নাটোরে বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে জীবন চলে সবজি খালার

0
300
Life
নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোরকন্ঠ:  নাম তাঁর হাজেরা বেগম । বয়স ৩৬ বছর ।পরনে ময়লা তেলচিটে কাপড়। ভ্যানবোঝাই হরেক রকমের কুড়িয়ে আনা শাকসবজি। এই ভ্যান চালিয়ে তিনি যান নাটোর শহরের বাজারে, পাড়া-মহল্লায়। কখনো ঠেলে ঠেলে এপাড়া–ওপাড়ায় ঘুরে বেড়ান। বিক্রি করেন শাকসবজি। কম পয়সায় পাড়ার লোকে তাঁকে সবজি খালা বলে ডাকে। গত ১২  বছর ধরে শাকসবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। প্রথমে মাথায় করে শাকসবজির ডালা নিয়ে পায়ে হেঁটে পাড়া মহল্লায় ঘুরে সবজি বিক্রি করতে খুব কষ্ট হতো ।।
বছর চারেক আগে এক ব্যক্তি দুই হাজার টাকা দান করেছিলেন ।আর নিজের কাছে ছিল এক হাজার ।এই তিন হাজার টাকায় পুরাতন লক্কড় ঝক্কড় ভ্যানটা কিনেছিল ।আর সেটা নিয়েই জীবন সংগ্রামে নামলেন স্বামী পরিত্যক্তা হাজেরা বেগম। প্রতিদিন আয় হয় ২০০ থেকে ৩০০টাকা । সেটা দিয়েই কোন মতো চলে অশীতিপর বৃদ্ধ মা এবং তিন শিশু সন্তান সহ পাঁচ সদস্যের সংসার ।
নাটোর সদর  উপজেলার একডালা গ্রামের মৃত দলি উদ্দীন মোল্যার মেয়ে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকেন   প্রয়াত বাবার বাড়িতে। ভিটেমাটি ছাড়া সহায় সম্পত্তি বলতে কিছু নেই।
হাজেরা বলেন, ছোট বেলায় বাবা মারা যায় । বড় সন্তান হিসেবে ১১ বছর সংসারের হাল ধরতে রাজমিস্ত্রীর যোগালদারের কাজে যোগদেন ।  ২০  বছর আগে সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সেকেন্দার তখন ভ্যান চালাতেন। তাঁদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে হয়। এরপর প্রায় এক যুগ আগে স্বামী আরেকটি বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। হাজেরা কিংবা তাঁর সন্তানদের কোনো খোঁজখবর নেন না। ভরণপোষণের খরচও দেন না।ছেলে-মেয়েকে নিয়ে হাজেরা পড়েন অকূলপাথারে। কী খাবেন, কী পরবেন—এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। এর মধ্যে একমাত্র ভাইটি মাকে ফেলে বউকে নিয়ে আলাদা বৃদ্ধ হয়েছে । মায়ের সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন করে দেয় ।মা  অসুখে পড়ে। টাকার অভাবে ঠিক মতো চিকিৎসা করাতে পারেননি। রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়ে মেরুদন্ডে ব্যথা পাওয়ায় সে কাজেই তাকে কেউ নিলোনা । ছোট তিনটি বাচ্চা আর বিছানাগত বৃদ্ধ মায়ের অসহায় মুখ দেখে তিনি খুব কষ্ট পান। এরপর ভাবেন, কিছু একটা করতে হবে । নিজের ও ছেলে-মেয়েদের মুখে অন্ন জোগাবেন। আর কাউকে  দেবেন না। এই শুরু শাকসবজি বিক্রির কাজ। শুরুতে জড়তা ছিল, ছিল লোকলজ্জার ভয়। লোকে বাঁকা চোখে তাকাতেন। কিন্তু তিনি থেমে যাননি।হাজেরা আরও বলেন, প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। এরপর নিজের ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এলাকার খালবিল, পুকুর থেকে শাপলা, কলমি, হেলেঞ্চা এবং বাগান থেকে কচু, কচুর ডগা, কচুর লতি, ঘাটকোল, থানকুনি পাতা সংগ্রহ করেন। এরপর ভ্যান চালিয়ে এসব নিয়ে প্রথম যান নাটোর শহরের  ষ্টেশন বাজারে কিংবা নিচাবাজারে। সেখানে কিছু সময় বিক্রি করেন। এরপর যান নাটোর শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে। এত দিনে বাসাবাড়ির মানুষগুলোর মুখ ও নাম তাঁর মুখস্থ। এসব চেনা মুখ দেখে তাঁর ভালো লাগে। বিশেষ করে লোকে যখন তাঁকে সবজি খালা বলে ডাকে, তখন তিনি সব দুঃখ ভুলে যান। মন তাঁর আনন্দে ভরে ওঠে। কিছুদিন যাবৎ মেরুদন্ডের ব্যথাটা বেড়েছে । তাই লক্কর ঝক্কর ভ্যানটা প্যাডেল মেরে চালিয়ে শহরময় ঘুরতে পারেননা । শহরের পাড়া মহল্লায় যেতে না পারাই আগের মতো বেঁচাকেনায় হচ্ছেনা ।
গণমাধ্যমকর্মী মামুন জানান বৃহস্পতিবার দুপুরে নাটোর শহরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে । দুপুরে বৃষ্টির মাত্রাটা প্রবল হলো। সবাই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। কেউ দোকানে কেউবা বাসাবাড়ির দিকে আশ্রয় নিচ্ছে । সাবাই যখন নিজেকে রক্ষায় ব্যস্ত তখনও ভারি বৃষ্টিতে ভিজে পামহীন চাকার ভ্যানে আর ঝংধরা চেইনের প্যাডেলে সর্বশক্তি দিয়ে ভ্যান চালিয়ে সবজি বিক্রি করছেন সবজি খালা হাজেরা বেওয়া । বৃষ্টির পানি আর চোখের পানি মিলে মিশে একাকার সবজি খালা । দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে এখনো চাল ডালের টাকাও উঠেনি । তিনি বাজার নিয়ে গেলেই যে মা আর সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতো পারবে ।অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তিনি চোখে অন্ধকার দেখছি ।
সবজিখালা বলেন  এখন বৃষ্টিতে ভিজে আর রোদে পুড়ে জিবনের চাকা ঘুরাতে হচ্ছে। তাও আবার বাসা বাড়িতে সবজি বিক্রির সময় সবাই কাছে আসেনা। দুর থেকেই সব করতে হয়। করোনা প্রায় জিবনটাকে শেষই করে দিলো।’ যদি একটা মেশিন লাগানো পুরনো ভ্যান কিনতে পারতাম । তাহলে শহরময় ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রী করে জীবন বাঁচাতে পারতাম । অভাবের কারণে ছেলেটাকে লেখাপড়া বন্ধ করে টাইলস মিস্ত্রীর হেলপারের কাজে দিয়েছেন।
সরকারি-বেসরকারি-ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেক উদ্যোগ নেওয়ার পরও বহু মানুষ সহায়তা কার্যক্রমের বাইরে রয়ে গেছেন মন্তব্য করে তেবাড়িয়া ইউপির সাবেক মেম্বার রহমত আলী বলেন, সত্যিই সবজি খালা অনেক অসহায় । কিন্তু উদয়াস্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরও তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় করেন । কোরআন শরীফ তেলোওয়াত করেন । সংগ্রামী নারীর প্রতিকৃতি সবজিখালা কে মেশিন লাগানো একটি ভ্যান দেয়া গেলে পরিবারের সদস্যরা বেঁচে যেত ।
সমাজকর্মী মারুফ আরাবিয়া বলেন আমার দৃষ্টিতে সবজিখালা নাটোর জেলায় সংগ্রামী নারীর প্রতিকৃতি । অনেক কষ্ট করে সৎভাবে অজীবন হালাল উপার্জন করে এসেছে ।, ‘এত কষ্টের জীবন, সবজি খালার আল্লাহ নিশ্চয়ই মুখ তুলে তাকাবেন।তিনি তো কারও কাছে ভিক্ষা চাই না। শাকপাতা কুড়িয়ে বিক্রি করে । তাঁর খুব বেশী চাওয়া–পাওয়া নেই। একটি মেশিন চালিত ভ্যানগাড়ী। সমাজের সহৃদয়বান ব্যক্তিদের সবজি খালার পাশে দাঁড়ানো উচিত । সমাজের সত্যিকার জয়িতা তো হাজেরা বেগম ।
Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধসংবাদ প্রকাশের পর বাগাতিপাড়া হাসপাতাল পেলো নতুন তিন চিকিৎসক
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের গুরুদাসপুরে লাল সবুজের বৃক্ষরোপন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে