ঝড় – রত্না চক্রবর্তী’র ছোটগল্প

0
518
Ratna

 ঝড় – রত্না চক্রবর্তী’র ছোটগল্প

বাড়িউলির উপর মস্ত রাগ ছিল সুদেষ্ণার৷। ভিষণ অর্থ পিশাচ। নয় মাস ভাড়া এসেছে, প্রতি মাসে এক তারিখে ভাড়া দিয়েছে, এমন কি এই লকডাউনেও পয়লা এপ্রিল ভাড়া দিয়েছে। সে মাসে মাইনেটা পুরো পেয়েছে বিভাস। মে মাসে মাইনে পেয়েছে আদ্ধেক, তাও মাসের এগারো তারিখে, প্রাইভেট অফিস কালেকশন না হলে মাইনে দেবে কি করে? সব কাজ কম্ম যে বন্ধ। তা ও পাঁচ ছয় বার তাড়া দিয়ে গেছে বুড়ো। মাইনে পেয়েই আগে ভাড়াটা দিয়ে দিয়েছে… সারা মাসের জন্য তেল ডাল আর নুনটা কিনতে পেরেছে.. চালটা ক্লাব থেকে দিয়েছে, আলুও দিয়েছিল। কিন্তু ঘরে আর টাকাপয়সা নেই, একটা বিপদ আপদ হলে কি যে হবে…! বাচ্চাটাচ্চা নেই তাও রক্ষা, নইলে কি যে খাওয়াতো! এই তো চাকরির হাল! এই এককামরার ঘুপচি ঘর,বাড়িতে জল কষ্ট, কোনক্রমে তিন বালতি খাবার রান্নার জল পায়, বাকি টানতে হয় বাইরের থেকে। এই বাড়ির ছিরি, তারই এত তেল বাড়িওয়ালার। সামনের মাসে মাইনে না পেলে ভাড়া দেবে কি করে কে জানে!
সুদেষ্ণারা খুব নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার । স্বামী স্ত্রী দুজনে থাকে, আসা যাওয়া তেমন কেউ করে না, পাড়ার লোকেদের সাথে অল্পস্বল্প হাসি মুখের ভাব দূর থেকে। থাকার মধ্যে একটা সাদা হলুদ মস্ত বিড়াল আছে। না পোষা বিড়াল না। ভাড়া দেবার সময়ই শর্ত ছিল পোষা জীবজন্তু রাখা যাবে না, উঠোনের গাছের ফলফুল ছেঁড়া যাবে না। মহা ছোটলোক ভাবে সুদেষ্ণা, ছেলেপুলে কেউ থাকে না আসেও না তবু সব তাংড়ানো স্বভাব। ওই এককথা বলবে, “তোমরা সুস্থ সবল জোয়ান লোক তোমাদের হাতে পয়সা নেই আর আমরা বুড়ো-বুড়ি রোগগ্রস্ত চালাব কেমন করে ভাড়া না দিলে? এই আমগাছ আমার গিন্নির নিজের হাতে পোঁতা, ওর বড় মায়ার গাছ, ওসবে হাত দিও না বাপু, দুচারটে ফল ঝরে পড়লে নিতে পার কিন্তু ছিঁড়ে নেবে না। আর কিপটে বুড়ী ওত পেতে থাকে কি দিনে কি রাতে… একটা ফল পড়ল কি পড়ল না ঝাঁপিয়ে এসে নিয়ে যায়। উঠোনময় ঝরা পাতা পরিষ্কারের দায় সুদেষ্ণার, সে ভাড়ার সময়ই বলা আছে ” নির্ঝঞ্ঝাট দেখে ভাড়া দিলুম, চারদিক পরিষ্কার রেখো বাপু। ” মনে মনে ভাবে এমন আপদ গাছ থাকার থেকে না থাকাই ভালো। সময়টা এত খারাপ যাচ্ছে। এই সময় উঠোনে দাঁড়ালেও দুটো লোকের সাথে কথা কওয়া যাচ্ছে না। কেউই বাড়ির বার হচ্ছে না। তার বর বলে পৃথিবীর কোন মানুষটাই বা এখন ভালো আছে বলো? সুদেষ্ণা রাস্তার বেড়াল পুঁটিকে বড় ভালোবাসে। এখন মাছের কাঁটাকুটো নেই তাই ভাতডালই মেখে একগাল দেয়, আগে দিনে কাঁটা ভাত আর রাতে দুধ ভাত দিত। ওই একটাই অবলম্বন ওর। বাড়িওয়ালা বুড়ো আর তার বুড়ি বেড়াল কুকুর সইতে পারে না, তবে কিনা এ তো আর তার পোষা বেড়াল নয়, বাড়িতে থাকে না। শুধু দুবেলা খাবার সময় খেতে আসে একটু আদর খায়। তখন বুড়োরা ঘুমিয়ে পড়ে। আগে পুঁটি চা খেতে আসত, ওর জন্য বেশী দুধের চা করে দিত সুদেষ্ণা, এখন দুধ জুটছে না, আর লাল-চা পুঁটির রোচে না। বড় ভালোবাসে পুঁটিকে। তার একটা আপনজন এই পুঁটি।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এই আতংকের দিনের মধ্যেই এল সর্বনাশা ঝড় সুদেষ্ণার এই চল্লিশ বছরের জীবনে কেন তার বরের আটচল্লিশ বছরের জীবনে কলকাতায় এমন ঝড় দেখেনি। ভয়ে স্বামী স্ত্রী কেঁপেছে, উঠোনের ছোটগাছগুলো তবু একরকম বড় আমগাছটা যেন পাগল হয়ে গেছে, নয়ত ছোটবেলায় একবার মামার বাড়িতে দেখা ভূতে পাওয়া মানুষের মত তান্ডব করছে। মনে আছে সে দেখেছিল সেই ভূতে পাওয়া মানুষটাকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা যাচ্ছিল না, দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। গাছটা যেন অন্ধকারে ঠিক তেমনি মাথা নাড়ছিল, ডালপালা নেড়ে মাটির বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। হাওয়ার দাপট আরো বাড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক শব্দ করে গাছটা উপড়ে পড়ল উঠোনে, ভয়ে চিৎকার করে উঠল সুদেষ্ণারা। আর ঝড়ের মধ্যেও শোনা গেল উপরের বুড়ির বুকফাটা কান্না আর বুড়োর হাহাকার । কারেন্ট নেই, তুমুল বৃষ্টি আর হাওয়ার গোঙানির মধ্যে সেই আর্তচিৎকার যেন সুদেষ্ণার বুকের মধ্যেটা কাঁপিয়ে দিল। বুড়ি বলত এই গাছটা নাকি তার খোকার ষষ্ঠী পূজোর দিন পুঁতেছিল। এ গাছ তার ছেলের জুটি। গাছটায় বেশ আম হয়েছিল, অবশ্য কাঁচা। বিরক্ত লাগত উঠোন ঝাঁট দিতে, একটা ফলও পেত না কিন্তু বৃহস্পতিবার একটা আমডাল নিত লক্ষ্মীঘটের জন্য। উঠোনে অন্ধকার আরো গাঢ় করে পাহাড়ের মতো পড়ে আছে গাছের মৃত শরীর। খুব খারাপ লাগল সুদেষ্ণার।
ঝড়ের রাতও সকাল হল হাহাকারের মাঝে। উঠোনে জল থৈ থৈ। চারদিকে দুঃসংবাদ, মোবাইলে ফোন করা যাচ্ছে না,কারেন্ট আসে নি। বুড়িকে ধরে ধরে নিচে আনল বুড়ো, তার গুঁঙিয়ে গুঁঙিয়ে কান্না বুকে বাজল সুদেষ্ণার। ওদের পাম্পে জল ওঠে। আজ জল উঠবে না। কিপটে মানুষ বেশী জল ধরেও রাখে না। সুদেষ্ণারা কর্তা গিন্নি বালতি পাঁচেক জল তুলে দিল উপরে, ওরা অবশ্য বলে নি। সুদেষ্ণার মন খারাপ পুঁটিটা ভয়ে কদিন আসে নি। বিড়াল জলে ভয় পায়, আর তাদের উঠোনে এখনও জল জমে আছে।
তিনদিন কেটে গেছে কারেন্ট আসে নি, উঠোনে গাছের স্তুপ আর জমা জলেই বোধহয় ভয়ানক দুর্গন্ধ ছাড়ছে। বমি উঠে আসে, উঠোনের জানলা খোলা যাচ্ছে না। সন্ধ্যে পেরিয়ে কারেন্ট এল। বুড়োর চেনা লোক আছে, তারা সকালে এসে গাছ সরিয়ে আম গুছিয়ে নিয়ে যাবে বলে এসেছে। জলটা বেরিয়ে গেলে গন্ধটা কমবে। কাজের লোকেরা কিছুটা গাছ সরিয়েই হেঁকে বলল “এ হে.., একটা বিড়াল চাপা পড়ে মরেছে, তাই পচা গন্ধ। সুদেষ্ণার বুক ছাঁত করে উঠল, গন্ধটন্ধ ভুলে গোড়ালি ডোবা জলে ছপছপ করে ছুটে গেল… সেই হলুদ লোম… দলা পাকিয়ে গেছে কিন্তু এ তার পুঁটি… কেঁদে উঠল সুদেষ্ণা, ওর বর ছুটে এসে ওকে টেনে আনল। সুদেষ্ণার তিনটি বাচ্চা পেটেই নষ্ট হয়ে গেছে, বেচারা বড় বিড়াল ভালোবাসে, ওই তার আদরের বস্তু। উপর থেকে বুড়ো-বুড়ি নেমে এসেছে। কান্না মেশানো ঝাঁঝালো গলায় বুড়ি বলল ” ওই জন্যই তো বলি, মায়া বাড়াস নে, মায়া বাড়াস নে, বুকে বড় ব্যথা বাজে যখন ভালোবাসার ধন ছেড়ে চলে যায়… ” কি এক হাহাকার ধ্বনিত হয় তার কথায়। কান্নায় মাখামাখি মুখটাকে সুদেষ্ণার নাইটিতে মুছিয়ে দিতে না পেরে নিজের আঁচল দিয়েই মুছিয়ে দেন কাঁদতে কাঁদতে। ব্যথার নদী, শোকের নদীতে মিশে যায়। পাম্পের শব্দ হচ্ছে, উঠোনের জমা জল নামছে। উঠোনে এখন দুটি মৃতদেহ আমগাছ আর পুঁটির… সামনে দুই মনুষ্য পরিবার শোকে কাতর।।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধকত মানুষকে পেশা বদলাতে হবে…? আমীন আল রশীদ
পরবর্তী নিবন্ধঅশ্বখুর – কবি জুনান নাশিত এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে