূরে একটা বেঞ্চে ভাবী বসে আছেন। আমি উনার পাশে গিয়ে দেখি,উনার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমাকে খেয়াল করতেই তাড়াতাড়ি চোখ মুছে,জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছি। আমি আজ উনাকে ছাড়লাম না। পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম,ভাবী কি হয়েছে? প্লিজ আমাকে বলুন। হয়তো উনার ধৈর্যের বাদ ভেঙে গেছে,তাই বাধ্য হয়ে বলতে শুরু করলেন——
বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্য করেছেন উনার স্বামী একজন দুশ্চরিত্রের লোক। নানান গার্লফ্রেন্ডের সাথে অশালীন ফোনালাপ করে। তাদের পরিবারের কাছে ভাবী সেটা অবগত করিয়েছেন,কিন্তু কেউ তাতে ভ্রুক্ষেপ করেনি। বিদেশ এসেও একই অবস্হা। সংসারের সব দায়িত্ব ভাবীকে করতে হয়ে। উনি শুধু খরচ পাত্তি বহন করে। মনে করে ভরণ পোষণ সঠিক মতো দিয়ে দিলেই তো হয়। আর কি ?
যে কারো সাথে উনি কথা বলুক,টাইম পাস করুক,তাতে কি? ভাবী উনাকে অনেক বুঝিয়েছে,উনি তো বুঝ মানেই না। উল্টো তাকে তালাকের হুমকি দেয়। চুন থেকে পান খসলেই তালাকের হুমকি দেয়। রান্না ভালো হয়নি,তালাকের হুমকি দেয়। ভদ্রমহিলা আল্লাহর ভয়ে,বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে,সামাজিকতার দিকে তাকিয়ে চাচ্ছেন না,সংসার ভাঙতে।
বিদেশে উনি আইনের আশ্রয় পাবেন। আইন মোতাবেক মা পাবে বাচ্চা। ডিভোর্স হলেও স্বামী অবশ্যই বাচ্চাদের ভরণ পোষণ দিতে বাধ্য। এবং কাগজদারী স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাকেও বিয়ে করতে কত পুরুষ রাজি হবে। কিন্তু তারপরেও তিনি চান না,অন্য কোন পুরুষকে স্বামী হিসেবে বরণ করতে। কিম্বা সিঙ্গল মাদার হিসেবে জীবন কাটাতে। অথবা বাচ্চাগুলোকে Broken family এর বাচ্চা হিসেবে গড়ে তুলতে।
আমাদের সমাজে একটা মেয়ে যতই নির্দোষ হউক,স্বামী পরিত্যক্তা হলে কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের উপরেই দোষ যায়। আবার ভবিষ্যতে ছেলে,মেয়ের বিয়ের সময়েও প্রশ্ন আসে মা তালাকপ্রাপ্তা। যেখানে আজকাল অনেকেই সংসার ভাঙতে আগ পিছ এত ভাবেনা,উত্তেজনার বশে যা ইচ্ছা করে ফেলে,সেখানে ভাবীর এত গভীর চিন্তা,ভাবনা আমাকে বিমোহিত করলো।
এতটা বছর উনি কিভাবে ধৈর্য ধরে আছেন? স্বামী.স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হতেই পারে। তাই বলে কথায়,কথায় তালাকের হুমকি দেয়া? এই ধরনের মানুষ রূপি জানোয়ারদের শাস্তি কি হওয়া উচিত? ভাবীকে কি শান্তনা দেবো,উনার কথাগুলো শুনে অশ্রু ধরে রাখতে পারলাম না…..
২৩/০৮/২০