দেবাশীষ সরকার : পাঁচু কাকা ঘরে বন্দি থাকিয়া অস্থির হইয়া উঠিয়াছে। এতদিন মানুষ ঘরে থাকিতে পারে! অসুখ-বিসুখে ভয় কোরিয়া কতদিন মানুষ ঘরে থাকিবে? মানুষের কি কোন কাজ কাম নাই? চাহিয়া চিন্তিয়া কাকিমা আর সংসার চালাইতে পারিতেছে না। দুইবেলা কাকিমা কথা দিয়া কথা শুনাইয়া পাঁচু কাকাকে আছড়াইয়া আছড়াইয়া কাপড় ধোয়া করিতেছে। এরইমধ্যে হাটি হাটি পা পা করিয়া দুর্গাপূজা চলিয়া আসিলো।
কিন্তু সরকার বাহাদুর যতই ছোট আঙ্গিকে স্বল্পমাত্রায় পূজা-অর্চনা করিতে বলুক না কেন, পাড়ার চাঁদা তোলার বাহিনী চাঁদা আদায় দেখিয়া তা বোধ হইতেছে না। পাঁচু কাকা প্রতিবছর ৫০১ টাকা বাড়ির পাশের মন্দিরে পুজোর চাঁদা প্রদান করিত। কিন্তু এবছর চাঁদা উত্তোলন করা ছেলে ছোকররা আসিয়া এক হাজার এক টাকা চাঁদা দিতে হইবে বলিয়া গিয়াছে।
কাকিমার কোন কথাই শুনেছে চাহে নাই। জিনিসপত্রের দাম নাকি সব বহু করিয়া বাড়িয়া গিয়েছে। চারদিকে বন্যার সব ডুবিয়া গিয়াছে, তাই নাকি পূজার খরচ বাড়িয়াছে। কাকা বুঝিয়া পাইতেছেনা পূজার খরচ বাড়িলো কি করিয়া? অনেকদিন তারপর নির্ধারণ করলো না খরচ বেশি হইতে পারে।
তাও পাঁচু কাকা মনে মনে ভাবিল একটিবার চাঁদা তোলা ছোকরাদের বলিলে হয়। মোড়ের দোকানের চা পান রত ক্যাশিয়ারকে ডাকিয়া বলিল- ক্যারে বা নিপেন, আমার মতো গোরিব ম্যানসেক হাজার টেকা পুজার চাঁদা দেওয়া লাগবি ক্যা? তা এই কথা শুনিয়া নৃপেন রে রে করিয়া উঠিলো। করোনার মদ্যে এসব কোতা কয়্যা কুনো লাভ নাই। নতুন কোরে প্যান্ডেলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখার নিয়ম হছে , মাস্ক পরে আসার জোন্যে নতুন সাইনবোর্ড লাগাতে হছে।
সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার জন্যে ড্রাম সেটের ব্যবস্থা করা হছে। এসব কোরতে প্রচুর টেকা খরচ হছে। নতুন কোরে মাইকের ব্যবস্থা কোরতে হছে তাতে বারবার কোয়া হোচ্চে সামাজিক দূরত্ব বোজায় রাখার জন্যে। আর সব খরচ তো ঠিকই আছে। প্রসাদ দিতে তো মানা করিছে। আমরা কবে প্রসাদ দিছি তা মনে পড়িচ্চে না। তবে হ্যাঁ মাঝরাতে কমিটির লোকদের জন্যে পাঠা দিয়ে ভুরি ভোজের আয়োজন কোরা হোচ্চে যথারীতি। তাই খরচ কম হোবিন্যা এবছর আরো বার্বি।
কাকা ভাবিতে লাগিল, বন্যায় বাঁশঝাড় ডুবিয়া গিয়াছে, অতএব বাঁশের দাম বাড়িয়েছে, চারদিকে ধান ডুবিয়া গিয়াছে অতএব ঠাকুর বানাইবার খরকুটোর দাম বাড়িয়ে গিয়েছে। আর জিনিসপত্রের দামের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে খরচ বেশি পড়িবে। কিন্তু দারিদ্র্যের আবার পূজা কিসের? চাঁদা দিয়ে পূজা করিতে পারিব না। যেখানে ঘরের ভাত জোটানোই সমস্যা দুই বেলা খাবার সংগ্রহ করতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত সেখানে আনন্দ-ফুর্তি দিয়া কি করিব। কিন্তু কাকার কথা কে শোনে। কাকিমার নতুন শাড়ির বায়না, বাড়িতে আত্মীয় কুটুম্ব আসিবে তাহার জন্য মুড়ি মুড়কি নাড়ু বড়া তৈরি করিতে হইবে।
কিন্তু কাকা অর্থের যোগান কোথায় পাইবে। শুনিতেছে স্থানীয় এমপি নাকি শাড়ী বিতরন করবে তা মুখ ঢাকিয়া সেখানে কাকা লাইনে দাঁড়াইবে কিনা ভাবিতেছে। তবে এখন সাহায্য চাইতে গেলে লাইনে দাঁড়াতে ভয় পাইবার কিছু নাই। বেশ বড়সড় মাস্ক দিয়া মুখ ঢাকিয়া দিলে, আর অপরিচিত পুরাতন কাপড় পড়িলে কেহ চিনিতে পারিবে না। এই ভরসা করিয়া কাকা ভাবিলো নেতাদের বাড়ির সামনে দাঁড়াইয়া পড়িবে কিনা। তবু ১০০ টাকা আর একখান কম দামি শাড়ি পাওয়া যাইত।
এইসব ভাবিতে ভাবিতে সুরোজ বাবুর চেম্বার পার হইয়া কাকা আশ্বিন বাউলের দোকানে আসিয়া বসিলো। দিনের বেলায় দলে দলে লোক পূজা দেখিতে আসিতেছে। এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে রাত্রে পুজা দেখা বন্ধ করিয়াছে সরকার। যতই স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা আর মুখে মাস্ক পড়িতে বলুক না কেন পূজায় ইহা সম্ভব নহে। আনন্দ বাঁধ ভাঙ্গিয়াছে যুবক-যুবতীরা সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হইয়া একে অপরের শহিত আনন্দ উচ্ছ্বাসে মাতিয়া উঠিয়াছে, মুখে মাস্ক পড়িলে তাহাতে ব্যত্যয় ঘটে।
সরকার এসব বুঝিয়াও না বুঝিবার ভান করিলে চলিবে কেন? এক অটোতে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করিয়া সকলে মিলিয়া পুজো না দেখিলে তাহাতে আনন্দ হইবে কেন? বড় বড় সাউন্ড বক্সের উৎকট যন্ত্রসংগীত না বাজাইতে পারিলে আমাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস সম্পন্ন হয় না। সন্ধ্যা রাত্রে মুখ দিয়ে ভুরভুর করিয়া একটু আকটু নেশাও গন্ধ না বাইর হইলে ছেলে ছোকরাদের পুজো পুজো মানেই হয়না। তাই সরকারের এসব ক্ষেত্রে কোন বারন বালাই ইহারা কেন মানিয়ে বরং মানিবে না এটাই স্বাভাবিক।
রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে, নেতাদের রাজনৈতিক প্রোগ্রামে, দান-খয়রাত অনুষ্ঠানেকোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানে না হৈলেও পূজার ক্ষেত্রে কেন এইসব নিয়ম হইল তাহা লইয়া আন্দোলনের ডাক দেওয়া যাইতে পারিতো। কিন্তু ধর্মীয় সংগঠন গুলো অতিমাত্রায় সরকারি পাচাটা তাই পাঁচু কাকা এসব ভাবিয়া ভাবিয়া চুপচাপ থাকিবে এই পন করিলো। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলিয়া কোন লাভ নাই। পূজা উপলক্ষে আর কারো লাভ হোক বা না হোক সরকারের লাভ হৈয়াছে। কোন মন্দিরে এইবার আনসার নিয়োগ করিতে হয় নাই পুলিশ নিয়োগ করিতে হয় নাই অতএব তাহাদের পেছনে খরচ বাঁচিয়া গিয়াছে।
এসব ভাবিতে ভাবিতে পাঁচু কাকা পূজামণ্ডপে দিকে অগ্রসর হইল। আর ভাবতে লাগলো কেমন করে করোনাকাল কাটিবে। কবে দেশে শান্তি ফিরবে। এমন সময় সুরুজ বাবুর সঙ্গে দেখা, সুরুজ বাবু চিৎকার করিয়া উঠিয়া বলিলোঃ তা পাঁচু পূজা কিরম দেখিচ্যাও? কাকা বলিলো কি আর কবো ভাই, একজন একখান পাঞ্জাবি উপহার দিছিলো তাও গায়ে হলো না। এখন কি করে পূজা দেখপো তাই ভাবিচ্চি। আর পূজার আর কি দেখপো, লাফালাফি আর চিল্লাচিল্লি।
কুনো ভয় ডর নাই। সবাই খালি মাস্ক পকেটে লিয়ে ঘুরিচ্চে। মুখে লাগালে নাকি সুন্দর বদন ঢ্যাকে যাবি। এখন দশমীর সময় কি হয় সেটাই দেকার বিষয়। শুনতে পাচ্ছি মেথর পট্টি ভাটি নাকি খুব জমজমাট। সেইসব বিক্রি হচ্ছে মাল। খাবি আর লাচপি, পরের দিন শুনতে পাবো মরিচে দুই চারডে। জীব মরবি আপন দোষে কী করবি হরিদাসে।
Advertisement