জননী জন্মভূমি- স্বপন চক্রবর্ত্তী
একটি কবিতা আমি বারেবারে পড়ি, যখন একা থাকি তখন পড়ি, যখন ঘুম আসে না তখন পড়ি, যখন কিছু করার থাকে না তখন পড়ি, যখন কিছু করি আর তার মাঝে অবসর মিলে একটু -তখনও উচ্চারণ করি এই কবিতারই কোন পংক্তি। কেন, তাও জানি না !
জানি, এটি এমনই একটি কবিতা যা’ অনেকের জীবনের সাথে মিলে যায়, অনেকেই পড়েছেন কবিতাটি সন্দেহ নেই। কবিতাটির অংশ বিশেষ আলাদা করে আমি তুলে দিচ্ছি এরপরের অংশে! কবিতাটি লিখেছিলেন- প্রণম্য কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়- কবিতাটির নাম জননী জন্মভূমি !
‘ আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে
কখনো মুখ ফুটে বলিনি
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে
কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলা লেবু
শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভরে উঠতো।
আমার ভালবাসার কথা
মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারিনি।
হে দেশ, হে আমার জননী-
কেমন করে তোমাকে আমি বলি!
আমিও পারিনি বলতে কখনও, না আমার মা’কে, না আমার দেশকে – আমার জন্মভূমিকে – ‘মা’গো তোমায় ভালোবাসি’। আমার সমস্ত হৃদস্পন্দন দিয়ে তোমায় ভালোবাসি ! না, পারিনি কখনও বলতে । মায়ের সামনে নতজানু হতে পারি শতসহস্রবার – কিন্তু মুখফুটে মা’কে ভালোবাসার কথা বলা যায় না – কারণ পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসাই মায়ের ভালোবাসার কাছে, মায়ের মমতার কাছে খুবই ছোট দেখায়, খুবই ফিকে লাগে ! তাই হয়ত- মা তোমাকে খুব ভালোবাসি এইকথা বলা যায় না।
বরং অন্তরের শ্রদ্ধা দিয়ে, আন্তরিক সেবা দিয়ে, মায়ের সাথে অহর্নিশ মনে, বোধে যুক্ত থেকেই জানাতে হয় – মাগো তোমায় ভীষণ ভালোবাসি । শুধু মুখের ভালোবাসার দাম আসলেই কতখানি – যদি তার সত্যিকারের নজরানা নাই থাকে !
গতকাল আমার মায়ের পানের অভ্যাস ও নানান বিষয়ের অবতারণা করে একটি পোষ্ট দিয়েছিলাম । আমারই ওয়ালে। অন্য কোথাও শেয়ার করিনি । তাতেও নাকি কারও গা জ্বলে গেছে। কেউ কেউ হাসাহাসি করেছে – মায়ের পানের অভ্যাস নিয়েও কেউ পোষ্ট দিতে পারে ! শুনে অবাক যতখানি না হয়েছি, তার চে’ বেশী মর্মাহত হয়েছি। কারণ এই গা জ্বলে যাওয়া, হাসাহাসি করা মানুষগুলো কে আমি স্বজন বলেই চিনতাম -এখন বুঝছি, আসলে ভুল চিনতাম। মা’ তো আমারই । যার যার মায়ের প্রতি তার তার অনুভব সম্পূর্ণ নিজস্ব । আমারও তো তাই । আমার অনুভব আর কারও হবার উপায়ও নেই।
আমার জন্ম থেকেই আমি ভীষণ রোগা ছিলাম। নানান রোগে ভুগতাম। সেই চিররুগ্ন আমাকে নিয়ে আমার মা রাতের পরে রাত ঘুমাতেন না । বড় হয়েও দেখেছি, যখনই জ্বর, টাইফয়েড ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে থাকতাম – মা পাগলের মত করতেন। আমাকে সুস্থ করার জন্যে কত কি যে করতেন। কত নির্ঘুম রাত এভাবেই আমার জন্যে মা কাটিয়েছেন, তার কোন সীমা পরিসীমা নেই!
আমি আসলে সন্তান হিসেবে মায়ের জন্যে কিছুই করতে পারিনি- পারার কথাও নয়। কোন সন্তানই বলতে পারবে না – আমি মায়ের জন্যে এই কাজটি করেছি । মায়ের ত্যাগের সাথে কিছুই সমতূল্য হয় না, হতে পারে না। আসলে মা’কে নিয়ে লিখে আমি মায়ের প্রতি আমার অনুভবের কিছু ধরে রাখতে চাই – নিজের মত করে। আমি কোন লেখক, গল্পকার, কবি কিছুই নই। এমন কোন গুণই আমার নেই । তবু লিখি – কেন যে লিখি !
ঈশ্বরের ভক্ত যেমন নানাসুরে নানান পদে, নানা গানে ঈশ্বরের প্রতি তার ভক্তিকে প্রকাশ করে – আমার মা’কে নিয়ে লেখাও হয়ত অমনই কিছু । কারণ, সত্যিকার অর্থেই, আমার কাছে মা আমার প্রথম ঈশ্বর। যখন বাবা ছিলেন, তখনও বাবাকে নিয়ে এমন কিছু লেখা লিখেছি। সেই লেখাগুলোই এখন আমার ফিরে দেখার স্মৃতি। যারা পছন্দ করেন না -এই লেখাগুলো – তাদের তো আমার ওয়ালে না আসার অধিকার রয়েছে, আমাকে আনফলো, আনফ্রেন্ড করার অধিকার রয়েছে । তাই করুন – হাসাহাসি করে শক্তিক্ষয় করে কি লাভ!
আমার কাছে আমার জন্মভূমিও আমার মায়ের মতই। যে দেশ একদিন ছেড়ে এসেছি দুই যুগেরও আগে, সেই দেশটি আমি চিরকাল আমার বুকের মধ্যে নিয়ে চলি – তাই এর একটু ক্ষতিতেই আমার কলমে হাহাকার উঠে! এই অনুভব যারাই পরবাসে আছে তারা বুঝবেন শুধু, অন্য কারও এই অনুভব বোঝার ক্ষমতা থাকার কথা নয় ।
‘ যে মাটিতে ভর দিয়ে আমি উঠে দাড়িয়েছি
আমার দু’হাতের দশ আঙুলে তার স্মৃতি।
আমি যা কিছু স্পর্শ করি
সেখানেই হে জননী,তুমি।
আমার হৃদয় বীণা তোমারই হাতে বাজে।’
সেই মায়ের কথা আমি সহস্র কলমে লিখতে চাই, শত মুখে বলতে চাই । তিনি যে আমার জননী, তিনি যে আমার জন্মভূমি !