ঘুমের স্রোতে – এ কে সরকার শাওন এর ছোটগল্প

0
859
AK

ঘুমের স্রোতে
এ কে সরকার শাওন

আজ জগলুর ঘুম ভেঙ্গে গেল সকাল পাঁচটার আগে! মনে আনন্দ লাগছে যে ঘুম থেকে আগে ভাগে উঠেছে! লক ডাউনে অনেক পরিবারেই ঘুমের জয় জয়াকার! বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তো ঘুমের মহোৎসব চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারনে! পিচ্চিরা ছড়া কাটছে
“লেখা নাই পড়া নাই
বদন বইয়ে কি মজা!
খাই দাই ঘুম যাই
যেন হয়ে গেছি রাজা!”

জগলু তার ভাবী, বোন ও প্রতিবেশীর নিকট খোঁজ নিয়ে জেনেছে প্রায় সব পরিবারেই একই অবস্থা! ঘুমের কারনে খাওয়া-দাওয়া- নাওয়া সবকিছুর টাইম টেবিল ওলট-পালট হয়ে গেছে! তার ছোটকন্যা মনীষা ঘুৃম থেকে জাগে একবারে বারটার পর ! বিষয়টি নিয়ে কানিজ প্রতিদিনই বকাঝকা করে। জগলু কানিজকে বলেছে ওকে আর বকাঝকা করো না। বরং ওর রুমের ঘড়িটায় দুপুর বারটার জায়গায় সকাল ৬টা সেট করে দাও। সেইমত তার জন্য নতুন সময় সেট করা হলো। অনুরূপ সময়ে রুটিনও করা হলো। এখন মনীষার সময়ের মানে দাঁড়ালো অন্যদের যখন দুপুর বারটা তখন তার সকাল ছয়টা। কখন ঘুম থেকে কারা জাগে এবং আগে জাগার সুফল ও পরে জাগার কুফল সম্পর্কিত “যে যখন জাগে” শিরোনামে একটা কবিতা লিখে ডায়েনিং রুমে লাগিয়ে দিল। ফলাফল যেই লাউ সেই কদু!

তারপরও মনীষা লেট করে উঠে। এতো কিছুর পর এর থেকে উত্তোরণের কি পথ তা জগলুর জানা নাই। এভাবে সব পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের জাগতে দেরী হলে তা হবে জাতির জন্য অশনিসংকেত! আগামীতে আমরা একটা ঘুমন্ত জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে!
মনের দুঃখে চারটি লাইন লিখলোঃ-
কালো ঘুমের তীব্র স্রোতে
লেখাপড়ার প্রদীপ নেভালে;
মস্তিষ্ক ঊষর জীবন ধূসর
আলসেমী মনের খেয়ালে!

আগে আমাদের মা-দাদীরা ঘুম পাড়ানী গান গেয়ে আমাদের ঘুম পাড়িয়েছেন ।
“ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি
মোদের বাড়ি এসো….”

কিংবা

“আয় ঘুম ঘুৃম আয়
পূব পূবালী বায়” ইত্যাদি!

এখন ঘুমের জন্য আর ওসবের দরকার হয় না। আগে ভয় দেখিয়েও ঘুম পাড়ানো হতো। ডাকু মনসুরের নাম শুনিয়ে বাচ্চাদের ঘুৃৃম পাড়ানোর কথা কে না জানে! ডাকু গাফফার খানের নাম শুনলে না-কি ভয়ে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়তো! তখনকার ডাকাতরা বড় জোর হাজার টাকা ডাকাতি করতো তাতেই কি নাম-ডাক-হাক! এখনকার সম্মানিত ডাকাতগণ শত শত কোটি টাকার ডাকাতি করে সহজেই পার পেয়ে গেলেও কেউ কিচ্ছু জানতে পারে না!

মনে পড়ে ছোটবেলার (১৯৭৩/১৯৭৪ সালে) ঘুম থেকে জেগে ওঠা নিয়ে কবিতাগুলোর কথা! ছোটরা তোতাপাখির মত মুখস্ত করতো মদনমোহন তর্কালঙ্কারের “আমার পণ কবিতাটিঃ-

“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।

আরও পড়তো এই একই কবিরই লিখা “পাখি সব করে রব” কবিতার

“পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।”

যে জীবনে একবার বই হাতে নিয়েছে সে
“পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল।” কবিতাটও পড়েছে!

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রভাতী” কবিতা পড়েছে পরবর্তী প্রজন্মের ছাত্র -ছাত্রীগণঃ-

“ভোর হলো দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!”

হায়রে এখনকার খুকুমণিরা দুপুরেও উঠতে চায় না। তাদের ঘুমই মোটে ভাংঙ্গে না। খালি ইন্টারনেট, মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ, পিডিএ ইত্যাদি নিয়ে অনর্থক রাত জাগে। আর দিন দুপুরেও তাদের ঘুম ভাঙ্গে না। ওরা ওদেরদের বাবা-মাকে ফাঁকি দিতে গিয়ে নীজেদের জীবনের লক্ষকে নড়বড়ে করে তুলছে!

জগলুর বাবা ইংরেজি শিক্ষায় বেশী গুরুত্ব দিত! সব ছেলে মেয়েকে ইংরেজি বেশী করে পড়তে বলতো। তিনি বলতেন, “ইংরেজি ও গণিতে যে ভাল সে তো কিং’! তাকে কেউ কোথাও আটকাতে পারবে ন! বাংলার পাশাপাশি তিনি সবাইকে ইংরেজি রাইম পড়াতেন নিয়মিত। সেখানেও সকালে জাগার বার্তা থাকতো।

বাড়ীর ছোটরা সমস্বরে সংগৃহীত ইংরেজি রাইম পড়তো,
The cock crows in the morn
To tell us to rise,
And he that lies late
Will never be wise”
বিখ্যাত দার্শনিক এরিষ্টটল সহ আরও জ্ঞানী-গুনীজন ঘুম থেকে সকালে জাগার উপর রচিত
উপরের ও নীচের চারটি লাইন নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া করেছেন। তবে নীচের লাইনগুলি বিশ্বব্যাপি মাত্রা পেয়েছে যখন আমেরিকান বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনায়ক বেনজামিন ফ্রান্কলিন ১৭৩৫ সালে রাইমটি তার ““Poor Richard’s Almanac” গ্রন্থে তুলে ধরেছেন! তারপর রাইমটি পড়ে নি এমন লোক কমই আছে!
For early to bed,
And early to rise,
Is the way to be healthy,
And wealthy and wise.

আশির দশকে অন্য সবার মত জগলুরও দেরী করে ঘুৃম থেকে জাগতে ভাল লাগতো। মা সেটা চরম অপছন্দ করতো। সকালে মায়ের এক ডাক, দুই ডাক, তিন ডাকের মাথায় জাগ্রত না হলে
জালি বেতের বাড়ি শপাং শপাং পিঠের উপর চলতো। তখন না জেগে আর উপায় ছিল না! মা বলতেন, “শয়তান আর বেত একসাথে থাকে না। বেত দেখলে শয়তান বাপ বাপ করে পালায়!” রাশভারী মা আদরের সময় আদর ও শাসনের সময় শাসন করতেন! অনেকটা
“শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করেন যিনি” এরকম! মা বেত চালাতেন প্রয়োজনে ন্যায়, সততা ও নিরেপক্ষতার সাথে! মায়ের মত তখনকার সমাজপতিরাও জনগণকে ভালবেসে সন্তানের মত সমাজে লাঠি চালাতেন বিচক্ষণতার সাথে! তারা সকলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “গান্ধারীর আবেদন” কবিতাটি হয়তো পড়েন নি তবে সঠিক বিচার করেছেন সদাজাগ্রত বিবেক বোধ থেকে! সেরা বিচার হলো “দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। “বর্তমানে সেই রকম সমাজপতি নেই বিধায়
সমাজটা এতো ক্ষয়িষ্ণু ও অসহিষ্ণু!

ছুটির দিনে অবশ্য সকালে জাগার কড়াকড়ি ছিল না! কিন্তু সকালে না উঠলে না-কি জ্ঞানী হওয়া যায় না! ছোট্ট চাচার ঐতিহাসিক এক অনবদ্য অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যে মুরগী জাগার সময় জাগতে শুরু করেছিল জগলু! মোরগের কুককুরুকো শুনে সে বহুদিন ঘুম থেকে সকালে সকালে উঠেছে শুধুমাত্র জ্ঞানী হবার জন্য! সে জ্ঞানী হবার অনেক চেষ্টাও করেছিল! সব চেষ্টা বৃথা করে সে অজ্ঞানীই রয়েই গেল! শুধু অজ্ঞানী হয়েই ক্ষান্ত হয় নি! কলেজ জীবনে সকালে মুরগীর কুককুরুকো ডাকে যথেষ্ট বিরক্ত হতো অসময়ে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য। ইচ্ছে করতো স্বৈরাচার সরকারের মত তাবৎ পৃথিবীর সকল মুরগীর মুখ টেপ পেচিয় বন্ধ করতে। যাতে টু শব্দ না করতে পারে।

একদিন জগলু ছাড়া সবাই মামাবাড়ি গিয়েছিল এক দিনের জন্য! মা যাবার আগে শাসিয়ে গিয়েছিল, “শোন জগলু, বাড়ী ছেড়ে কোথাও যাবি না। দুষ্টামি বাঁদরামি একদম করবি না। যদি কিছু একটা উল্টাপাল্টা কর তাহলে সব বেত তোর পিঠে ভাঙ্গা হবে!” ওরা ছলে যেতে না জেতে জগলুর কেমন স্বাধীন স্বাধীন লাগছিল! মনে হচ্ছে যেন বিজয় দিবস! কতক্ষণ দরজা বন্ধ করে খুশিমত নাচানাচি করেছিল। তারপর ভাবতে লাগলো কি করা যায়! কি করা যায়! সে শুনেছিল কোন এক আজব দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি ঘুম থেকে উঠে একবারে দুপুরের খাবার খেত। মা-বাবা- বোনেরা বাড়ী না থাকায় তারও সেরকম রাজকীয় খায়েশ হলো। সেই রকম একটা ম্যারাথন ঘুম দিবে। ঘুম থেকে একবারে উঠে দুপুরের খাবার খাবে। আফজালের গোষ্ঠীর ভাগিনা কাম বন্ধু হুমায়ূনকে বললো দু’চারজন বন্ধুকে খবর দিতে! পাঁচ ছয়জন বন্ধু মিলে ঘরের দুইটি মোরগ জবাই করে রাতে বারবিকিউ করবে! নবীনগর থেকে টিভি ভিসিআরও ভাড়া করে আনা হয়েছিল।

সিলসিলা কাপড় দিয়ে নবীনগর বাজারের অঙ্গশ্রী টেইলার্স দ্বারা সিলসিলা স্টাইলে বানানো শার্ট গায়ে দিয়ে নিজেকে অমিতাভ ভাবতে ভাবতে রাত জেগে সিলসিলা মুভি দেখা হল। শেষ রাতে সবাই এলোপাথাড়ি শুয়ে দিল ঘুম। খুব ভোরে ঘুম জমে যখন দই; সেই সময় মোরগের সমস্বরে কুককুরুকো ডাক শুনে সবার ঘুম ভেঙ্গে মেজাজ বিগড়ে গেল। জগ্লুর মান সম্মান শেষ হবার উপক্রম। রেগে ঘরের বাকি চারটি মোরগ জবাই করে সুখের ঘুম দিল। কি আছে জীবনে ঘুম ছাড়া। কিন্তু ভাগ্যে এতো সুখ সয় নাই। সকাল ১১টায় মা এসে সব শুনে অগ্নিমূর্তি ধারন করে রায়ট পুলিশের মত সবাইকে লাঠি চার্জ করা শুরু করলো। প্রথমে সবাই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। যখন পিঠে পটাস পটাস পিটুনি পড়তে লাগলো সবাই চাচা আপন প্রাণ বাঁচার মত যে যেদিক দিয়ে পারে ভৌ দৌড়ে নিরাপদ স্থান খাল পাড়ের বাঁশ তলায় গড়াগড়ি দিতে লাগলো!

শাওনাজ, ঢাকা।
১২ জুন, ২০২

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধসিংড়ার আয়েশ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নব নির্মিত ওয়াশ ব্লকের চাবি হস্তান্তর
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের সিংড়ায় রাস্তা নিয়ে দ্বন্দে সংঘর্ষ, আহত ৫, আটক ২

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে