ঝরাপাতা ও দীর্ঘশ্বাস -পলি শাহীনা

0
324
Poly Shahina

ঝরাপাতা ও দীর্ঘশ্বাস

পলি শাহীনা

জীবন নামক খেলাঘরে জয়ী হওয়ার তাগিদে সময়ের সাথে তুমুল প্রতিযোগীতায় লিপ্ত আমি, অবসন্ন শরীরে দিনশেষে ঘরে ফেরার পালা। ক্লান্ত পা জোড়া যেন সামনে এগুতেই চাইছে না। প্রকৃতিতে এখন হেমন্তকাল, পাতা ঝরার দিন চলছে। এ সময় সবুজ প্রকৃতি ধূসর হয়ে উঠে। চৌদিকে কেমন যেন একটা যাই – যাই ভাব বইছে। প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বুক হু হু করছে। সবুজ পাতারা টুপটাপ ঝরে পড়ছে। বৈকালিক এমন বিষন্নতা একদম ভালো লাগে না।

এসময় শরীর, মন আরো দূর্বল লাগে। অবসাদ পেয়ে বসে। কুয়াশাবৃত চারপাশ জুড়ে যেন সেতারে করুণ সুর বেজে চলছে। আকাশের শরীর ঘণ মেঘে ঢাকা। চলতি পথে হঠাৎ মনে হলো কারা যেন আমার পা জোড়া জড়িয়ে ধরেছে, চলার পথ রোধ করে সামনে দাঁড়িয়েছে। তাকিয়ে দেখি বাতাসের সাথে উড়ে যাওয়া ঝরাপাতারা, ভীষণ কাকুতিমিনতি করে ধরেছে আমাকে তাদের কথা শোনার জন্য। কিন্তু আমার তো সময় নাই! আমি দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছি! ঝরাপাতাদের কন্ঠ ভেসে আসে ইথারে।

তারা করুন স্বরে বলছে,’যেদিন আমাদের বর্ণ ছিল, গন্ধ ছিল, যৌবন ছিল, স্পন্দন ছিল, সেদিনতো আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে! আসা যাওয়ার পথে রোজ আমাদের পানে অপলক তাকিয়ে থাকতে! কত নিশি জেগে আমাদের রুপ, রস, ছন্দে, মর্মরে তুমি শিহরিত হতে ! প্রাণভরে শ্বাস নিতে, আমাদের স্নিগ্ধতা ধার করে কবিতা লিখতে! আমাদের শীতল বাতাসে দু’চোখ বুঁজে তুমি সুখস্বপ্নে বিভোর থেকেছো! আমাদের সান্নিধ্য ছাড়া তোমার দম আটকে আসতো – মনে আছে? আজ আমাদেরকে কত সহজে দু’পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছো!

‘পাই পাই হিসেব কষে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো স্বার্থান্ধ আমি, ঝরাপাতাদের আহবানে কর্ণপাত না করে সামনে পা বাড়াতেই তাদের আর্তচিৎকারে আকাশ- বাতাস প্রকম্পিত হতে লাগলো। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম ঝরাপাতাদের কথোপকথন – ‘আমাদের একটু সময় দাও, দুটো কথা শুনো, তুমি এতটা আত্মকেন্দ্রিক কেন! আজ আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তাই বুঝি আমাদের কথাগুলো শুনার সময় পর্যন্ত নেই? ‘

রাগান্বিত আমি উল্টো ঝরাপাতাদের ধমক দিয়ে বলি, ‘ জীবনের গতি কারো জন্য কখনো থেমে থাকেনা! জীবন বহমান নদীর মতো। সময় ও নদীর স্রোত শুধু সামনে এগিয়ে যায়। আমাকেও সামনে এগিয়ে যেতে হবে! আমার অনেক কাজ বাকি ! একদম সময় নেই তোমাদের কথা শোনার ‘ বলেই দ্রুতগতিতে নিজ গন্তব্যের পথে সামনে পা বাড়াই। প্রতিদিনের চেনা পথ কিন্তু অচেনা অনুভূতি আর বুকে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে সম্মুখে এগোতেই পথের ধারে ফুটে থাকা মনোহর বুনোফুলদের মুগ্ধ হাতছানিতে থমকে দাঁড়ালাম। আহা! কী অপরুপ বুনোফুল!

রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে ক্ষণজন্মা অনিন্দ্য সুন্দর বুনোফুলদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। মন কেমন করা উদাসী হাওয়ায় আনন্দে দোল খাচ্ছিলাম বুনোফুল আর আমি। গভীর প্রণয় – গল্পে মশগুল বুনোফুল আর আমি, আচমকা যান্ত্রিক শব্দ পেয়ে ভয়ে আৎকে উঠি। আমরা নীরব দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে চেয়ে রই।বুনোফুলদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বাড়ীর মালিকের কাছে। তাই মালিক যন্ত্র হাতে ধেয়ে আসছে আঙিনায় ফুটে থাকা বুনোফুলদের উচ্ছেদ করার জন্য। বুনোফুলেরা যন্ত্রের শব্দ পেয়ে নিমিষেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়লেও, পরিষ্কার আমি দেখছিলাম মালিকের চোখেমুখে ঝলমলে আলো খেলছে।

অসহায় বুনোফুলদের পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ করার মত সাহস আমার নেই। কারণ আমি ভিতু। মালিকের সঙ্গে বুনোফুলদের পক্ষে স্বর তুললে বাড়ীর মালিক আমার উপর ক্ষেপে যাবে। অদরকারী বস্তু কোনভাবেই মালিক জিইয়ে রাখতে চাইবে না তাঁর মূল্যবান আঙিনায়। এটাই জগতের অতি স্বাভাবিক নিয়ম। প্রতিটি সম্পর্ক প্রয়োজনে তৈরি হয়। প্রয়োজন শেষে কেউ কাউকে আর চেনে না। মানুষ প্রয়োজনের পরিচর্যা করে, সম্পকের নয়।

স্বার্থপরের মতো এবারও আমি মাথা নিচু করে বুনোফুলদের পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলছি, আর নিজের মনে নিজে বুলি আওড়াচ্ছি,’ভালো থেকো বুনোফুল চললাম আজ আমি। বুকের গহীনে থাকবে তোমাদের মুখ জানেন অন্তর্যামী। ‘পুরো পথ পাড়ি দিয়ে শ্রান্ত আমি বাসায় এসে হাত- পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়ি, ভাবনার অতল সমুদ্রে ডুবে যেতে শুরু করি। এদিকে অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে একটু একটু করে পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ছে রাতের উষ্ণ বুকে। প্রকৃতির কোলে পিঠে বেড়ে উঠা আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো, ঝরাপাতা এবং বুনোফুলদের ফেলে ঘরে ফিরতে।

ঝরাপাতা, বুনোফুল ওরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? মানুষের জীবন আর ওদের মাঝে পার্থক্য কোথায়? প্রয়োজন শেষে মানুষও ঝরে যায়, চলে যায়? প্রশ্নবাণে জর্জরিত আমি দুলছি আর মনে হচ্ছে, আমি একটা শুকনো সুপারি পাতার ডালে বসে আছি, কেউ আমায় টানছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে দূরে- বহুদূরে, যেখান থেকে আর ফেরা হবে না আমারও, ঝরাপাতা- বুনোফুলদের মতো। জীবন একটি ফাঁদ বৈকি আর কিছুই নয়।

এই ফাঁদে সব মানুষ পড়ে, অতঃপর মরে।ঝরাপাতাদের দীর্ঘশ্বাস বুকে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছি। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যকার অন্ত্যমিল খুব-ই শক্তিশালী। ভাবছি ঝরাপাতাদের মতো আমিও তো একদিন ফুরিয়ে যাবো, এই মায়ার ফাঁদ পাতা ভুবনে। প্রয়োজন শেষে ঝরাপাতা ও বুনোফুলের মতো মানুষও অকেজো হয়ে পড়ে। মানুষের নিয়তি হয় তখন ঝরাপাতাদের দলে।

অনিশ্চিত জীবনের অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসে আঁধারের পাশ ঘেঁষে নিঃসীম শূন্যতায় তাকিয়ে আপনমনে ভাবছি- কবে কখন কোথায় আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে? কী জানি! ঝরাপাতা, বুনোফুলদের মত ছুঁয়ে থাকা কাছের মানুষগুলো একদিন আমাকেও ছুঁড়ে ফেলবে অন্ধকার গহ্বরে।

Advertisement
উৎসPoly Shahina
পূর্ববর্তী নিবন্ধক্ষতিপূরণ -কবি বনশ্রী বড়ুয়া‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধবড়াইগ্রামে ৪জন মাদকসেবী আটক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে