মহান ঔপন্যাসিক ল্যেভ তলস্তয় – স্বকৃত নোমান

0
247

মহান ঔপন্যাসিক ল্যেভ তলস্তয় – স্বকৃত নোমান

মহান ঔপন্যাসিক কাউন্ট ল্যেভ তলস্তয়ের মদ, নারী ও জুয়ার প্রতি যেমন গভীর আসক্তি ছিল, তেমনি তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল ঔপন্যাসিক ইভান তুর্গেনেভের সঙ্গে। দীর্ঘ সতের বছরের বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব ছিল ভালোবাসা ও ঘৃণা, আকর্ষণ ও বিতৃষ্ণা, মঙ্গলেচ্ছা ও বৈরিতার টানাপোড়েনে ভরা। তলস্তয়ের লেখালেখির ব্যাপারে অনুপ্রেরণাদাতার ভূমিকায় ছিলেন তুর্গেনেভ। ১৮৫২ সালে তলস্তয় রুশ গোলান্দাজ বাহিনীতে চাকরি করছেন। এই বছরের জুলাই মাসে তিনি ‘শৈশব’ গল্পটি চূড়ান্তরূপে লেখা শেষ করলেন। অক্টোবর মাসে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে প্রকাশিত নিকোলাই নেক্রাসফ্ সম্পাদিত ‘সভ্রেমিয়েন্নিক্’ পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশিত হলো। তবে স্বনামে নয়, ল. ন ছদ্মনামে। গল্পটি পড়ে ঔপন্যাসিক ইভান তুর্গেনেভ সভ্রেমিয়েন্নিক সম্পাদক নেক্রাসফ্কে লিখলেন, ‘এ এক নিশ্চিত প্রতিভা। ওঁকে লিখে যেতে উৎসাহিত করো, যাতে লেখা চালিয়ে যান। তাঁকে জানিয়ে, হয়তবা তাঁর ভালো লাগতেও পারে যে, আমি তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছি, অভিনন্দন ও করতালি দিচ্ছি।’ শুধু তাই নয়, তলস্তয়ের বোন মারিয়া, যার প্রতি তুর্গেনেভ আসক্ত ছিলেন, তাকে পত্রিকার রচনাটি দেখিয়ে লেখক ল. ন সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করলেন তুর্গেনেভ।

এরই মধ্যে প্রায় তিন বছর কেটে গেল। ১৮৫৫ সালে তলস্তয় লিখলেন ‘বনানী ধ্বংস’ গল্পটি। উৎসর্গ করলেন তুর্গেনেভকে। ল. ন ছদ্মনামেই ছাপা হলো সভ্রেমিয়েন্নিক পত্রিকায়। উৎসর্গ দেখে ও গল্পটি পড়ে উৎফুল্লা তুর্গেনেভ এক চিঠি লিখলেন তলস্তয়কে, যেখানে লেখা ছিল, ‘আপনার অস্ত্র তো কলম, তরবারি নয়।’ কোনো ছুটিছাটায় সাক্ষাতের আমন্ত্রণও জানালেন তলস্তয়কে। একই বছরের নভেম্বরে সেন্ট পিটার্সবার্গে এলেন তলস্তয়। হোটেলে মালপত্র রেখেই চলে গেলেন তুর্গেনেভের ফ্ল্যাটে। প্রসন্ন, রুচিবান, অভিজাত এবং প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রুশ লেখক তুর্গেনেভ তাঁর লাইব্রেরির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে তলস্তয়কে স্বাগত জানালেন। দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন। সেদিন থেকেই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপিত হলো।

সে-বার তুর্গেনেভকে কেন্দ্র করে সভ্রেমিয়েন্নিক গোষ্ঠীর সব কবি সাহিত্যিকের সঙ্গেই আলাপ পরিচয় হলো তলস্তয়ের। যে কয় মাস তিনি পিটার্সবার্গে ছিলেন প্রচণ্ড উদ্দামভাবে সময় কাটালেন। সতীর্থ সাহিত্যসেবীদের সঙ্গে তর্ক, মতানৈক্য ও পুনর্মিলন ঘটছে বারবার। সুরা, নারী ও জুয়া―এই তিনে নিমজ্জিত হয়ে আছেন। এক পর্যায়ে হোটেল ছেড়ে তুর্গেনেভের বাসায় উঠে এলেন। তুর্গেনেভ তো রীতিমতো বিরক্ত। কিন্তু অতিথিকে কিছু বলতেও পারছেন না। একদিন তিনি তরুণ কবি ফিয়েৎকে তলস্তয় সম্পর্কে বলেই ফেললেন, ‘সেভাস্তোপলের ব্যারাক থেকে সোজা এখানে এসেছে, আমার সঙ্গে এখন আছে, আর তখন থেকেই মাতলামিতে ডুবে আছে। সারা রাত হল্লা, জিপসি, আর জুয়ো খেলে রাত কাটিয়ে বিছানায় শোয়ামাত্রই মড়ার মতো ঘুম। ওঠে বেলা দুটোর সময়। প্রথম প্রথম রাশ টানতে অনেক চেষ্টা করেছি। এখন আশা ছেড়ে দিয়েছি।’ তুর্গেনেভের সঙ্গে তলস্তয়ের তখন অজস্র প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ চলছে এবং সবসময়ই তর্কাতর্কি লাগছে। কোনো বিষয়েই দুজনের মত এক রকম নয়। মতান্তর থেকে মনোমলিন্যও হচ্ছে।

১৮৫৬ সালে মে মাসে চিকিৎসার অজুহাতে বিদেশযাত্রার জন্য এগারো মাসের ছুটি নিলেন তলস্তয়। মস্কো যাওয়ার পথে তুর্গেনেভের ‘জনৈক ফালতু লোকের দিনপঞ্জি’ পড়তে পড়তে মহা বিরক্ত। নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখলেন, ‘জঘন্য রকমের মিষ্টি, লোভনীয়, ধূর্ত এবং নখরবাজ।’ বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক তুর্গেনেভ সম্পর্কে তাঁর মনোভাব দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। মস্কো থেকে চলে এলেন জন্মগ্রাম ইয়াস্নায়া পলিয়ানায়। জুন ও জুলাই মাসে তার গ্রামের বাড়িতে তুর্গেনেভের সঙ্গে দুবার দেখা হলো। প্রথমবারের উত্তাপ দ্বিতীয়বারে উবে গেল। দিনপঞ্জিতে তিনি লিখলেন, ‘ওঁর জন্যে (তুর্গেনেভ) আমার দুঃখ হয়, তবু ওঁর বন্ধু হওয়া আমার পোষাবে না। ওঁকে দেখলেই আমি বিরক্ত হচ্ছি।’

আগস্টে তুর্গেনেভ ফ্রান্সে চলে গেলেন। সেখান থেকে তাঁর চিঠি পেলেন তলস্তয়। চিঠিতে তুর্গেনেভ লিখলেন, ‘পৃথিবীতে একমাত্র তোমার সঙ্গেই আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তার কারণ তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেবল সাধারণ সখ্যসূত্রে আবদ্ধ থাকুক এ আমি চাইনি। আমি চেয়েছিলাম আরো অনেক দূর যেতে, আরো অনেক গভীরে যেতে। কিন্তু আমি সামনে ছুটে গেছি খুব বেয়াড়াভাবে, তোমার সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছি, তোমাকে অস্থির করে তুলেছি, আর তারপরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি, সম্ভবত খুবই অকস্মাৎ। আর এটাই হলো আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরার কারণ। আমি নিশ্চিতভাবে তোমাকে বলতে পারি যে, আমি কখনো তোমার অমঙ্গল চাইনি বা এমনও কখনো ভাবিনি যে সাহিত্যিক ঈর্ষায় পীড়িত হওয়া তোমার পক্ষে আদৌ সম্ভব। আমি তোমার ভিতরে দেখেছি যে (এভাবে বলার জন্য কিছু মনে করো না) তোমার চিন্তাভাবনায় যথেষ্ট গণ্ডগোল আছে ঠিকই, কিন্তু বিন্দুমাত্র কোনো বজ্জাতি নেই। তা ছাড়া তুমি যেরকম বোধশক্তিসম্পন্ন তাতে একথা তোমার না বোঝার কথা নয়, আমরা পরস্পরে যদি ঈর্ষান্বিত হই, তবু তার লক্ষ্য কখনো তুমি হতে পারো না। সংক্ষেপে, রুসোর ধারণা অনুযায়ী বন্ধু আমরা হয়ত কখনোই হতে পারব না, কিন্তু আমরা দুজনকে ভালোবাসব, একে অন্যের সাফল্যে আনন্দিত হবো এবং তুমি স্থির হয়ে গুছিয়ে বসার পরে, ভিতরে ভিতরে যেসব জিনিস তোমাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলছে সেসব কিছুটা উপশমিত হলে, তখন আমি নিশ্চিত, আবার আমরা সেই প্রথম বার সেন্ট পিটার্সবার্গে যেমন ঘটেছিল তেমনিভাবেই মহা আনন্দে ও খোলা মনে দেখাসাক্ষাৎ কতে পারব।’

১৮৫৭ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে তলস্তয় দেশের বাইরে বেরুলেন। এই প্রথম বিদেশযাত্রা। প্রথমে ফ্রান্স, তারপরে সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি। পারীতে দেড় মাসেরও বেশি থাকলেন একটা রুম ভাড়া করে। তুর্গেনেভের সঙ্গে প্রায় নিত্য দেখাসাক্ষাৎ হয়। যথারীতি নানা বিষয়ে তার সঙ্গে তর্ক, মনোমালিন্য ও সন্ধি চলছে। একদিন পারীতে এক অপরাধীদের শিরোচ্ছেদ দেখে তিনি এতই বিচলিত হলেন, পরদিনই তুর্গেনেভের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পারী ত্যাগ করে জেনেভার পথে রওয়ানা হলেন। তুর্গেনেভের সঙ্গে তার সম্পর্কের জটিলতা বোঝা যায় এই সময়ে রচিত দিনপঞ্জি থেকে। এ সময় তুর্গেনেভ সম্পর্কে তিনি দিনপঞ্জিতে লেখেন, ‘আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন এলাম তখন আমার কান্না পেল। কেন তা জানি না। আমি তাঁকে বড্ডো বেশি ভালোবাসি। আমাকে তিনি একেবারে অন্য মানুষের পরিণত করেছেন এবং এখনো পাল্টে দিচ্ছেন।’

জুলাই মাসে তলস্তয় এলেন জার্মানিতে। দিন-রাত জুয়া খেলছেন। সর্বস্বান্ত, ধারকর্জ, পুনরায় রুলেতের টেবিল, ফের স্বর্বস্ব খোয়ানো। শেষে তুর্গেনেভ পাশে দাঁড়ালেন পরিত্রাতা হিসেবে। চূড়ান্ত সর্বনাশ থেকে বাঁচতে ৩০ জুলাই পালিয়ে এলেন সেন্ট পিটার্সবার্গে। তখন দেশের সাহিত্য জগতের হাওয়া বদল হচ্ছে। কলাকৈবল্যবাদী ও তার বিরোধীদল, পশ্চিমীপাগল জাপাৎনিক ও রুশপ্রেমিক স্বদেশী দল স্লাভফিলি―এদের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক ও মসীযুদ্ধে চারদিক মুখরিত। তলস্তয় অনুভব করলেন তার লেখার কদর কমছে। তিনি অনুভব করলেন কোনো দলেই নাম লেখানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। যেহেতু কারো দৃষ্টিভঙ্গিই তার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে না। তিনি লেখা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। শুনে বন্ধুবান্ধবেরা মর্মাহত, হতাশ ও শঙ্কিত হয়ে পড়ল তাকে নিয়ে। তুর্গেনেভ খবর শুনে হন্তদন্ত হয়ে চিঠি লিখলেন, ‘হাজার মাথা খুঁড়েও আমি বুঝতে পারি না, লেখক ছাড়া তুমি আর কী। দার্শনিক? কোনো নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা? সরকারি চাকুরে? এদের মধ্যে কোনটা তোমায় বেশি মানাবে? দয়া করে আমাকে চিন্তামুক্ত করতে কৃপা হোক। আমি তোমাকে দেখতে চাই―ফাঁকা দরিয়ায় পূর্ণবেগে তুমি ছুটে যাচ্ছ।’

১৮৬১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে তলস্তয় লন্ডনে গেলেন। তারপর ব্রাসেল্স, জার্মানি হয়ে এপ্রিল মাসে দেশে ফিরলেন। এই সময়টায় শুরু হলো তুর্গেনেভের সঙ্গে নানা বিষয়ে ঝগড়া। অতঃপর সুদীর্ঘ সতের বছরের এই দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সব সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল। তুর্গেনেভের জীবনের শেষ দিকে সম্পর্ক পুর্নস্থাপিত হয়, কিন্তু আগের অন্তরঙ্গতা আর ফিরে এলো না।

১৯০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যাজকীয় বিচারসভা সিনোদ তলস্তয়কে ধর্মত্যাগী ঘোষণা করল। তাঁকে অভিশপ্ত ঘোষণা করে তাঁর ধর্মাপরাধের বিস্তারিত ফিরিস্তি দিয়ে ঘোষণাপত্র জারি হলো, ‘অতএব গির্জা আর তাকে সন্তানগণের মধ্যে গণ্য করছে না এবং করতেও পারে না, যতক্ষণ না সে অনুশোচনা করে এবং গির্জার সঙ্গে নিজেকে পুনরায় আবদ্ধ করে।’ ঘোষণাপত্রটি সারা দেশের সমস্ত গির্জাদ্বারে সেঁটে দেওয়া হলো। চার্চ কর্তৃক বহিষ্কৃত হলেও মস্কোর রাজপথে তলস্তয়কে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানাল জনতা। তলস্তয় ‘সিনোদ প্রদত্ত রায়ের জবাবে’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখলেন, ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। তাঁকে আমি আত্ম, প্রেম ও যাবতীয় বস্তুর সারৎসার হিসেবে উপলব্ধি করি। আমি বিশ্বাস করি, তিনি আমার মধ্যে আছেন, যেমন আমিও তাঁর মধ্যে। আমি বিশ্বাস করি, প্রেমোপলব্ধিতে অগ্রসর হওয়ার একটিই পথ―প্রার্থনা। ধর্মমন্দিরে গণপ্রার্থনা নয়, যিশুখ্রিষ্ট স্পষ্টভাবে তার নিন্দা করেছেন। সেই প্রার্থনা, যা তিনি নিজে আমাদের শিখিয়েছেন―একক প্রার্থনা, যার মধ্যে মনুষ্যজন্মের সার্থকতা সম্বন্ধে সচেতনতা এবং ঈশ্বরেচ্ছায় আমরা চালিত হতে বাধ্য―এই বিশ্বাস কোনো লোক নিজের মধ্যে পুনরুদ্ধার ও বলবতী করে তোলার ক্ষমতা পায়।’

বিচারসভা তবু তাদের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রাখল। বিচারসভার ঘোষণা পর আলেক্সিয়েই সুভোরিন তাঁর পত্রিকায় লিখলেন, ‘আমাদের জার দুজন―দ্বিতীয় নিকলাই এবং ল্যেভ তলস্তয়। কোন জন বেশি শক্তিশালী? তলস্তয়ের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় নিকলাই শক্তিহীন এবং সিংহাসন থেকে তলস্তয়কে একটুও নড়াতে পারবেন না। অন্যপক্ষে তলস্তয় তর্কাতীতভাবে দ্বিতীয় নিকলাইয়ের সিংহাসন ও তাঁর সমগ্র বংশ ধরে নাড়া দিচ্ছেন। কেউ তলস্তয়ের বিরুদ্ধে একটা আঙুল তুলে দেখুক, সারা পৃথিবী লড়াইয়ে নেমে যাবে। তাতে আমাদের প্রশাসন লেজ গুটিয়ে পালাতে পথ পাবে না।’

হয়ত স্বামী তলস্তয়ের প্রতি স্ত্রী সোফিয়া আন্দ্রেইয়ের ভালোবাসার কমতি ছিল না। বিয়ের পর থেকেই বাকি জীবন এই নারী তাঁর স্বামীকে মারাত্মকভাবে উৎপীড়ন করেছেন। তলস্তয়ের মতো একজন ‘চরিত্রহীন’কে তিনি বিয়ে না করলেই তো পারতেন। বিয়ের আগেই তো তলস্তয় তাঁর ‘চরিত্রহীনতা’র দলিল দিনপঞ্জিগুলো সোফিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘পড়ে দেখ, এই হচ্ছি আমি।’ তখন এই ‘চরিত্রহীন’কে বিয়ে করবেন না বলে বেঁকে বসতে পারতেন না সোফিয়া? কেন বেঁকে বসলেন না? কেন বিয়ে করলেন? করে কেন সারা জীবন স্বামীকে চরমভাবে উৎপীড়ন করলেন?

বিরাশি বছর বয়সে স্ত্রীর নিষ্ঠুর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ব্যক্তিগত চিকিৎসক দুশান মাকোভিৎস্কিকে নিয়ে বাড়ি ছাড়লেন মহান তলস্তয়। শেষ হেমন্তের কনকনে ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে, পথ কর্দমাক্ত এবং ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। মাকোভিৎস্কিকে নিয়ে চুপিচুপি উঠোনে নামলেন তিনি। কোচোয়ানকে জাগিয়ে ঘোড়ার গাড়ি বের করা হলো। ঘোড়া জুতবার সময় তিনি নিজেও হাত লাগালেন। আহা, এরই মধ্যে মাথার টুপিটা পড়ে গেছে। টর্চের আলোয় খুঁজে পাওয়া গেল না। টুপিহীন খালি মাথায় হিম পড়তে লাগল। মাকোভিৎস্কি তাঁর একটা বাড়তি টুপি তাঁকে দিলেন। স্টেশনে পৌঁছে টিকেট কেটে গর্বাচোভ গামী ট্রেনে উঠে পড়লেন দুজন। তখন তাঁর পকেটে মাত্র ৩৯ রুবল আর মাকোভিৎস্কির কাছে ৩০০ রুবল। তলস্তয় ঠিক করলেন যে তিনি নানা জায়গায় দু-চার দিন করে থাকবেন, যাতে সোফিয়া তাঁর নাগাল না পান। বিকেল চারটায় তাঁরা কজেলস্ক-এ নামলেন। ঝিসদ্রা নদী পার হয়ে এক আশ্রমে উঠলেন। পরদিন চলে গেলেন একমাত্র বোন মারিয়ার কাছে, যিনি থাকেন শামর্দিন ভিক্ষুণীমঠে।

ততক্ষণে তলস্তয়ের খোঁজখবর করা শুরু হয়ে গেছে। গভর্নরের হুকুমে পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী তাঁর খোঁজে চতুর্দিক ছুটে বেড়াচ্ছে। বোন মারিয়ার কাছে এক রাত থেকে পরদিন আবার কজেলস্ক’র উদ্দেশে রওনা হলেন তলস্তয়। সেখান থেকে রিয়াজান-উরাল রেলপথের ওপরে রস্তোফ-না-দুন শহরের টিকেট কাটবেন। সকাল পৌনে আটটায় ট্রেনে উঠলেন। বিকেল চারটার দিকে প্রচন্ড জ্বর উঠল শরীরে। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় দিকিন স্টেশনে গাড়ি থামলে পুলিশের কাছে খবর চলে গেল যে তলস্তয় এই ট্রেনেই আছেন। সন্ধ্যা সাড়ে ছ টায় ট্রেন আস্তাপভ স্টেশনে থামল। তলস্তয় তখন তীব্র জ্বরে কাঁপছেন। স্টেশন মাস্টারের সহযোগিতায় তাকে ট্রেন থেকে নামানো হলো। মাস্টার তাঁর বাড়ির একটা কামরা ছেড়ে দিলেন তলস্তয়ের জন্য।

পিতার খোঁজে মেয়ে শাশা উপস্থিত হলেন দিকিনে। পরদিন বড় মেয়ে তানিয়াও এলেন। তারও পরের দিন স্ত্রী সোফিয়া এলেন, কিন্তু তাকে স্বামীর কাছে যেতে দেওয়া হলে না তখন। তলস্তয় গুরুতর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। সারা দেশে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার স্বাস্থ্য নিয়ে সংবাদ বুলেটিন বেরুচ্ছে। বিরতিহীন টেলিগ্রাফ অফিস কাজ করে যাচ্ছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, রেলওয়ে প্রশাসন, রিয়াজান, তামবোফ ও তুলা প্রদেশের গভর্নররা প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে খোঁজখবর নিচ্ছেন। রাশিয়ার সর্বত্র ও সারা পৃথিবী থেকে তলস্তয়-পরিবারের কাছে টেলিগ্রাম আসছে। ৩ নভেম্বর রাতে অচেতনের ঘোরে তলস্তয় বিছানায় উঠে বসে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মাশা মাশা’। এই মাশা তাঁর মেয়ে, যে চার বছর আগে মারা গেছে। পরদিন সন্ধ্যায় বকতে লাগলেন, ‘পালাতে হবে। পালিয়ে আমি যাবই। কেউ বিরক্ত করবে না এমন জায়গায় আমি চলে যাব। একটু একা থাকতে চাই।’ এ সময় স্ত্রীকে তাঁর পাশে আনা হলো। গির্জার পক্ষ থেকে যাজক পাঠানো হলো, যদি তলস্তয় অনুশোচনা প্রকাশ করেন, তাহলে তাঁকে পুনরায় গ্রহণ করবে চার্চ। তলস্তয়ের শিষ্যম-লী পাদ্রিকে কাছেই ঘেঁষতে দিলেন না।

অবশেষে তিনি চলে গেলেন, ১৯১০-এর ৭ নভেম্বর ভোরে। জন্মগ্রামে আনা হলো তাঁর লাশ। সমাহিত করার জন্য যখন কবর খোঁড়া শেষ হলো, সমাধিস্থলে অসংখ্য মানুষের ভিড় দেখে কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে এলো। ভিড়ের ভেতর থেকে কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘হাঁটু গাড়ো, হাঁটু গাড়ো। টুপি খুলে ফেল।’ হতচকিত পুলিশরা হাঁটু গেড়ে বসল, টুপি খুলে ফেলল মাথা থেকে। বাড়ির অনতিদূরে ছায়াচ্ছন্ন তরুতলে মহানিদ্রায় শায়িত হলেন গির্জা ও রাষ্ট্রের শত্রু, সামাজিক দ্রোহী ও সন্ত, অমর বাণীশিল্পী কাউন্ট ল্যেভ তলস্তয়। কোনো ধর্মানুষ্ঠান, যাজক সমাবৃত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হলো না। রাশিয়া প্রথম একটি মৃত্যু দেখল, যেখানে গির্জার কোনো ভূমিকা রইল না।

নভেম্বর মহান ঔপন্যাসিক ল্যেভ তলস্তয়ের প্রয়াণ মাস। তিনি ও তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রতি আনত শ্রদ্ধা।

স্বকৃত নোমান
২৫.১১.২০২০

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধগুরুদাসপুরে প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের অভিযোগ, অভিযুক্ত আটক
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে শ্রমিক-কর্মচারী ও আখ চাষীদের পাওনা পরিশোধের দাবিতে চিনিকলে আন্দোলন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে