সাহিত্য একাডেমির আড্ডা ও পূর্বাপর সুধাযোগ

0
201

সাহিত্য একাডেমির আড্ডা ও পূর্বাপর সুধাযোগ

গতকালও নিউইয়র্কে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছে। ঠাণ্ডা নামার স্মারক ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রকৃতি । ক’দিন পরেই ঝেঁপে নামবে শীতের কুয়াশা, তারপর ঝুরোঝুরো বরফ ! পেঁজা তুলোর মতো, ছেয়ে যাবে সারাটা রাস্তা, বাড়িঘর, রাস্তার দু’পাশে সার করে রাখা গাড়ির ছাদ, কাঁচ, পত্রহীন উদোম বৃক্ষের বিমর্ষ শাখাগুলোও !

প্রতি ইংরেজী মাসের শেষ শুক্রবারে সাহিত্য একাডেমির মাসিক আসর বসে, জ্যাকসন হাইটসে ! নিউইয়র্কের সাহিত্যমনস্ক সবাই তা’ জানেন, যখনই যার সুবিধে হয়, সময় থাকে- দূর দূরান্ত থেকে ছুটে ছুটে আসেন । যখন বাবা ছিলেন তখনও বাবার জন্যে সন্ধ্যেবেলা বের হতে পারতাম না খুব, বাবা ওই বয়সেও পিতৃসুলভ উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকতেন রাত বারোটা পর্যন্ত !

সাহিত্য একাডেমির আড্ডা শুরু হতেই রাত আটটা বেজে যায়। ফলে ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা । অত রাত পর্যন্ত অশিতীপর বাবা আমার জন্যে জেগে আছেন দেখলে ভারি অপরাধ বোধ হত। ফলে একাডেমির সব আসরগুলোতে আমার যাবার সুযোগটা হতো না । হঠাৎ হঠাৎ একটা দুটো আসরে যেতাম । আজ আর বাবা নেই! বাবার সেই উৎকণ্ঠাও নেই !

বাবা চলে যাওয়ার ঠিক আগেই হঠাৎ করে চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরী, যাঁর অপার মমতাসুধা পেয়েছেন নিউইয়র্কের সাহিত্যনিষ্ঠ পিপাসুরা ! আমি সেই দলের নগন্য একজন । তিনি ছিলেন সাহিত্য একাডেমির একমাত্র উপদেষ্টা ! তাঁর চলে যাবার পর পরই হঠাৎ বাবাও চলে গেলেন । আমার ভেতরে নামলো এক ভয়াবহ ধ্বস্ – এই দুটো আকস্মিক মৃত্যুতে ! মৃত্যু মাত্রই বিষাদবাহী- সেই বিষাদের ঝড়ে আমি ডুবে গেলাম ।

তারপর পুরো দু’বছর আর সাহিত্য একাডেমি বা কোন সংগঠনের কার্যক্রমে আমার যাবার ইচ্ছে হয় নি, মনে হতো কি হবে এইসবে ! সবই বৃথা, শেষ পর্যন্ত তো সেই মৃত্যুই অবধারিত সত্য । ক’জন আর লিখে অমর হতে পেরেছেন! অমন অমর হবার প্রতিভা নিয়ে খুব বেশি মানুষ এই পৃথিবীতে আসেন না। কালের গর্ভে, বিস্মৃতির সমুদ্রে হারিয়ে যায় আর সবাই, তাদের লেখা, তাদের সযত্ন সব সৃষ্টি ! তাহলে আর কি হবে – এইসব ছাইপাঁশ লিখে বা সাহিত্য আসর করে !

হঠাৎ, বিগত দুটো আসরে নিজেকে জোর করেই নিয়ে গেলাম পুরো দু’বছর পরে । আজ ছিল ১০৭ তম আসর সাহিত্য একাডেমির। একাডেমির একনিষ্ঠ সংগঠক মোশাররফ সাহেব নিয়মিত ম্যাসেজ দেন । ফোনও করেন! ডাকেন বারে বারে । কালও কল করে বললেন, কবি জীবনানন্দ দাশ, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে কয়েকজনকে বলতে অনুরোধ করেছেন, এবং আমাকেও তাতে যুক্ত রাখার কথা বললেন। তাঁকে বললাম, যাবো ! পরের কয়েকটি মাসের আসরে হয়তো যাবার সুযোগ নাও হতে পারে – তাই আজকের আসরটিতে যেন থাকতে পারি তার জন্যে সময় করে নিলাম!

জীবিকা থেকে ঘরে ফিরে প্রাত্যহিক কিছু দায়িত্ব সেরেই যাত্রা করলাম আসরের উদ্দেশ্যে। বাসে চেপে বসলাম। তাতে কিছু পড়ার সুযোগ হয় বাসের সময়টাতে। সাম্প্রতিক দেশ পত্রিকা সাথে নিয়েছি । পড়তে পড়তেই কখন যেন পৌঁছে গেলাম জ্যাকসন হাইটসে। নতুন রকমের আলোর সাজে সেজে উঠছে জ্যাকসন হাইটস! দীপাবলী, থ্যাংকসগিভিং ও ক্রীসমাস সমাগত প্রায়।

দোকানগুলোতে প্রচুর ভিড় ! তবুও বুটালায় ঢুঁ মেরে এই পক্ষের দেশ পত্রিকাটি নিয়ে ঘড়িতে দেখি তখন মাত্র ছয়টা বাজে । এখনও হাতে প্রচুর সময়! সাতটার আগে কেউ আসেই না আসরে। সাতটার দিকে গেলে একটু আড্ডা দেয়া যায় । আসরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে হতে রাত আটটা। মনে মনে ভাবছি, শীতের দিন তো আসছে, আসরের শুরুর সময়টা যদি ছয়টা করা যেতো – তাহলে রাত নয়টার মধ্যে বাড়ি ফেরা যেতো।

এমন সব চিন্তা করতে করতেই মনে হলো, একটা কফি নিয়ে বসি না হয় কোথাও একটু। আমার একা বসতে ভালো লাগে না। চেনা কাউকেই দেখছিও না। তবু ঢুকলাম একটা ঘরোয়া অনুভবের রেস্টুরেন্টে। কফি ও পেসট্রি নিয়ে নতুন দেশ পত্রিকা খুলে বসলাম । মোদী ট্রাম্পের যুগলবন্দী সংখ্যা ! রাজনৈতিক বিষয়ে ফালতু সব প্রবন্ধ পেছনে রেখে কবিতার পাতায় চলে গেলাম। একটা কবিতা পড়ে শেষ করেছি। দেখি, সামনে এসে বসলেন একজন অপেক্ষাকৃত যুবক । তাঁর খাবারের অর্ডার দিয়ে দেশ পত্রিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
~ ভাই, খুব সুন্দর আপনার হাতের পত্রিকাটা, কি নাম ?
দেশ
~ বাংলাদেশের ?
না, কোলকাতার !
~ ওহ্, কখনও নামই শুনিনি!

বললাম, ~ ভাই, এটি একটি প্রখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা, অনেক বছর ধরে বের হয় । তিনি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, – আপনার দেশ কোথায় । বললাম – বাংলাদেশ ! তিনি বললেন, তাঁর বাড়ি ঢাকা, ধামাইরে ! হঠাৎ তাঁর কি যে হলো, কথার ঝাঁপি খুলে বসলেন । প্রতিটি মানুষই যে কত রকম গল্পকে ধারণ করে জীবনপাত করে ! নাম তাঁর কুদ্দুস ! তাঁর বুকের ভেতরেও যে কত কষ্ট জমা আছে, কত দহনের গল্প – সামান্য শুনেই বুঝতে পারলাম ।

ভাবলাম, চুপচাপ শুনিই না হয় তাঁর জীবনের গল্প ! তিনি বলে চলেছেন । আমি ত্বনিষ্ঠ শ্রোতা । আমার মত এমন শ্রোতা তিনি যে খুব বেশি পান না, তা’ তাঁর উৎসাহ দেখে বুঝলাম ! কথায় কথায় সাতটা বেজে গেল। তাঁকে হঠাৎ থামিয়ে বললাম, ~ ‘এবার যে আমার যেতে হবে কুদ্দুস ভাই । আবার কখনও শুনব না হয় আপনার গল্প । আবার যদি দেখা হয় । ভালো থাকবেন খুব । জীবন তো একটাই !’

তিনি সুবোধ কিশোরের মত মাথা নাড়লেন। দু’চোখে তখন তাঁর গাঢ় কুয়াশা – বুকের ভেতরে নিভৃতে বয়ে চলা ঝড়ের বেদনার ! যে বেদনার কথা সবাইকে বলা যায় না । বলা সঙ্গত নয়। শুধু প্রাণের কোন স্বজনকে বলা যায় !

সন্ধ্যের এই মায়াবী আলোয় অগণিত মানুষের চলাচল দেখতে দেখতেই পায়ে পায়ে চলে এলাম সাহিত্য আসরে । কবি আতিক ভাই সস্ত্রীক এসে গেছেন।এসে গেছেন পলি, বেনজির, পপি আপা, মোশাররফ ভাই, কবি শামস আল মমিন, কবি মিশুক সেলিম সহ অনেকেই । পেছনে গিয়ে মিশুক সেলিম ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক স্নেহভাজন ছোটভাই আদনান সৈয়দের পাশে গিয়ে বসলাম!

একটু পরেই অবিশ্বাস্য কৌতুকের জাহাজবিশেষ বিশিষ্ট সংস্কৃতিসেবী শহীদ ভাই, প্রখ্যাত শিল্পী আকতার আহমদ রাশা সস্ত্রীক এসে পৌঁছালেন । এসে পৌঁছালেন এই প্রথম বারের মতোই স্থানীয় শ্রী চিন্ময় সেন্টারের কিছু একনিষ্ঠ কর্মী ও ভক্ত । তন্মধ্যে মহাতপা দিদি ও নাসিমা খান আমার পূর্ব পরিচিত । ওঁদের সবাইকে দেখে আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো- একটু আগে সদ্য চেনা কুদ্দুস ভাইয়ের ছড়ানো বিষাদ যেন ধুয়ে মুছে গেল ।

আসর শুরু হয়ে গেল আদনানের বক্তব্য দিয়ে । আদনান বললেন, কবি জীবনানন্দ দাশ এর জীবন ও সাহিত্য কর্ম নিয়ে । আদনান মনোযোগী পাঠক ও লেখক । বিষয়ের ডিটেইলস এর প্রতি তাঁর সজাগ দৃষ্টি থাকে সবসময়ে । তারপরে, একে একে অনেকে স্বরচিত কবিতা পড়লেন । অনেকে বিখ্যাত কবির কবিতা পড়লেন । কবি শামস আল মমিনও বললেন, কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়েই । তাঁর আলোচনায় ছিল ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি । জীবনানন্দের কবিতার বৈচিত্র্য নিয়ে ।

শ্রীচিন্ময় সেন্টারের পক্ষ থেকে মহাতপা বললেন – মুক্তপ্রাণ শ্রীচিন্ময়ের লেখা কবিতা ও গান সম্পর্কে, নাসিমা খান ও অন্যজন পাঠ করলেন তাঁর কবিতা। অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে । আমার বলার কথা ছিল কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে । আমার ডাক এলো সবার শেষে । কিন্তু সময়ের সংকুলান হলো না বলে – শুধু ধন্যবাদ জানালাম। সময়ের স্বল্পতার কারণে অনেকেরই বলার বা পাঠের সুযোগ হলো না । উপস্থিত সবাইকে যে পাঠ করতেই হবে বা কথা বলতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই । বরং প্রতি আসরে বিভিন্ন জনকে আলাদা আলাদা সুযোগ দিলে অনুষ্ঠানটি অনেক বেশি আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য হবে বলেই আমার মনে হয় ! আজকের উপস্থিতিও ছিল উল্লেখযোগ্য, হলটি উপচেই পড়ছিলো যেন ! মোশাররফ সাহেবের প্রাণবন্ত পরিচালনায় আসরটি শেষ হলো!

প্রতিটি অনুষ্ঠানের শেষে রাতের খাবারের আয়োজন থাকে । এর আয়োজনে বিপুল শ্রম দেন কবি আতিক ভাইয়ের সুযোগ্যা স্ত্রী – অসম্ভব মায়াবী একজন নীরব কর্মী শিউলী আপা ও অন্যজন পপি আপা। কী নিবিড় মমতায় যে তাঁরা সবার হাতে খাবার তুলে দেন তা’ ঠিক লিখে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। কতটা গভীর নিষ্ঠা থাকলে যে বিগত নয় বছর ধরে একাডেমির জন্যে এমন নীরব সেবা দিয়ে যেতে পারেন, তা’ সত্যিই এক অনুপম দৃষ্টান্ত !

খাবারের ফাঁকে ফাঁকে শহীদ ভাইয়ের চুটকি চলছে । শহীদ ভাইয়ের জোকস বলার ধরণে দারুণ এক মুন্সীয়ানা আছে। তিনি নিয়মিত তাঁর ফেসবুকের টাইমলাইনে অসংখ্য নতুন জোকস শেয়ার করেন । সাথে থাকে তাঁর অনাবিল হাসি মুখের ছবি । তাঁর আজকে বলা বেশ কিছু চুটকির মধ্যে থেকে একটা চুটকির একটু নমুনা দেই। যদিও তাঁর মতো তো বলতে পারব না ! তবু তাঁর বলার নমুনাটা শেয়ার করছি । চুটকিটা এরকম ;

“একজন লোক স্থানীয় লাইব্রেরীতে গেছেন একটি বই নিতে । লাইব্রেরীতে গিয়ে ব্যাকুল হয়ে ডেস্কের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কি আত্মহত্যার উপরে কোন বই আছে?

ভদ্রমহিলা অপাঙ্গে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বললেন,~ আছে, তবে আপনাকে তো বইটা দেয়া যাবে না!

লোকটি যারপর নাই অবাকবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন – কেন? দেয়া যাবে না কেন ?

ভদ্রমহিলার নির্লিপ্ত উত্তর – বইটা আপনি নিয়ে যাবেন ঠিকই । কিন্তু ফেরত দিয়ে যাবে কে ?

ভদ্রলোক লা- জওয়াব !!”

এরমধ্যে রাশা ভাইয়ের সাথেও টুকিটাকি কথা হচ্ছে । রাশা ভাই অসাধারণ একজন গুণী শিল্পী। তাঁর শিল্পকর্মের একটা প্রদর্শনী নিয়ে সামান্য আলোচনা করেছিলাম ক’দিন আগে । এমন বিচিত্র শিল্প কর্মের সৃজন করেন তিনি এতোটাই পরম নিষ্ঠায় যে, তার উৎকর্ষতার মাত্রা নিজের চোখে না দেখলে ঠিক ছবি দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। আপাদমস্তক একজন সফল শিল্পী তিনি! তাঁর স্ত্রীও অত্যন্ত গুণী একজন সঙ্গীত শিল্পী ! এমন শিল্পী দম্পতির সার্বক্ষণিক উপস্থিতি আজকের আসরকে অন্যরকম এক মাত্রার আলোয় ভরালো, এমনই আমার মনে হলো!

রাত বারোটার একটু পরে বাড়ি ফিরে দেখি – মা ও বড় মেয়ে জেগে বসে আছে – আমার অপেক্ষায় । মেয়েকে আগেই ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়েছি ঘুমিয়ে যেতে । কিন্তু, ঘুমায়নি ওরা ! অলক্ষ্য এক অপরাধবোধে সংকুচিত হয়ে গেলাম। মা ও বাবার মতোই আমার জন্যে নীরব উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছেন এতো রাত অব্দি ! হায়রে মায়ের প্রাণ !

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধমন্ত্রী পলকের কাছে দাবি সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে বাবার হাতে মা খুন, বাঁচার আকুতি মৌমিতা ও মহিমার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে