পূর্বঘোষিত মৃত্যুর বৃত্তান্ত- ফাল্গুণী মুখোপাধ্যায়

0
519
Falguni

লকডাউন – ছিন্ন চিন্তা ৯
পূর্বঘোষিত মৃত্যুর বৃত্তান্ত- ফাল্গুণী মুখোপাধ্যায়

ওরা কেন ইষ্পাতের রেল লাইনকে বালিশ মনে করে ওখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ? রেলের লাইন কি ঘুমনোর যায়গা ! মালগাড়ির চাকা ১৬জন পরিযায়ী শ্রমিককে পিশে মারার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর এমন প্রশ্ন ভাসিয়ে দিয়েছেন কেউকেউ । চরম অসংবেদনশীলতায় ঠাট্টা করেছেন সহ-নাগরিকদের কেউকেউ । নিজভূমে ফিরতে চাওয়া ১৬জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু তাদের কোন বেদনা যাগায়নি, কোন ঘৃণা যাগায়নি, তারা মানুষের মৃত্যু থেকেও ঠাট্টার রসদ ঠিক খুজে নিলেন । মাত্র চারঘন্টার বিজ্ঞপ্তিতে জারি হয়ে হয়ে গেল ভারতজোড়া লকডাউন । পরিযায়ী শ্রমিকরা যাবেন কোথায়, যাদের মাথায় নিশ্চিত ছাদ নেই কোন, মজুরি নেই, যাদের দুবেলার খাদ্য মজুত থাকে না । সড়কপথে পুলিশের লাঠির ভয়ে তারা বেছে নিল রেলের লাইন ।
একটা হিসাব জানাচ্ছে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঘরে ফিরতে আকুল শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৬.৬ লক্ষ আর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সংখ্যাটা পৌছালো ১৪ লক্ষে । সুপ্রিম কোর্টে ১২ই এপ্রিল সরকারের হলফনামায় স্বীকার করা হয়েছিল যে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ঠ আশ্রয়শিবির করা যায় নি । তাহলে তারা ঘরে ফেরার জন্য হাটবেন না কেন? অমানবিক লকডাউনের ৪৭দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর সরকার তাদের জন্য ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে । ফিরছেনও তারা অনেকে । সারা দেশকে তালাবন্দী করার আগে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরে যাওয়ার জন্য দুএকদিন সময় তো দেওয়া যেত । মার্চ মাসেই যখন দিল্লি থেকে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক হাঁটা শুরু করলো, আমাদের নাড়িয়ে দিল তখনও সরকার কিছু বন্দোবস্ত করতে পারতো । কিন্তু করেনি । বিশ্বাস করার কারণ আছে যে কর্পোরেট লবি, রিয়েল এস্টেট আর হোটেল লবির চাপ ছিল পরিযায়ীদের ফিরে যাওয়া আটকাতে । একটা প্রচার সুচতুরভাবে হয়েছে যে পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজ গ্রামে ফিরলে সংক্রমণ অনেকগুন বেড়ে যাবে । তাদের মনে রাখা দরকার যে দেশে প্রথম সংক্রমণ ছড়ায় জামাই আদর করে বিমানে বিদেশ থেকে অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনার পর থেকেই ।

ঘরে ফিরতে চাওয়া মানুষদের মৃত্যুমিছিলের সামান্যই মাত্র আমরা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখছি । শুরু হয়েছিল মার্চের শেষ সপ্তাহে দিল্লির সেই ডেলিভারি বয় রনধীর সিংকে দিয়ে যে হেঁটে বিহারে তার গ্রামে ফিরতে চেয়েছিল, পারেনি । তেলেঙ্গানার লঙ্কাক্ষেতের ১২ বছরের কিশোরী শ্রমিক জামলো মাকদেমও পারেনি, বাকি ছিল আরো একঘন্টার পথ । বাঙ্গালুরু থেকে ৩০০ কিলোমিটার পথ হেটে রাইচুরে ফিরতে চেয়েছিল ২৯ বছরের গঙ্গাম্মা । অভুক্ত গঙ্গাম্মা বেল্লারি পর্যন্ত আসতে পেরেছিল । ঔরঙ্গাবাদে ১৬জন শ্রমিকের মৃত্যুর পরের দিন মধ্যপ্রদেশে ট্রাক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল ৫জন পরিযায়ীর । অপরিকল্পিত অমানবিক লকডাউন আরো কত রকমভাবেই না অসহায় মানুষের জীবন কেড়ে নিল, এই নিষ্ঠুরতার কোন সীমা নেই । তামিলনাড়ুর একটি বাস স্ট্যান্ডের পাশে এক অশিতিপর বৃদ্ধা পথচলতি, বাসযাত্রীদের দেওয়া খাবারে দিন গুজরান করতেন । বাস নেই, যাত্রীও নেই । বৃদ্ধা মারা গেলেন অনাহারে । তিনিও তো লকডাউনেরই বলি । তেলেঙ্গানার এক প্রসূতি ছটি হাসপাতাল ফিরিয়ে দেয় । কোভিড নেগেটিভ জানার পর এক হাসপাতাল তাকে ভর্তি নেয় । বিলম্বের জন্য জটিলতার কারণে মৃত্যু হয় সদ্যজাতর । পরে মৃত্যু হয় মেয়েটিরও । এই রকম অসংখ্য মর্মান্তিক মৃত্যুর নিয়ে এসেছে অপরিকল্পিত লকডাউন ।

তিন গবেষক সম্প্রতি লকডাউন জনিত কারণে মৃত্যুর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন তা থেকে আমরা জানতে পারছি যে গত ৯ই মে পর্যন্ত লকডাউন জনিত মৃত্যুর সংখ্যা ৩৮৩ । তাঁদের প্রতিবেদন অনুযায়ী মৃত্যুর কারণ অনাহার ও আর্থিক বিপর্যয় – ৪৭, হাটা ও দীর্ঘ লাইনে দাড়ানোর ফলে পরিশ্রান্ত হয়ে – ২৬, নিজ রাজ্যে ফেরার পথে ট্রেন ও সড়ক দুর্ঘটনায় – ৭৪, পুলিশি অত্যাচারে – ১২, চিকিৎসা ও সহায়তা না পাওয়া বয়স্ক ও অসুস্থরা – ৪০, সংক্রমণের ভয় ও একাকীত্বের অবসাদে আত্মহত্যা ৮৩ ।

প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের কাছে ভাষণ দিলেন, করনা আক্রান্ত মৃতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানালেন কিন্তু অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুমিছিল নিয়ে একটি সমবেদনার কথাও শোনা গেল না । বিশিষ্ট সাংবাদিক অমানবিক লকডাউন-মৃত্যুকে সঠিকভাবেই বলেছেন ‘অঘোষিত মৃত্যুর বৃত্তান্ত’।

এবং এখানেই শেষ নয়, এই মৃত্যুমিছিল চলতেই থাকবে, আমরা জানতেই থাকবো আরো অনেক ‘অঘোষিত মৃত্যুর বৃত্তান্ত’ ।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধআই লাভ নিউইয়র্ক !- পলি শাহিনা
পরবর্তী নিবন্ধসিংড়ায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৫০ টি পরিবারকে মানবিক সহায়তা প্রদান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে