মো. মাহাতাব আলী : নাটোরের বাগাতিপাড়ায় করোনা ভাইরাসের প্রভাবে তালপাখা পল্লীর তৈরি পাখা বিক্রি না হওয়ায় ব্যবসায়িরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। কাজ না থাকায় পাখা তৈরি কারিগররা অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। বিভিন্ন এনজিও-র ঋণচাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেকে।
সরেজমিন জানা যায়, নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নে সবুজ বৃক্ষরাজির সুশীতল ছাঁয়ায় ঘেরা হাপানিয়া গ্রাম। এর এক অংশ তালপাখা পল্লী নামে পরিচিত। এখানে অর্ধশত পরিবার পৈত্রিক ব্যবসা তালপাখা শিল্পে জড়িত। গ্রীষ্মকালে এ পাখার বেশ কদর বাড়ে। তাল গাছের পাতা থেকে তৈরি হাত পাখার শীতল বাতাসে ক্লান্ত মন শান্ত হয়।
বিদ্যুৎ শূন্য পরিবারে হাত পাখা পরম বন্ধু। প্রচন্ড দাবদাহ, ভ্যাপসা গরম ও বিদ্যুতের লোডশেডিং বেশি হলে হাতপাখার চাহিদা বাড়ে। এ পল্লী থেকে প্রতি গ্রীষ্ম মৌসুমে ৩ লক্ষাধিক হাত পাখা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। ব্যবসায়ি ও কারিগরদের স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলে।
কিন্তু বর্তমান মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিপাকে এ পল্লীবাসী। লকডাউনে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় তাঁরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তৈরি পাখা বিক্রি না হওয়ায় আর্থিক সংকটে ভুগছেন। এ পল্লীর প্রতি বাড়ির আঙ্গিনায় রৌদ্রে ছড়ানো-ছিটানো হাতপাখা বানানোর নানা উপকরণ। প্রতি বাড়ির পুরুষ ও নারী পাখা তৈরির কাজে সংপৃক্ত। পুরুষরা সংগ্রহকৃত তালপাতা কেটে পাখার সাইজ করেন। মেয়েরা নিপূণ হাতে পাখার কারুকার্য করেন।
এ পল্লীর আলা উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম, নাজিম উদ্দিন, খায়রুল ইসলাম, হানিফ আলী ও মকলেসুর রহমান তালপাখা তৈরির উপকরণ সংগ্রহ ও পাখা সরবরাহে সংপৃক্ত। শফিকুল ইসলাম জানান, চাঁপাই-নবাবগঞ্জ ও নঁওগা থেকে ছোট তাল গাছের পাতা সংগ্রহের পর রৌদ্রে শুকিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয়। কিছুদিন পর ভেজা নরমপাতা গোলাকার করে কেটে মাঝখানে দূ’খন্ড করা হয়।
প্রতি পাতা থেকে দূ’টি পাখা তৈরি হয়। পাতা সংগ্রহসহ প্রতি পিচ পাখার তৈরিতে খরচ হয় ৭/৮ টাকা। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি বিক্রি হয় প্রতি পিচ ১৪/১৫ টাকায়। কিন্তু এবার কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউনে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় সিংহ ভাগ তৈরি হাত পাখা বিক্রয় হয়নি।
এ পল্লীতে লাখ লাখ টাকা মূল্যমানের তৈরি হাতপাখা গচ্ছিত রয়েছে। পাখাশিল্পে সংপৃক্তরা দারুণ আর্থিক সংকটে রয়েছেন। হাতপাখা শিল্পী হুনুফা বেগম(৫৫) জানান, তিনি সাংসারিক কাজের ফাঁকে হাতপাখা’র কারুকার্য করেন। ১শ’ পাখা সেলাই ও রঙ করলে মজুরি পান ৬০ টাকা। বর্তমান কোরোনা ভাইরাসের কারণে তেমন কাজ না থাকায় আর্থিক কষ্টে রয়েছেন।
নাটোর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বাপ্পি লাহিড়ী জানান, দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কারণে তাদের বাণিজ্যে পূর্বেই ধ্বস নেমেছে। তবু বংশানুক্রমে পাখা শিল্পের সাথে জড়িত এই পল্লীর মানুষ। বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে, বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সরকারিভাবে স্বল্প সুদে, এই পল্লীর প্রত্যেক সদস্যকে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। সেই সাথে এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় খাদ্যসামগ্রী তাদের পল্লীতে দ্রুত পৌঁছানোর দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক‘এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ নাটোর কন্ঠকে জানান, সরকারিভাবে অতি দ্রুত, তাদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নাটোরের পাখা শিল্প টিকিয়ে রাখতে তাদেরকে দেওয়া হবে স্বল্প সুদে ঋণ।
নাটোরের বাগাতিপাড়ার হাপানিয়া গ্রামে, তালপাখা শিল্পের সাথে জড়িত যারা, অচিরেই তাদের মুখে ফুটবে হাসি, বাংলার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে যারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন, তাদের সুদিন ফিরবে, সরকারিভাবে স্বল্প সুদে অচিরেই তাদেরকে দেওয়া হবে ঋণ, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সবাই।