ছত্তীসগঢ়ের বস্তারে মাওবাদীদের জনসভায় দশ হাজার মানুষ
রেজাউল করিম খান: গত ২৭শে জুন ভারতের সংবাদপত্রে একটি খবর দেখেছিলাম। তার শিরোনাম ছিল, “ছত্তীসগঢ়ের বস্তারে মাওবাদীদের তিনদিন ব্যাপী জনসভায় হাজির ১০,০০০ মানুষ”। খবরটিতে এমন কিছু ছিল যা দেখে আমি আকৃষ্ট, আনন্দিত, চিন্তিত ও ভীত হয়েছিলাম। ফলে এই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। আকৃষ্ট হওয়ার কারণ-মাওবাদীদের এতো বড় সমাবেশ এর আগে কখনও দেখিনি বা শুনিনি । একজন সমর্থক হিসেবে এটি আমার জন্য খুশির খবর। চিন্তিত এই কারণে যে, এরপর ঐ এলাকায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী হয়তো হামলা চালিয়ে ওদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করবে। এখনও ভয়ে আছি, এই খবর ফেসবুকে দিলে আমার কোনো ক্ষতি হবে কিনা, এই ভেবে!
বেশ কিছুদিন আগে অরুন্ধতী রায় লিখেছিলেন, ‘ইন্দ্রাবতীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত যেসব অঞ্চলে মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাকে পুলিশ ‘পাকিস্তান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। সেখানে গ্রামগুলো মানুষশূন্য আর জঙ্গল মানুষ ভর্তি। যে শিশুদের স্কুলে যাবার কথা, তারা জঙ্গলে দৌঁড়ায়। ঊনের বিদ্রোহীরা খুবই বেপরোয়া। এদের ঘিরে রয়েছে আধা সামরিক বাহিনী। যাদের আছে আধুনিক অস্ত্র, পর্যাপ্ত অর্থ, গোলাবারুদ, গণমাধ্যম ও ভারতের উদীয়মান পরাশক্তি হয়ে ওঠার দম্ভ। অন্যদিকে এর বিপরীতে রয়েছে সাধারণ গ্রামবাসী। তাদের হাতে প্রচলিত অস্ত্র। জঙ্গলের এ যুদ্ধ মাওবাদী ও ভারত সরকারের মধ্যে যুদ্ধ। মাওবাদীরা নির্বাচনকে একটি প্রতারণা ও সংসদকে শুয়োরের খোয়াড় মনে করে। ওরা গ্রামের গেরিলা বাহিনী। মনে হলো ওরা মরার জন্য তৈরি হয়ে আছে। কমলার বয়স ১৭ বছর। তার কোমরে ঘরে তৈরি পিস্তল। পুলিশ যদি তাকে পায় তো হত্যা করবে। প্রথমে হয়তো তাকে ধর্ষণ করবে। এরজন্য পুলিশকে কেউ কোনও প্রশ্ন করবে না।’
তো আসুন দেখি, ‘পিপলস ম্যাগাজিন’ নামের ঐ পত্রিকাটি কী লিখেছে, ‘প্রথাগত রাজনৈতিক জনসভা নয়। রাজনৈতিক ভাষণের পাশাপাশি চলল, নাচ, গান, খেলাধুলো ও নানা সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ। চলতি মাসের ১৮ থেকে ২০ তারিখ ছত্তীসগঢ়ের সুকমা ও বিজাপুর জেলার সীমান্তে বড়োসড়ো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করল মাওবাদীরা। সুকমা, বিজাপুর ও দান্তেওয়াড়া জেলা থেকে হাজির ছিলেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। নারয়ণপুর জেলা থেকেও এসেছিলেন অনেকে। ছত্তীসগঢ় পুলিশের দাবি, প্রায় ৫ বছর পর বস্তার অঞ্চলে সাধারণ মানুষকে নিয়ে এত বড়ো জনসভা করল মাওবাদীরা।
জনসভায় দলের নেতাদের মধ্যে হাজির ছিলেন সিপিআই(মাওবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক বাসবরাজু, ১ নং ব্যাটেলিয়নের প্রধান মান্ডবি হিদমা, কোসা, দেবজি ও সুজাতা (প্রয়াত নেতা কিষেণজির স্ত্রী)। তবে তিনদিন ব্যাপী জনসভার কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। কারণ মোবাইল ফোন নিয়ে কাউকে জনসভায় যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। মনে করা হচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই ওই কর্মসূচির ভিডিও ও প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করবে মাওবাদীরা।
কেন এই বিশাল জনসভা? পুলিশের বক্তব্য, গত ডিসেম্বর মাসে মারা গিয়েছেন দণ্ডকারণ্য বিশেষ জোনাল কমিটির সচিব রামান্না। রামান্নার স্মৃতিচারণ ও কমিটির নতুন সম্পাদক নির্বাচন ছিল এই কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য। পাশাপাশি ছিল শক্তি প্রদর্শনের লক্ষ্যও। এছাড়া গত ২১ ডিসেম্বর বস্তারে মাওবাদীরা সিআরপিএফের ওপর হামলা চালিয়ে ১৭জন জওয়ানকে মারে। ঘটনাস্থল থেকে তারা যত অস্ত্র লুঠ করেছেন, সেগুলিও জনগণকে দেখানো হয়। জনসভায় উপস্থিত এক মহিলা জানিয়েছেন, জনসভার শুরুতে এক নেতা মাওবাদ ও বস্তারের ইতিহাস সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন।
জানা গেছে, শুরুতে বরিষ্ঠ নেতারা রামান্নার উত্তরসুরি নিয়ে আলোচনা করেন। তারপর আলোচনা হয়, কৌশলগত প্রতি আক্রমণ নিয়ে। প্রতি বছরই বর্ষায় কিছু সামরিক কর্মসূচি চালায় মাওবাদীরা। তিনদিন ধরে সভা স্থলের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ৩০০ জন সশস্ত্র মাওবাদী ও ৫০০ জন গণ মিলিশিয়া। তবে পুলিশ কর্তাদের একাংশের ধারণা, এটি কোনো সাধারণ জনসভা নয়। সম্ভবত কোনো উঁচু স্তরের কমিটির সম্মলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ওই তিনদিনে। সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ ও প্রকাশ্য সভা তারই অংশ।’