“পিতা”-তন্ময় ইমরানের ছোটগল্প

0
305
তন্ময়

পিতা (গল্প)-তন্ময় ইমরান

ভূমিকম্পের সপ্তমদিনে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে মরতে হবে। আমি আটকা পড়েছি বাড়ির পাশের সরু প্যাসেজটায়, ছয়টা কুকুরের বাচ্চার সাথে৷ আপনারা হয়তো ভেবে অবাক হচ্ছেন আমি কিভাবে সাতদিন আটকা অবস্থায় বেঁচে থাকলাম! আসলে আমি ভূমিকম্পের পর তৃতীয়দিন পর্যন্ত ঠিকঠাক বেঁচেই ছিলাম। তার পরের চারদিন কোনোমতে বেঁচে আছি। না খেয়েই, বুকে তৃষ্ণা নিয়ে।

গত সাতমাস আগে কালু, যে কিনা আমার বাসার পাশের নেড়িকুকুর, যাকে কিনা আমি মাঝে মাঝে খাবার দিতাম, হুট করেই একরাতে আটটা বাচ্চা দিয়ে দিলো। একটা বাচ্চা অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল। সেটা মারা যাওয়ার পর কুকুরগুলোকে বাড়ির পাশের সরু প্যাসেজে সরিয়ে এনেছিলাম। ইচ্ছা ছিল একটু বড় হলেই তাদের ছেড়ে দিব। কিন্তু তা আর হলো কই! মায়া বড় খারাপ। তারা থেকে গেল। দ্বিতীয়মাসের মাথায় একটা বাচ্চা কে যেন চুরি করেও নিয়ে গেল।

বাড়ির পাশের প্যাসেজ সরু হলেও বেশ লম্বা৷ একপাশে উঁচু দেয়াল, আরেকপাশে আমার দোতলা বাড়ি। প্যাসেজের শেষমাথায় একসময় একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষের বুকের সমান লম্বা এবং তিন হাত ইন্টু দুই হাত দৈর্ঘ্য-প্রস্থের পাকা মুরগির ঘর করেছিলেন বাবা। অবশ্য মুরগি ঘরে তোলার আগেই তিনি মারা যান। তারপর থেকে ওটা পরিত্যক্ত ছিল। কুকুরগুলোকে প্যাসেজে নিয়ে আসার পর ওটা হয়ে উঠেছিল বেইজক্যাম্প৷

বেইজক্যাম্পে ছোট্ট ড্রামে পানি রাখতাম। আর প্রচুর ড্রাই ফুড। বিস্কিট, বনরুটি। একটা পুরনো ট্রাঙ্কে ছোটতালা দেয়া অবস্থায় থাকতো৷ কুকুরগুলোর জন্যই৷ আমি স্ত্রী-পুত্র-মা সহ থাকতাম দোতলায়। নিচতলাটা অফিস ভাড়া দেওয়া। বারবার উপর থেকে খাবার কে আনবে। ঝক্কি এড়াতে কুকুরদের জন্য জমিয়ে রাখা এই খাবারগুলোই আমাকে ও কুকুরগুলোকে ভূমিকম্পের পরের প্রথম চারদিন ঠিকঠাক বাঁচিয়ে দিয়েছিল৷ হাল্কা খাবারগুলো দিতাম সকালে আর বিকালে। দুপুরে আর রাতে দিতাম ফার্মের মুরগির মাংস ও সুপের সাথে ভাত।

ভূমিকম্পের দিন ছিল আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন৷ আমি কেবলই নিচে নেমেছিলাম কুকুরের বাচ্চাগুলোকে দুপুরের ভাত-সুপ-মাংস খাওয়াবো বলে। তারা অবশ্য বাচ্চা ছিল না আর। কৈশোরে পা দিয়েছিল। মা কুকুরটা প্যাসেজের বাইরে, রাস্তায় অপেক্ষা করছিল। তাকে বাচ্চাদের পরে খাওয়াতাম। আমি নিচে নামার পর থেকেই কুকুরগুলোর মধ্যে একটা অস্থির ভাব খেয়াল করছিলাম। তারা প্যাসেজ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিল। প্যাসেজের ছোট্ট লোহার গেইট আটকানো থাকায় বের হতে পারছিল না।

আমি তাদের শান্ত করার চেষ্টার এক মিনিটের মাথায় ভূমিকম্প শুরু হলো। হুড়মুড় করে বাড়ির বাউন্ডারি দেয়ালটা পড়ে গেল এক মিনিটের মাথায়। চারিদিকে আর্তনাদের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এসবকিছুর ভেতরে বাঁচার ইন্সন্টিক্ট কাজ করছিল। তাই ছুটে ছোট্ট মুরগির ঘরটায় আশ্র‍য় নিয়েছিলাম। সাথে কুকুরগুলোও। খুব জড়সড় হয়ে ছিলাম আমরা। কুকুরগুলো কুইকুই করছিল। একটা সময় মাটির কম্পন থামলে আমি আবিষ্কার করলাম সম্ভবত বাবার মুরগির ঘর আমাকে ও কুকুরগুলোকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। প্যাসেজের একটা বড় অংশ দেয়াল পড়ে আটকে গিয়েছে। বিশেষত বের হওয়ার রাস্তা৷ আমাদের পুরনো ইটের বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। পাশের নতুন দালান, বাড়ির সামনের ১০ ফিট রাস্তার ওপাড়ের দালান, কিছুই হয়তো আস্ত নেই। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি একঘণ্টার মধ্যে মোবাইল নেটওয়ার্ক ফিরে এসেছিল। আমি জানতে পেরেছিলাম আমার বউ বাচ্চা মা বেঁচে আছে। তারা গিয়েছিল স্কুলে। ছেলের রেজাল্টের দিন ছিল। নাতির জেদে দাদীকেও নেয়া হয়েছিল সাথে। ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পর স্কুল মাঠে জড়ো হয়েছিলেন সবাই। কেউ কেউ আহত হয়েছেন সেখানে। তবে আমার পরুবারের সবাই ঠিক আছে৷

স্ত্রী আমাকে জানালো- ভূমিকম্পের মাত্রা ৮ দশমিক ২। পুরো শহর বিধ্বস্ত। আমি আটকা পড়েছি তবে বেঁচে আছি, আর খাবার দাবার আছে বলে কিছুটা শান্ত হয়েছিল সে। বলেছিল শিগগিরই উদ্ধার করতে পারবে।

আমি ভেবেছিলাম সর্বোচ্চ দুইদিন হয়তো লাগবে। কিন্তু এর বেশ কয়েকঘণ্টা পর আমি জেনে গিয়েছিলাম পুরো শহরে আমার মতো এমন অনেকেই আটকা পড়েছেন। কাজেই চার থেকে পাঁচদিন লাগবে।

তা বেশ। ভেবেছিলাম সমস্যা হবে না। খাবার ও পানি যেহেতু ছিল আমি হিসেব করে দেখেছিলাম আমরা ছয়সাতদিন বাঁঁচবো। কিন্তু সপ্তমদিনে আমি বুঝলাম আমি আসলে মরতে যাচ্ছি। কুকুরগুলো নিয়ে মরতে যাচ্ছি।

মোবাইলের চার্জ শেষ হবে হবে করছিল বলে দ্বিতীয়দিন বিকালে ২০ পারসেন্ট বাকি থাকতেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তারপর ষষ্ঠদিন পর্যন্ত কেবল উদ্ধারের অবস্থা জানতে পাঁচ-ছয়বার খুলে স্ত্রীকে ফোন দিয়েছি। স্ত্রী হতাশা নিয়ে বলেছে আরো দিন চারেক সর্বোচ্চ।

খুব অদ্ভুত হলেও সত্যি কুকুরগুলো শেষের কয়েকদিন ক্ষুধার জ্বালায় নিজেদের মধ্যে মারামারি করলেও শেষ বিস্কিটের প্যাকেটটা যখন আমি খুলি, কেউ খেতে আসেনি। তাদের চোখের ভাষায় ছিল- বাবা তুমি খাও তো৷ আমরা অনায়াসে বা খেয়ে তিন চারদিন থাকতে পারি! আমি অবশ্য একা খাইনি। জোর করে সবাইকে দিয়েছি। শেষ পানির বিন্দুও ফুরিয়েছে তিনদিন আগে। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম আমরা মরতে যাচ্ছি। আমি তো বটেই কুকুরগুলোও নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল।

সপ্তমদিন সকালে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর স্ত্রীকে ফোন দিয়ে বললাম- আরো তিনদিন অনায়াসে বাঁঁচবো। কিন্তু ফোনের চার্জ নেই। তাই ফোন বন্ধ পাওয়া যাবে। ডাহা মিথ্যা কথা। কিন্তু বলতে হলো। আমি মারা গেলে কুকুর উদ্ধার করতে কেউ এই পর্যন্ত খুঁড়বে না। আমি এই কুকুরদের কাছে বাবা। তারা আমার সন্তান। তাদের বাঁচাতেই হবে।

আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছিল। সেটা বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করেছিলাম অষ্টমদিন বিকাল পর্যন্ত সময় নিয়ে।

একটা ধারালো রড দেয়ালের বিম ধসের কারণে বেরিয়ে এসেছিল। সেটা দিয়ে নিজের হাত বেশ খানিকটা কেটে নিলাম। কুকুরগুলোর পানির পাত্রে রক্ত জমাতে লাগলাম। না যতোটা যন্ত্রণার ভাবছেন ততোটা অনুভূত হচ্ছিল না। কেননা এমনিতেই আমার শরীরে বোধ কমে গিয়েছিল, স্নায়ুগুলো মস্তিষ্কে ঠিকঠাক সিগ্নাল দিচ্ছিল না। ঘণ্টা দুয়েক রক্তপাতের পর অনেকটাই রক্ত জমলো। আমি কুকুরগুলোর মুখের সামনে চামচ দিয়ে ধরে ধরে বহুকষ্টে তাদের গলা ভেজালাম৷

এই প্রথম রক্তের স্বাদ তারা পেল। তবে তৃষ্ণার্ত থাকায় তারা বুঝলো না আসলে কী পান করছে। তিনদিন পর গলা ভেজানো বলে কথা।

পরের ধাপ ছিল নিজের দেহের মাংস কাটার ধাপ। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু একটা খুঁজছিলাম। সিনেম্যাটিকভাবে পেয়েও গেলাম৷ কোনও এক কোরবানি ঈদের জন্য কেনা হয়েছিল একটা চাপাতি। জং ধরে গিয়েছিল। মুরগির ঘরটার কোণায় অন্য আর দুচারটা বাতিল সরঞ্জামের সাথে ছিল। এটি আমার কাজ খুব সহজ করে দিল৷ আমি ছয়টা কুকুরের দিকে তাকালাম। তারা বিভিন্ন ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। কি সুন্দর আমার বাবুগুলো! চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। আমি ওদের মাঝে আমার নিজের সন্তানকেও ওই একই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকতে দেখলাম। হ্যালুসিনেশন আর কি!

তারপর দাঁতের নিচে নিজের টিশার্ট রেখে জং ধরা চাপাতি দিয়ে এক কোপ চালালাম হাতের কব্জিতে। না কাজটা কঠিন হলো। একবারে হলো না। আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম কিংবা চাপাতি ভোঁতা ও জং ধরা। জ্ঞান হারালাম। তার আগে হাতটা কোনভাবে কুকুরদের পানির পাত্রের উপর রাখলাম। যাতে এক ফোঁটা রক্তও নষ্ট না হয়। আমি তাদের পিতা, তাদেরকে বাঁচাতে হবে।
গত সাতমাস যতোবার তারা বিপদে পড়েছে কেবল আমার দিকে তাকিয়েই সেটা প্রকাশ করেছে। তারা জানে- বাবা আছেন, কোনো চিন্তা নেই। এই বিশ্বাস আমি ভেঙ্গে দিব কিভাবে! কুকুরের বাবার তো তাদের মতোই বিশ্বস্ত হওয়ার কথা, তাই না! আমি নিজেকে মানুষ না ভেবে বিশ্বস্ত কুকুর ভাবা শুরু করেছিলাম।

জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম হাত ঝুলে আছে। আরো দুই কোপ চালালাম। হাত বিচ্ছিন্ন হলো। আবার জ্ঞান হারালাম। কতোক্ষণ পর জ্ঞান ফিরেছিল জানি না। জ্ঞান ফিরলে বিচ্ছিন্ন কব্জিকে ১২ ভাগে ভাগ করেছিলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী জমানো রক্ত ও এক টুকরা করে নিজের মাংস কুকুরগুলোকে খাওয়ালাম। আবার জ্ঞান হারালাম।

অষ্টমদিন জ্ঞান ফিরতেই বাকি মাংসগুলো তাদের দিলাম। আমার হিসেবে আর বড়জোর দু-তিন পর আমরা উদ্ধার হবো। কিন্তু আমি আজকের দিনটাও বাঁঁচবো না। দুবার হালকা খাবারের পর কুকুরগুলো কিছুটা সাড় ফিরে পাচ্ছে। মানুষের রক্ত-মাংসের মতো এমন উদ্দীপক খাবার পৃথিবীতে আর কোনকালে কিবা ছিল!

আমার মাংসে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আবার হাত কাটলাম। আবার রক্ত জমালাম। জ্ঞান হারালাম। তারপর আবার তাদের পান করতে দিলাম৷ এবার আমি মরে গেলে কোনো সমস্যা হবে না। আমাকে তারা খাবে। এবং অনায়াসে চার-পাঁচদিন বেঁচে থাকবে। আমি শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে দিলাম৷ সবশেষ চাপাতি নিজের গলায় ধরলাম।

***
ভূমিকম্পের ১২ দিন পর রায়হানের লাশ উদ্ধার হয়েছিল ধ্বংসস্তুপ থেকে। তার একহাতের কব্জি কাটা ছিল। ওই হাতেরই উপরের অংশেও কাটা ছিল। শরীরে বেশকিছু জখম। যা দেখে উদ্ধারকর্মীরা খুব অবাক হয়েছিলেন। তারা আরো অবাক হয়েছিলেন অন্য আরেকটি দৃষ্য দেখে। রায়হানের বুক থেকে পেটের উপর দুইদিকে তিনটি তিনটি করে মোট ছয়টি কুকুর সিনেমার সাজানো দৃশ্যের মত মরে পড়েছিল। ঠিক যেন ঘুমন্ত পিতার উপর ঘুমিয়ে আছে ছয় সন্তান।

উদ্ধারকর্মী কিংবা পৃথিবীর কারোই জানার কথা না রায়হান সাহেবের পরিকল্পনা কাজে লাগেনি। তিনি যেমন সত্যিকারের পিতা, তার সন্তানরাও তাই। তারা বাবার মাংস কিভাবে খাবে!

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“বৃক্ষফুল “- রাজেশ চন্দ্র দেবনাথের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“কবি থেকে ঈশ্বর হও”- শীলা ঘটকের কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে