লক ডাউন -ডাঃ শ্যামল বৈদ্য’র ছোট গল্প

0
894
Shamol

লক ডাউন -ডাঃ শ্যামল বৈদ্য

পঞ্চাশোর্ধ অতসী দেবী ফ্লাটের বাতায়নে বসে আছেন। চোখের জল সামলে ঝাঁপসা হওয়া চশমার কাঁচ মুছলেন। উদাস ভাবে চেয়ে থাকলেন রাস্তার দিকে। পৃথিবীটা আজ কত নির্ম্মল! চারিদিক নিস্তব্ধ! কর্মকাণ্ডে নেই ব্যস্ততা,নেই কোলাহল। পৃথিবী জুড়ে আছে শুধু মহামারীর আতঙ্ক! আছে হতাশা, আছে স্বজন হারানোর বুক চাপা কান্না। আছে অভুক্ত মানুষের সর্বগ্রাসী হাহাকার। অদৃশ্য করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বে বসিয়েছে তার মারণ থাবা।
ঈশ্বর, আল্লাহ, গডের দূতেরা আজ বিজ্ঞানের দ্বারস্থ ? কোথায় তাদের সেই চমৎকারি আশার বাণী? ঠাকুর ঘরে নেই পূজো দেবার ব্যস্ততা। নেই কাসর ঘন্টা ও উলুধ্বনি ও ধুনোর গন্ধ। এক লহমায় তাদের সুখী সংসারে নেমেছে কালো ছায়া। চাওয়া পাওয়ার বুনিয়াদ হয়েছে আশার সমাধী। অতসী দেবীর বারবার মনে পড়ছে – কদিন আগে হাসপাতালে যাবার আগে, তার স্বামী ডাঃ অনির্বাণ দত্ত, চিবুকে আলতো হাতের ছোঁয়া দিয়ে বলেছিলেন – ভয় নেই, আমার কিচ্ছু হবেনা। তোমার ঠাকুর আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমি সাবধানে রুগীর চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসবো। ডাঃ অনির্বাণ সেই যে গেল আর ফিরে এলো না। খবর এলো কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ অনির্বাণ দত্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের আই, সি, ইউ, ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। প্রবল শ্বাস কষ্ট, জ্বর ও গলা ব্যথার কারণে তার কথা বলার মতো অবস্থা নেই । এমন দুঃসংবাদ শোনা মাত্রই অতসী দেবী ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। কর্তব্যরত ডাঃ ও নার্সেরা সতর্কতা অবলম্বন করে তাকে দূর থেকে দেখার অনুমতি দিয়েছেন কিন্তু একটু ছোঁয়ার অনুমতি দিলেন না। অক্সিজেন, স্যালাইন কার্ডিও মনিটরিং, ইঞ্জেকশন, ওষুধ প্রয়োগ একের পর এক চলতে থাকলো। প্রবল শ্বাসটানের মাঝে ডাঃ অনির্বাণ সেদিন অতসীকে চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সে আর তার কথা রাখতে পারলো না। যমে মানুষে টানাটানির সাতদিনের মাথায় তার দেহান্ত হলো। সরকারের কড়া ঘেরাটোপে নিমতলা মহা-শশ্মানের চুল্লিতে হলো তার সৎকার ও সমাপ্তি । শত অনুরোধেও শেষ যাত্রায় তার সর্বাঙ্গ ঢাকা দেহ থেকে মুখের আভরণ খুলে শেষ বারের মতো তাকে দেখতে দেওয়া হলো না। একমাত্র সন্তান অম্লান দত্ত সেও জুনিয়র ডাক্তার। লক ডাউনের মাঝে সদ্য পিতৃ বিয়োগে সেও কাতর। এদিকে সারাবিশ্বে ডাক্তাররাই এখন ত্রাতা। ডাঃ অম্লান দত্ত তাই পারেনি তার কর্তব্য বোধ ভুলে যেতে। নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও পিতৃশোক ভুলে, জরুরি পরিষেবা দিতে হাসপাতালে যোগ দিয়েছেন। অতসী দেবী আপ্রাণ চেষ্টা করেও তার ছেলেকে আটকে রাখতে পারেন নি। তার কর্তব্য নিষ্ঠার কাছে হার মেনেছে। অতসী দেবী বুকে পাথর চাপা ব্যথা নিয়ে, অপলক শূন্য দৃষ্টিতে জনশূন্য রাস্তায় চোখ রেখে বিড়বিড় করে বলছেন – ঠাকুর, তুমি কি আছো না শুধুই মাটির প্রতিমা? আমার অনির্বাণকে তুমি কেড়ে নিয়েছ। একমাত্র অবলম্বন আমার ছেলে অম্লানকে তুমি আর আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না ঠাকুর কেড়ে নিও না। ও যে মানব সেবায় ব্রতী । মহাশূন্যের দিকে আঙুল তুলে বলেন- অনির্বাণ, আমার কথা কি তুমি শুনতে পাচ্ছো অনির্বাণ? তুমি কি ওখানে আছো? দাও সাড়া দাও, শুধু একটি বারের জন্য সাড়া দাও..সাড় দাও…সাড়া দাও…. .( সমাপ্ত )

(ছোট গল্প)
ডাঃ শ্যামল বৈদ্য
রচনাকাল :-ইং-২৪/৪/২০২০
————————–

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধমমতার আলো – স্বপন চক্রবর্ত্তী  
পরবর্তী নিবন্ধক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে আছে সরকার- পলক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে