শৈশব স্মৃতিতে দাসদের জীবন- রেজাউল করিম খান

0
302

শৈশব স্মৃতিতে দাসদের জীবন- রেজাউল করিম খান

যা পড়ি, শুনি, দেখি, তার অধিকাংশই ভুলে যাই। মনে থাকে সামান্যই। যদি সবটুকু মনে থাকতো, তাহলে আর বেশি পড়া-শোনা লাগতো না। ক্লাশে স্যারের মুখের কথা শেষ হওয়ামাত্র গড়গড় করে বলে দিতে পারতাম প্রশ্নের উত্তর । পরীক্ষাতে বসেও খাতা সামনে নিয়ে মুখে কলম গুঁজে চিন্তা করতে হতো না । কিন্তু তা হয় না। লেখার জন্য বিষয়ভিত্তিক পড়তে হয়। অনেকদিন ধরে গবেষকরা বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের মনে রাখার ক্ষমতা জন্মের পর থেকে ৩ বছর তেমন একটা ভালো থাকে না। কিন্তু যখন বয়স তিন বছর হয়ে যায় তখন তার মনে রাখার ক্ষমতা খুব দ্রুত উন্নত হতে থাকে।

মনোবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন তিন থেকে ছয় মাস বয়সী শিশুদের দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিশক্তি থাকে। বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর তার অবচেতন মন অজান্তেই স্মৃতি ধারণ করে। প্রথম বছরেই তার অনেক ধরনের শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তন ঘটে আর তিন বছরের ঘটনাগুলো কোনো তথ্য ধরে রাখে না, তাই মানুষ জন্মের কথা মনে রাখতে পারে না। মানুষের মস্তিষ্কে স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কোষগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা লাগে। সংযোগ স্থাপনকারী তন্তুগুলোর নাম হল ‘সিন্যাপ্স’। কোষে জমা হওয়া তথ্যগুলোকে আমাদের মস্তিষ্ক বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে রাখে, যাকে বলা হয় ‘কন্সোলিডেশন’।

কোনো কিছু মনে রাখতে হলে ওই স্মৃতিগুলোকে মাঝে মাঝে মনে করতে হবে, যাতে সিন্যাপ্স এর সংযোগগুলো আবার কাজ করার সুযোগ পায়। এটিই গুরুত্বপূর্ণ কথা যে, “স্মৃতিগুলোকে মাঝে মাঝে মনে করতে হবে”। না, সব স্মৃতি মনে রাখার প্রয়োজন নেই। যেগুলি উন্নত জীবন, জীবিকা, মানবিক আচরণ, সৃজনশীল কর্ম ও জনকল্যাণকামী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে সহায়তা করে, সেগুলির চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। আমার আজকের বিষয় বঙ্গদেশীয় দাসপ্রথার ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য বর্ণনা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এতদবিষয়ক উল্লেখযোগ্য কোনও গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেলো না। এমনকি, স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকেও সুনির্দিষ্টভাবে দাসজীবনের কাহিনী অনুপস্থিত। সুতরাং চলুন বিদেশিদের কাছেই যাই।
মানুষ ছোটবেলায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হতে পারে কীভাবে? নিঃসন্দেহে বই পড়ে। শৈশবে পড়া যখের ধন, সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু, আলেক্সান্ডার বেলায়েভের উভচর মানব, লরা ইঙ্গেলসের দ্য ফার্মার বয়- এসব বই অনেকের মনেই রেখে গেছে গভীর আনন্দের অনুভূতি।

কিন্তু যদি এমন কয়েকটি বইয়ের নাম করতে বলা হয়, যা কি না আদতে বিদেশি পটভূমিতে লেখা হলেও পড়ার সময় সবার মন ভারি হয়ে উঠেছিল, তাহলে কোন্ নামগুলো সবচেয়ে বেশিবার আসবে? একটি নাম চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়, কালজয়ী লেখা ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ বা ‘টম কাকার কুটির’। এর এত জনপ্রিয় হবার কারণ কী? কী নিয়ে লেখা এই বইটি? কেনই বা এটি আমাদের মনকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে? এই প্রশ্নের উত্তরেই চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মধ্যযুগীয় বর্বর প্রথার কথা, যার ওপর ভিত্তি করে এই বইটি দাঁড়িয়ে। প্রথাটি কী, সে ব্যাপারে একটু পরেই জানা যাবে।

লেখক হ্যারিয়েট বিচার স্টো’র কৃতিত্ব আসলে এখানেই যে, তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখাকেও এমন আদলে পাঠকের সামনে আনতে পেরেছেন যাতে করে এটি তাদের মর্মকে স্পর্শ করে যায়। ১৬০০-১৭০০ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি আর অন্যান্য খাতে উন্নয়নের এক অনন্য জোয়ার আসে। অর্থনীতির চাকা সামনের দিকে ঘুরতে শুরু করে অবিস্মরণীয় দ্রুত গতিতে। এর সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল ‘দাস’দের কারণে। মাঠঘাটের সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজগুলো, অথবা যেসব কাজে দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে, সেসব কাজে দাসেরা নিয়োজিত থাকতো। এই ফাঁকে বলে রাখা ভাল, এই দাসেরা কোনো উন্নত যন্ত্র, বা শক্তিশালী পশু নয়। তারা সত্যিকারের মানুষ!

পৃথিবীতে যত রকমের অমানবিক আর বর্বর নিয়মকানুন চালু ছিল, বা আছে, তার মাঝে যেটি ক্যান্সারের মতো মানবতাকে আক্রান্ত করেছে, তার নাম দাসপ্রথা। ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ বইটি যুক্তরাষ্ট্রের জঘন্য দাসপ্রথাকে নিয়েই লেখা। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ কিন্তু নিজে থেকে এই প্রথাটি আবিষ্কার করেনি। আসলে যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের শৃঙ্খল এসেছে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আরও অনেক পরে। চলুন, জেনে আসা যাক দাস তথা ক্রীতদাসদের অন্ধকারময় ইতিহাস। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০-৩০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সর্বপ্রথম মেসোপটেমিয়াতে ক্রীতদাসপ্রথার সূচনা ঘটে।

ঠিক কীসের ভিত্তিতে দাসত্বের এই ধারণাটি মানুষের মাঝে এসেছিল, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে শারীরিক সবলতা ও আর্থিক উৎকর্ষতা অবশ্যই এখানে ব্যপক প্রভাব ফেলেছিল। সে যা-ই হোক, মেসোপটেমিয়া থেকে দাসদের কেনাবেচার এই প্রথাটি মিশরে প্রবেশ করে প্রায় হাজারখানেক বছরের মধ্যেই। সমস্ত মিশরে এটি তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর একটি কারণ হলো, মিশরীয়রা দৈহিক পরিশ্রম করানোর পাশাপাশি নিজেদের বিকৃত যৌনাচারের চর্চা করতে দাস-দাসীদের ব্যবহার করতো।

সম্ভ্রান্ত পরিবার কিংবা রাজপরিবারের সদস্যদের তাই একাধিক দাস-দাসী থাকাটা ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। মিশর থেকে ভারতবর্ষে এই কুপ্রথা ঢুকে পড়তে বেশিদিন সময় লাগেনি। এরপর দ্রুতগতিতে চীন আর এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রীতদাসপ্রথা চালু হয়ে যায়। ৮০০-৭০০ খ্রিস্টাব্দে গ্রিস এবং ২০০ খ্রিস্টাব্দে রোমে দাসপ্রথার ভয়াবহ পদচারণা শুরু হয়। পাল্লা দিয়ে একে অপরের চেয়ে বর্বরতার শীর্ষে যাবার চেষ্টা করে এই দুটি অঞ্চল। এভাবে সমস্ত পৃথিবীতে ধীরে ধীরে দাসপ্রথার আগ্রাসন দেখা দেয়।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধবড়াইগ্রামে হেলথ্ কেয়ার প্রোভাইডারদের মাঝে ল্যাপটপ বিতরন
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে ইয়াবা সহ যুবক আটক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে