মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: জন্মতেই অবরুদ্ধ- রেজাউল করিম খান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরুর পূর্বেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। প্রাদেশিক পরিষদের যে সকল সদস্য ১০ এপ্রিলের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছতে সক্ষম হন তাদের নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। তার নির্দেশেই অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরো কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া প্রণয়ন করেন। এরপর ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এই ঘোষণাপত্রের আইনগত দিকগুলো সংশোধন করে একে পূর্ণতা দান করেন। ১৭ এপ্রিল তারিখে মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তী নাম মুজিবনগর) গণপরিষদের সদস্য অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এদিনই ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়া হয়। এর ফলে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারও বৈধ বলে স্বীকৃত হয়। এ ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলের মধ্যে চেইন অফ কমান্ড স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সংক্ষিপ্ত রূপ: যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারষ্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসাবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করব।
১৯৭২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর তারিখে যখন দেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হয় তখন এই ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতার সমাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর জনগণ যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, যার প্রকাশ ১০ই এপ্রিলের ঘোষণাপত্রে পাওয়া যায়, তাই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। বিষয়টি পরিষ্কার, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বাঙালিদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। তাদেরকে বিতাড়নের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। এই যুদ্ধে জনগণের মূলধন ছিল তাহাদের ‘বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনা’। অতঃপর জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ও পরে সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
তাহলে মোটা দাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে যা বোঝা যাচ্ছে, তা হলো-সাম্য: প্রজাতন্ত্রের সবাই সমান বলে গণ্য হবেন, মানবিক মর্যাদা: সকল নাগরিককে মানবিক মর্যাদা প্রদান করতে হবে (হিউম্যান রাইটস), সুবিচার: বিচার ব্যবস্থা মাধ্যমে সুবিচার এর ব্যবস্থা থাকবে, গণতন্ত্র: দেশের জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত হবে। কিন্তু বাস্তবে সাধারণ মানুষের কাছে এগুলি দৃশ্যমান নয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার ৪৯ বছরে আমরা কী পেলাম? শত্রু মুক্ত হওয়ার চার বছরের মধ্যেই এলো সামরিক শাসন। জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা পারলেন না কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ট দলটি বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শনে ব্যর্থ হলো। এভাবেই চলছে, “আত্মীয় প্রতিপালন এবং পকেট পরিপূরণ”।
স্বাধীনতা সম্পর্কিত কয়েকটি প্রশ্ন তোলা বারণ হয়ে গেছে। সেই কারণে যুদ্ধে শহীদের তালিকা তৈরি হয় নি। পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকার-আলবদরের হাতে গণশহীদ কত আর মুক্তিযোদ্ধা কতজন শহীদ হয়েছেন, তার সংখ্যা নিরুপণ করা যায় না। দেশে বীরাঙ্গনা কত আর গেজেটভুক্ত কত, তার হিসেব মেলানো যায় না। এইসব লেজে-গোবরে করে ফেলেছে মাত্র আড়াই লাখ মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি মন্ত্রণালয়। সব কাজ তো করে ইউএনও-ডিসি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, তাহলে তাদের প্রয়োজন কী? ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিটুকুও আদায় করতে পারে নি। পালিত হয় ভালোবাসা দিবস, কন্যা দিবস, বাবা দিবস, হাত ধোয়া দিবসসহ কতশত দিবস। কিন্তু জীবন দিয়ে একটি দেশের জন্ম দিলো যারা, তাদের জন্য একটি দিবস পালিত হয় না। যদিও বেসরকারিভাবে ১লা ডিসেম্বর ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ পালনের ঘোষণা আছে, কিন্তু আজও তা সরকারস্বীকৃত নয়।
সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞ: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থসমূহ, সংবাদপত্র, গোলাম মোহাম্মদ কাদের, আতিউর রহমান, মোস্তফা হোসেইন, আবীর আহাদ, কাবেদুল ইসলাম, সলিমুল্লাহ খান, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ।