মেঘ পাহাড়ের বান্দরবান
কাজী সোহেল
ভয়ে আতংকে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নামলো। ছোটবেলা থেকে উচ্চতা ভীতি আমার। বাসের জানালা দিয়ে দেখি উঁচু পাহাড়ের গায়ে চিকন ফিতের মতো দাগ। সেগুলো নাকি রাস্তা! এই বাস নাকি সেসব রাস্তাতেই যাবে।
বৃহষ্পতিবার ফিরছিলাম কোর্ট থেকে। পেশায় আইনজীবী হলেও কবিতা আমার নেশা তাই বৃহস্পতি ও শুক্রবার এই দুটো সন্ধ্যা থেকে রাত আমি কবিতা ও কবিবন্ধুদেকে দেই, নিজেকে দেই। তো ফিরছিলাম রিক্শায় করে SonyEricson T100 বাটন সেটটা বেজে ওঠলো।
– সুহেল ভাই
– বলেন হাসান ভাই, আছেন কেমন?
– গাড়িতে ওঠেন।
– মানে কি! কথা নাই বার্তা নাই, মিয়া কন গাড়িতে উঠেন।
– ভালে লাগতেছে না। আসেন আপনারে নিয়া বেড়াইতে যামু।
হাসান বন্ধু আমার। কক্সবাজারের। স্বল্পভাষী এই মানুষটাকে খুব পছন্দ করি আমি। তাকে ‘না’ করা সম্ভব নয়। তাই থাকলো কবিতা ও শাহবাগ। আমি চললাম প্রিয় বন্ধুর ডাকে।
বাড়ি ফিরেই ফোন দিলাম বন্ধু জামিল জাহাঙ্গীরকে।
– বাসায় আয়, একটু জরুরি।
– ঠিকাছে বন্ধু।
জামিলের কাছ থেকে ফোল্ডিং ক্যামেরা ফোনটা নিলাম। আমার ছোট ট্রাভেল ব্যাগটা গোছাতেই মা জিজ্ঞাসা করলেন,
-কই যাস?
-কক্সবাজার, হাসান যেতে বললো।
হাসানকে মা ভালো ভাবে চেনেনই না শুধু, স্নেহও করেন তাই ‘ভিসা’ সিল লেগে গেলো।
সাড়ে দশটায়, বাস স্টপেজে পৌছে বাসে ৪৫০ টাকা দিয়ে একটা সিট খরিদ করে ব্যাগটা মাথার ওপর তাকে রেখে দিলাম ঘুম। কারন জীবন তো আর নাটক নয় যে বাসে আপনার পাশে জয়া আহসান বা তানজিন তিশা বসবে! আমার পাশে বসলেন, এক উদ্বিগ্ন মধ্যবয়স্ক। তবে বাসে অনেক আনন্দিত মুখও ছিলো। হয়তো তারা প্রথমবার সাগরের ডাকে সাড়া দিচ্ছে। তাদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশে। সোয়া এগারোটায় বাস ছাড়লো। পৌনে বারোটায় আমার ঘুম জমে ক্ষীর। যখন ঘুম ভাঙলো তখন চট্টলার অলংকার মোড় এসে গেছে। বাস থামায় আমি ঝটপট নেমে একটা হোটেলে ঢুকে ডুবো তেলে ভাজা পরোটা (আসলে বিশাল সাইজ লুচি) আর কালাভুনা খাচ্ছি আর ভাবছি এতো রাতে এহেন গুরুপাক খাওয়া ঠিক হবে? তাই সংগে নিলাম সবজি, মগজ কে বুঝ দেবার জন্য। সেদিনের খাবারটা চমৎকার ছিলো বুঝি কারন আজও সে কথা ভাবতে ভালো লাগছে বেশ।
এর পর বসে উঠে যখন ঘুম ভাঙলো তখন সকাল হয়ে গেছে, বাস চলছে ঝড়ের গতিতে। লক্ষ্য খুব কাছে চলে এলে কুশলী দৌড়বিদ জমানো শক্তির শেষটা দিয়ে যেমন প্রাণান্ত দৌড়ায় বাসটাও সাগরকন্যায় পৌঁছুতে তেমনি ছুটছিলো। হেমন্তকাল। ভোরের আলোয় সবুজ চিরে চলে যাওয়া পিচঢালা পথ। দুপাশের প্রকৃতি ও জনজীবন যতোটা পারা যায় কৌতুহলি চোখে মনের ভেতর পুরে নেয়া।
বাস এসে থামলো কক্সবাজার। আয়েশী ভঙ্গীতে নেমেই দেখি চেনা হাসিমুখ নিয়ে হাসান দাঁড়িয়ে। একটা রিকশায় চড়ে আমরা চলে গেলাম ‘রুমালিয়ার ছড়া’য়, হাসানের বাড়িতে। সেদিন ভাবীর আথিত্যে দুপুরবেলা বেশ খাওয়া দাওয়া হলো। হেমন্তসন্ধ্যা। হাসান বললো চলেন বাইরে। একটা রিকশা নিয়ে লাবনী বিচে যাই!
সমুদ্রে সন্ধ্যা নামছে। ছোট ছোট ঢোউগুলো ধারন করছে স্বর্ণাভ রুপ! আমরা অপেক্ষাকৃত কম ভিড়ের একটা জায়গায় বসে আছি। মনে হলো বন্ধুত্বেরও নানান রকম হয় মনন ও স্বভাবের ওপর ভিত্তি করে করে। হাসানের কম কথা বলা স্বভাব ওর সাথে থাকলে ভর করে আমার ওপরও। তাতে কি! কিছু কিছু সময় মুখে সারাক্ষণ বকবক না করেও হৃদয়ে হৃদয় কথা বলে যায়।
নয়নের আমাদের আরেক বন্ধু কক্সবাজারের। ওর দোকানে দেখা করে, মোগলাই পরোটা খেতে খেতে খানিক আড্ডা দিয়ে ফিরলাম রুমালিয়ার ছড়া।
ভোর হলো। হাসান রেডি হয়ে আমার ঘরে টোকা দিলো। আমি রেডি হয়েই ছিলাম। দুই বন্ধু পথে নামলাম। কক্সবাজারের হেমন্তসকাল। ঠিক শীত নামেনি কিন্তু ভোর জানিয়ে দেয় তিনি আসছেন। মনের কিছু মিল না হলে কি আর বন্ধুত্ব হয়! আমরা কোথাও গেলে বেরিয়ে পড়ি তখনি ভোরের শিশু আলো যখন হামাগুড়ি দেয় পূবাকাশে। একটা রিকশা বাস স্টপেজে নিয়ে যায় আমাদের। কক্সবাজার টু বান্দরবান বাসের দুটি টিকিট কেটে ফেলি।বাস ছাড়তে একটু দেরি আছে বলে দুজনে একটা ছোট নাস্তার দোকানে ঢুকি। বসতেই কম তেলের আগুন গরম পরোটা দিয়ে গেলো। অন্য কোন অপশন নেই কিন্ত তরকারি অপশন চারটা। আলু ও সবজির ভাজি, ঘন বুটের ডাল, লটপটি ( মুরগীর গিলা কলিজা মাথা গলা আলু দিয়ে ভুনা) এবং ডিমপোচ। আমি লটপটি দিতে বললাম সাথে ডিমপোচ। দুজনেই দুটো করে পরোটা খেয়ে উঠে পড়লাৃম। দুজনের একজনও চা খাই না তেমন। তাই একটা লোকাল পত্রিকা কিনে নিয়ে এসে উঠে গেলাম বাসে। বাসটি কক্সবাজার – চিটাগাং এর রোড ধরেই চললো। সাতকানিয়া এসে পুরো ডানে মোড় নিয়ে চিটাগাং – বান্দরবান হাইওয়ে। একটুখানি যেতেই উচু নিচু পাহাড়ি পথ। দারুন রোমাঞ্চকর যাত্রা। বাস এসে থামলো বান্দরবান বাস স্টপেজে। সবার সাথে নামলাম দু’বন্ধু। এদিক সেদিক ঘুরছি। সেসময় দেখলাম ভ্যানে করে পাঁকা পেঁপে বিক্রি করছে। বললাম,
– চলেন হাসান ভাই পেঁপে খাই।
– কেমনে কাটবেন, কেমনে খাইবেন। ঝামিলা।
– কোন ঝামিলা হবে না, আপনি খালি দেখেন।
এক ফ্লাস্কে করে চা বিক্রি করছিলো এক ছেলে। ইশারায় ডাকলাম তাকে। বললাম দুইটাকার রঙ চা দিয়ে চায়ের চামুচ একটা ধুয়ে দাও। সে যত্ন করে ধুয়ে দিলো চামুচটি। তারপর কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকালো আমার কাণ্ড দেখতে। পেঁপেওয়ালার কাছ থেকে পেঁপেটা নিয়ে চামুচে গোড়া ঢুকিয়ে সহজেই ওটাকে লম্বালম্বি সমান দুভাগে ভাগে ভাগ করে নিলাম। যা বঙ বের হলো যেনো খয়েরী আগুন! চামুচ আলতো করে বীজগুলো ফেলে দিয়ে যেমন করে আইসক্রিমের বক্স থেকে লোকে আইসক্রিম খায় তেমনি করে আমি বিশাল পেঁপের অর্ধেকটা খেয়ে পেঁপের খোসার একটি পাতলা নিপুন বাটি বানিয়ে দেখালাম হাসানকে।
– আপনি ভাই একখান জিনিষ! বলে সে হাসতে লাগলো।
পেঁপেওয়ালা বললো, ‘অনেক পেঁপে কাটলে একটা এমন রঙের পেঁপে বের হয়।’
কোথাও গেলে সে এলাকার কাঁচাবাজার না দেখলে আমার শান্তি নাই। বাজার দেখলে অনেক কিছু বোঝা যায়, যা হয়তো অনোক ঘুরেও বোঝা যায় না। বাজার দেখে শেষ করবো এমন সময় বাজারের পেছনেই দেখি খরস্রোতা সাংগু বা শঙ্খ নদ। চমৎকার নদীটি দেখে হাসানের তাড়ায় ফিরলাম বাসস্টপেজ। প্রায় ভোররাতের দুইপরোটা আর পেঁপে পেটে আর কতোক্ষন থাকে বলুন! বাসস্টপের পাশেই দেখলাম, বিশাল কড়াইয়ে ডাউস সাইজের সিঙাড়াগুলো তেলের তলে সোনারঙ ধারন করছে, তখনো নামেনি বড় থালায়। আমার মতো সিঙাড়াপ্রেমীকে এ দৃশ্য নতুন প্রেমসম আকর্ষণে কাছে টেনে নিলো। অবস্থা বুঝে হাসান বললো, আপনি সিঙাড়া নামলে খেতে শুরু করেন।। আমি টিকিট কেটে আসছি থানচির বাসের। সেসবে মনোযোগ নেই আমার। বসেই বললাম, ‘পেয়াজ মরিচ দিন’ ঝকঝকে কাচের বাটিতে তা এলো। এরপর এলো তপ্ত উনুন থেকে সরাসরি প্লেট ভর্তি করে দশটা সিঙাড়া। পাঠক কি ভাবছেন কে জানে! বিশ্বাস,করুন আমি বলিনি প্লেট ভর্তি করে সিঙাড়া দিতে। ওরাই দিলো। বোধহয় আমার দৈর্ঘ্য প্রস্থ দেখে আন্দাজ করেছে। খেতে যাবো, একজন এসে তার ওপর ছিটিয়ে দিলো খানিক বিটনুন। আহা হা! পেঁয়াজ মরিচ বিটনুন মেশানো গরম সিঙাড়া মুখে দিয়ে জার্ট ফিলিং বেহেস্ত। মাত্র দুটো সিঙাড়া খেয়েছি। এসময় হাসান টিকিট হাতে নিয়ে তাড়া দিলো বাস নাকি ছেড়ে দিচ্ছে। ভাবলাম… ছেড়ে যাক… না খেয়ে উঠবো না আমি। হাসানকে বললাম, কথা বলবেন না, খান। সে করুন মুখে খেলো একটা। সে একটা খেতে খেতে আমি আরো দুটো মেরে দিলাম। রসিক পাঠক জানেন তো সিঙাড়া সহজে ঠাণ্ডা হয় না। নইলে কি আর থালার পাঁচটা সিঙারা রেখে আসি আমি! বাইরে এসে দেখি বাস ঘুরিয়ে আসলেই চলতে শুরু করেছে। দৌড়ে উঠলাম কোনমতে। আসলে বান্দরবানের রাস্তা সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই ছিলো না। তাই ভিষণ রকমের খাড়া পাহাড়ি অপরিসর পথ আতংকিত করে তোলে। আশে পাশে কথা বলে যেসব তথ্য পেলাম তাতে আতংক বাড়লোই কেবল। কন্ডাকটর বললো,
– এ রাস্তায় এক্সিডেন্ট খুব কম হয়। দুইটা মাত্র হইছিলো, কোন লাশ খুঁইজা,পায় নাই।
ড্রাইভারের পাশে বসায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম এই পথে চালাবার প্রশিক্ষণ কোথায় নিয়েছেন?
– টেনিং লমু কই! চালাইতে চালাইতেই শিখছি।
আমার মুখ দিয়ে শুধু ‘ওহ’ বের হলো। আমার অবস্থা দেখে হাসছিলো হাসান।
হঠাৎ করেই সব আতংক কেটে গেলো আমার। যখন দেখলাম দুটি আদিবাসী শিশু বাসে ছুটোছুটি করে খেলছে। আমার তখন চোখে পড়লো এক আদিবাসী বৃদ্ধা যিনি তাজা একটি ফুল পরে আছেন চুলে। কী সুন্দর দৃশ্য!
আস্তে আস্তে বাসের রাইরের রুপও ধরা দিতে লাগলো আজন্ম ঢাকাবাসী চোখে। মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো পরিবেশ। প্রথম ধন্যবাদ জানালাম হাসানকে ট্যুরের জন্য। নীলগিরি এসে বাস প্রায় অর্ধেকটাই ফাঁকা হয়ে গেলো। আমরাও নেমে একটু দেখলাম আশপাশটা। বাস এবার ছুটবে থানচির পথে। বন্ধু জামিল জাহাঙ্গীরের ক্যামেরা ফোনে একটা দুটো করে ছবিও তুললাম তখন। সাতমাইল, পাঁচমাইল, হেডম্যানপাড়া নানা নামের পাহাড়ি স্টপেজ পেরিয়ে যখন থানচি এসে পৌঁছুলাম তখন বিকেল। ছোটমতো একটা পাহাড়ি এলাকা। গভীর মনোযোগে দেখছিলাম চারপাশ। ধ্যান ভাঙলো হাসানের ডাকে।
– সুহেল ভাই, চলেন কিছু খাইয়া নেই। পাশে দেখলাম একটা বাঁশের বেড়ার ঘর। যাতে পরোটা ভাজি বিক্রি করছে। খেয়ে সুবিধা হলো না। তবু খিদে পেটে খেলাম একটু। খেয়ে সামনে মিনিট দুয়েক হাঁটতেই দেখি পাহাড়ি নদী। এটাও সেই সাঙ্গু বা শঙ্খ তবে এখানে তার ভিন্ন রুপ। ভারী শরীর নিয়ে কষ্টে সৃষ্টে নামলাম খাড়া পাড়ে। নৌকায় চড়ে গেলাম ওপাড়ে থানচির মূল এলাকায়।
নদীর খাড়া পাড় আর দোকান আরেকটু রাস্তা পেরিয়ে আবার পাহাড়। সেই পাহাড়ের লম্বা সিঁড়ির মাথায় পাকা ডাকবাংলো। সেখানেই উঠলাম আমরা একটা রাতের জন্য। আমরা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। ডাকবাংলোর নিচে বিরাট এক তেঁতুল গাছ। যে পাহাড়টার উপর ডাকবাংলো সেটা আসলে টিলা আর পাহাড়ের মাঝামাঝি আরকি। ফ্রেশ হয়ে আমরা গল্প করলাম একটু দুজনে। একটু গুছিয়ে বিশ্রাম নিলাম। কখন যে রাত নটা বেজে গেছে আমরা খেয়াল করতে পারিনি। খেয়াল হলো তখন যখন পেটে ছুঁচো নাচছে। রুমে তালা দিয়ে নিচে নেমে এলাম আমরা। এসে দেখি থানচির জন্য এটা অনেক রাত। খাবার বলতে শুধু পরোটা আর ভাজি। একদম ইচ্ছে করছিল না খেতে। এক দোকানে ভাত পাওয়া গেল সঙ্গে তরকারি বলতে শুধু লইট্টা মাছের ঝোল। রান্নার চেহারা দেখে খেতে ইচ্ছে করলো না কিন্তু বিকল্প নেই দেখে খেলাম। কী বলবো দুর্দান্ত সেই স্বাদের কথা! আজ পর্যন্ত আমি অনেক লইট্টা মাছ খেয়েছি ওরকম মজা আমার লাগেনি। সারাদিনের ক্ষুধা একসঙ্গে চাগাড় দিয়েছিলো, ভালোমতো ভাত খেলাম দুই বন্ধু। তারপর সেই দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে আমরা ফিরে গেলাম ডাকবাংলোয়। দারুন ঘুম হলো সে রাতে। ভোরে ঘুম আমার ভাঙলো আগে। উঠে দেখি বাইরে অনবদ্য সকাল। বারান্দায় থেকে তাকিয়ে দেখলাম তেঁতুল গাছটা। রাত্রিবেলা এর বিশালতা বোঝা যায়নি ভালো করে। কী অপূর্ব সুন্দর লাগছে এই ভোরের আলোয় বিশাল তেঁতুল গাছ! চারপাশে একটা ফিনফিনে কুয়াশাচাদর পাহাড়ি প্রকৃতির রুপকে যেনো আরো খোলতাই করেছে। শেষ রাতের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। হাসানকে ডেকে তুললাম। দুজনের ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম নাস্তা করতে। দুজনে দুটো করে ডিম আর পরোটা খেয়ে গেলাম থানচি বাজারে। নানারকম পাহাড়ি সবজি আর পণ্যের দেখা পেলাম সেখানে। এইরকম গ্রামীন বাজার খুব পছন্দ আমার। সাদাকালো বরবটির বীজের মতো একরকম ডাল কিনলাম। আরও কিছু কেনাকাটা করে, কিছু মানুষের সাথে কথা বলে ফিরছি, এসময় হাসানকে একটা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কয়েক দোকান পরপরই বাজারে একটা জিনিস দেখলাম, শুধু একটা চৌকি পাতা আর কিছু নেই। ভেতরে রুম আছে সেখানে পর্দা দেয়া। এইগুলি কি? হাসান হেসে জানালো, এইগুলি পাহাড়ি ‘বার’। বললো চলেন যাই। ভেতরে গিয়ে বসলাম। ভেতর থেকে একটি পাহাড়ি মেয়ে খুব মিষ্টি করে, জিজ্ঞাসা করলো, খাবেন?
সেখান থেকে হাসান নিয়ে গেলো তার পরিচিত এক লোকের কাছে। সেখানে গিয়ে থানচির মানুষের নানারকম দুঃখ, কষ্ট, সুখের গল্প শুনলাম। মাঝে মাঝে কেমন ঝটিকা ডাকাতদল আসে বাজারে লুট করতে। শুনলাম ওদের কফিবীজ সংগ্রহের গল্প। অনেক পর্যটক দলবেঁধে এসে কেমন বিরক্ত করে সেসব কথা। শুনে ফিরে এলাম। আমাদের ডাকবাংলোর প্রায় সিঁড়িসংলগ্ন রেস্তোরায়। আপনারা কি বিরক্ত হচ্ছেন আমার খাবার গল্পে? কি আর করা, আমি যে খেতে ও খাওয়ার গল্প করতে ভালোবাসি খুব। দুপুরে ভাত খেলাম একটা সবজি, গরুর মাংস আর মুগ ডাল দিয়ে। খেয়ে তাড়াতাড়ি ডাকবাংলোতে ফিরে গেলাম। দেরি হলে বাস পাওয়া যাবে না। ফেরার পথে চারদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলাম। আমার জীবনে যেটুকুই বেড়াবার অভিজ্ঞতা, তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটি এসময় ঘটলো। আমাদের বাসে মেঘ ঢুকে পড়ল। মেঘ মানে সত্তিকারের মেঘ। জানলা দরজা সব দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে। কি অদ্ভুত ঠান্ডা কেমন যেনো একটা ঠাণ্ডা ঠান্ডা অনুভব। আমি ক্যামেরা ফোন ব্যবহার করে পাগলের মত এদিক ওদিক ক্লিক করতে লাগলাম। কে জানত এরপরে আছে আরো বড় বিস্ময়! কিন্তু ততক্ষণে আমি আমার ফোনের ব্যাটারি চার্জ শেষ করে ফেলেছি। তাই মনের ফ্রেমে বেঁধে রাখলাম দৃশ্যটাকে। দেখি পাহাড়ের উপর দিয়ে আমরা যাচ্ছি নিচে বিশাল তুষারশুভ্র ঢেউয়ের সমুদ্র। সেই সমুদ্রে অনেক দূরে দূরে ছোট ছোট জাহাজের মত পাহাড়ের শৃঙ্গ উঁকি দিয়ে আছে। অদ্ভুত সুন্দর, তীব্র সুন্দর!! আমি আমার সমগ্র জীবনে এত সুন্দর দৃশ্য সিনেমা, টিভি কোথাও দেখিনি। এইরকম সৌন্দর্য মনে অদ্ভুত বিষাদের জন্ম দেয়। মনে পড়ে যায় মায়ের কথা, বাড়ির কথা, প্রিয়জনের কথা। কষ্টটা আরো বেড়ে গিয়েছিল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়াতে ছবি তুলতে পারিনি বলে। একটা কথা মনে হলো,বঅনেকেই আমরা নিজের দেশটা তেমন না দেখেই বিদেশে রেড়াতে চলে যাই। অনুরোধ রইলো, নিজের নিজের দেশটা কিছুটা দেখে নিন আগে। নিজের দেশের গ্রাম, পাহাড়, সমুদ্র, বন, নদী দেখে নিয়ে না হয় বিদেশ গিয়ে বলবেন, How wonderful! তুলনাটা সহজ হবে আরকি!
রাত হয়ে যায় বেশ কক্সবাজার ফিরতে। অত রাত্রে বাসার লোকজনকে বিরক্ত না করে হাসান আর আমি বাইরে খেয়েই বাসায় যাই। পরদিন সকালে খালাম্মা ( হাসান ভাইয়ের মা) আর ভাবীর আথিত্যে দারুন নাস্তা সেরে আস্তে ধীরে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার বাস ধরলাম। প্রিয় মহানগর, প্রিয় ঢাকা আমাকে ডাকছে অদৃশ্য হাতছানিতে।