মুক্তিযোদ্ধারা কী সাহস হারিয়েছেন?- রেজাউল করিম খান
এই কথা শুনে যে কেউ আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন, সন্দেহ নেই। হতেই পারেন; আমরা তো জেনে আসছি, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনের মায়া ত্যাগ করে অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াই করেছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন দেশে বাস করছি। ইতিহাস অনেকটা এভাবেই লেখা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের পর থেকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে দখলদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা-নির্যাতনের শিকার হন। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। এদের প্রায় সকলেই মৃত্যুর শঙ্কা নিয়ে অবরুদ্ধ ছিল নয় মাস। এইসব মানুষই অংশ নেন প্রতিরোধ যুদ্ধে। একাংশ স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধ করেন। একাংশ ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। একাংশ ছিল সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার। আর যাঁরা ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের কথাও বলতে হয়। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে কাকে বাদ দেবেন? অথচ আমরা প্রায়ই শনি, অকুক সরকারের আমলে এতো হাজার মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া। তাদেরকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে। যদিও উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ভুয়া’ বলা যাবে না। যাইহোক, তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দেয়ার ব্যাপারে কারও দ্বিমত থাকার কথ না। কিন্তু তার পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। সেইসব মতের সমন্বয়ে আজ পর্যন্ত বাস্তবসম্মত কোনও ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয় নি। ফলে মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েই গেছে। আর এই কারণেই প্রশ্ন উঠছে, মুক্তিযোদ্ধারা কী সাহস হারিয়েছেন? হতেই পারে, বয়স হয়েছে, শরীরে শক্তি নেই, মনটাও দুর্বল। অনেকদিন থেকেই ওরা ভয় দেখাচ্ছে, ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও বাছাই করা হবে। ভাতা বন্ধ করা হবে। অনেকের ভাতা বন্ধও করা হয়েছে। এমন কথা আর কর্মকান্ড দেখলে কার না ভয় লাগে?
এপর্যন্ত যাঁদের নাম তালিকায় এনে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে, তাঁদের কারও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নেই কোনও আইন। মাত্র দুই লাখ মানুষকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই সংখ্যা কি যথেষ্ঠ? অমুক্তিযোদ্ধা আবিষ্কার করার পূর্বে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এরপর তাঁদের শ্রেণিবিন্যাস করা যেতে পারে। তাঁদের হারানো সম্মান পুনরুদ্ধার করতে হবে। মনে রাখতে হবে কোনও কিছু প্রাপ্তির আশায় সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নি। মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘সময় পেলেই গ্রামে যাই। খালি পায়ে হাঁটি। স্কুলের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করি। চায়ের দোকানে বসি। একটা সময় ছিল, এই ১০ থেকে ১৫ বছর আগে, গ্রাম বা গঞ্জের পথে হাঁটলেই মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতো।
একগাল হেসে এগিয়ে এসে ওরা করমর্দন করত। সমবয়স্করা বলত, ভাই, কেমন আছ? চিনতে পারলা কি? অনেক দিন পর দেখলাম তোমারে! কিন্তু একাত্তরের সেই সহযোদ্ধাদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। রের মুক্তিযোদ্ধারা সবাই বয়োবৃদ্ধ। তাঁরা মৃত্যুবরণ করবেন—এটিই স্বাভাবিক। যে রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য তাঁরা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, অতি সামান্য প্রশিক্ষণে একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছেন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য, সেই রাষ্ট্র যদি তাঁদের স্বীকৃতি না দেয় বা সম্মানিত না করে—সে অপরাধ রাষ্ট্রের। এমন কোনো জাতি বা রাষ্ট্র নেই, যে জাতি বা রাষ্ট্র তার স্বাধীনতাসংগ্রামীদের যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে না। কারণ এ সম্মান রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা, জাতীয় দায়বদ্ধতা। এটি করা না হলে রাষ্ট্র ইতিহাসবিবর্জিত হয়, নতুন নাগরিকরা তাদের জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যায়, জাতি শিকড়শূন্য হয়।’
প্রশ্ন আছে গণশহীদের ব্যাপারেও। একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে। কিন্তু তার তালিকা করা হলো না কেনো? এব্যাপারে শ্রদ্ধেয় লেখক আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে যতবারই আমি গ্রামে গেছি, মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং মাতব্বর-স্থানীয় মানুষদের একটা বিষয়ে রাজি করাতে বারবার চেষ্টা করেছি। আমাদের গ্রামের প্রায় একশ মানুষ পাকিস্তানী সৈন্য এবং রাজাকার আলবদরদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। আমাদের গ্রামের মাঝ দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রাস্তাটি চলে গেছে। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, গ্রামের প্রবেশমুখে মুক্তিযুদ্ধে নিহত এই শতখানেক মানুষের নাম একটি বিলবোর্ডে লিখে স্থায়ীভাবে রাস্তার পাশে পুঁতে রাখার জন্য। আরো একটা বাক্য লেখার প্রস্তাব আমি করেছিলাম। সেটা ছিল এরকম, ‘হে পথিক, তুমি যে গ্রামের ওপর দিয়ে যাচ্ছ সে গ্রামের একজন সন্তান দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে।’ আমি আমার এই প্রস্তাবটি ১৯৭২ সাল থেকে করে আসছি। প্রথম প্রথম মানুষ আমার কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করত। তিনচার বছর অতীত হওয়ার পরও যখন প্রস্তাবটা নতুন করে মনে করিয়ে দিতাম লোকে ভাবত আমি তাদের অযথা বিব্রত করতে চাইছি।
আমার ধারণা, বর্তমান সময়ে যদি আমি প্রস্তাবটা করি লোকে মনে করবে আমার মাথাটা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেছে।’ সত্যিই তো, এমন প্রস্তাব প্রায় সর্বত্রই ছিল। কিন্তু গ্রহণ করা হয় নি। এই কাজটি করা হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত থাকতো নাকি লোপ পেতো, তা বোঝা বোধকরি কঠিন নয়। একাত্তরে সম্ভ্রম হারানো নারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ওদেরও তালিকা নেই, সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। এইসব বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আর কথা বলেন না বা বলতে চান না বা বলতে পারেন না।