আমার শোনা কথা- রত্না চক্রবর্তী’র ছোটগল্প ( অন্য রহস্য)

0
793
রত্না চক্রবর্তী

আমার যারা অন্য রহস্যের পাঠক আছেন তাদের এবার যে গল্প শোনাবো তা আমার অনেকবার শোনা মা দিদিমা, মামীমার থেকে। কারণ এ গল্প যবেকার তখন আমি তো জন্মাই নি, আমার মা’ই বালিকা। ঢাকুরিয়ার যে মঙ্গলচণ্ডী বাড়ির গল্প আমি এতবার করেছি সেই দেবী কি ভাবে প্রথম ও বাড়ি আসেন তারই গল্প। তাদের সম্পর্ক ধরেই লিখছি।

আমার দিদিমা ও তার বোনের বাড়ি ভারি মজার ছিল একই পাঁচিলে পিঠোপিঠি বাড়ি কিন্তু দুটো আলাদা পাড়া। দিদিমার বিধবা বোন খেঁদি, তার দুই ছেলে ও দিদিমাদের এক নিঃসন্তান মামা মামী সেই বাড়িতে থাকতেন। সেটাই মঙ্গলচন্ডীভবন হয়েছিল পরে। এই মেজমামার ( কেন মেজোমামা বলত তা আমি জানি না।) নাম ছিল ব্রজেন, আর মামীর নাম ছিল গায়েত্রী। এই মেজোমামা খুব কম মাইনের চাকরি করতেন পোস্ট অফিসে। কষ্টেসৃষ্টে চলে যেত। কিন্তু সে যুগে মানুষ আজকের মতো এত স্বার্থপর ছিল না। তাই একটু দূরসম্পর্কের বিধবা অসহায় ভাগ্নীকেও তিনি ফেলেন নি। আর নিঃসন্তান এই দম্পতি শিশুদুটিকে পেয়ে শান্তি পেয়ে গিয়েছিলেন। তখনকার ঢাকুরিয়া এমনটি ছিল না। অনেকেরই বাড়ির সামনে বা পিছনে বেশ খানিকটা জায়গা ছিল। আমার মার মাসীমা খেঁদি সেই বাগানেরই একধারে ময়লা, আনাজের খোলা, ভাতের ফ্যান ফেলত। একদিন রাতে বজ্রেন স্বপ্ন দেখলেন একটি লাল টুকটুকে মূর্তি তাকে ডেকে বলছেন ” এই তোর বৌ আর খেঁদি আমার গায়ের কাছে ময়লা ফেলে আমার কষ্ট হয়। আমায় উঠিয়ে নিয়ে আয় না। আমি ওখানে থাকতে পারছি না। ” ঘুম ভেঙে গেলে ব্রজেন একটু অবাক হলেন কিন্তু এই নিয়ে আর ভাবলেন না, মানুষ কতরকম বিদঘুটে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ব্যাপারটা এখানে থামলো না, পরদিন আবার দেখলেন সেই একই স্বপ্ন। এবার একটু অস্বস্তি বোধ করলেন।

কি অদ্ভুত স্বপ্ন রে বাবা! পরদিন আবার একই সেই স্বপ্ন এবার দেখলেন ঠিক মূর্তি নয়, একটা ঘটি মতো তাতে একটা লাল মতো মূর্তির মতো।এবার কন্ঠস্বরে অধৈর্য্যের ভাব ” কি রে কতবার এককথা বলব, আমার কষ্ট হচ্ছে, আমি এখানে থাকব না, আমায় তোল, নিজের ঘরে নিয়ে চল। ” এবার ব্রজেন স্বপ্নে উত্তর দিলেন ” তুমি কে? ” উনি বললেন ” আমি মঙ্গলচণ্ডী। ” ব্রজেন বললেন “ওরে বাবা চন্ডী মানে রাগী ঠাকুর, আমি না জানি মন্ত্র, না আছে পয়সা। আমি কোথায় তোমায় রাখব আর কি করে পূজো করব, কোথায় কি খুঁত হয়ে যাবে, বাব্বা ও আমি পারব না। ” দেবী বলছেন ” দূর পাগল তোর মন্ত্র লাগবে না, রোজ যে গায়েত্রী মন্ত্র জপিস তাই করে আমার পূজো করিস। তুই বলবি খাও আমি খাব, গাছের ফুল দিয়ে চন্দন দিয়ে পূজো করবি। তুই তো দুধ খই খাস রাতে, সেটাই আমায় ভোগ দিবি। আমার যা লাগবে সে সব আমি এনে নেবখন ও নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। ” ব্রজেন নাকি তখন ঘুমের মধ্যে স্পষ্ট কথাবার্তা বলছেন। তখন তার স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেছে, তিনি তার স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে বললেন ” হ্যাঁ গা, কি বকছ গো ঘুমের মধ্যে? কি হল, জ্বরজ্বালা হল নাকি গা? ” ধরমর করে উঠে বসলেন তিনি, বিহ্বল দৃষ্টিতে খানিক বসে রইলেন, তারপর এক ঘটি জল খেয়ে গত কদিনের সমস্ত স্বপ্নের ঘটনা তার স্ত্রী গায়েত্রীকে বললেন।

গায়েত্রীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ” ওমা সেকি, তুমি আমাদের আগে কও নি কেন? এখন কি হবে? কি করবে? আমরা ওখানের সব নোংরা পরিষ্কার করে দেব আর কখনো ওখানে কিচ্ছু ফেলব না। রোজ সন্ধ্যায় ধূপধূনো দেবখন। ” বজ্রেন এবার এমন জীবন্ত স্বপ্নটা দেখেছিলেন যে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ালেন বটে কিন্তু তার। মনের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। পরদিন আমার মামারবাড়ি সবাই জানল আমার মাসিদিদা খেঁদির মারফত। সবাই তো শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। ভোর ভোর উঠে গায়েত্রী আর খেঁদি, সেই জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে ধূপ জ্বেলে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম করলেন। অজান্তে কিরা অপরাধের জন্য নাককান মূলে ক্ষমা চাইলেন। আমার বড়মামী খুবই ভক্তিমতী ছিলেন, তখন তিনি কিশোরী বধূ, তিনিও গিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করে এলেন। সবাই শান্তি পেল, এই নিয়ে গল্প করতে লাগল শুধু ব্রজেন কিন্তু শান্তি পেলেন না। সারাদিন চুপচাপ অফিসের ঘরের কাজকর্ম করে গেলেন।

সেই রাতে তিনি আবার স্বপ্ন দেখলেন সেই লাল টুকটুকে ঘটের মূর্তিটা যেন ঠোঁট নেড়ে বলছে ” আমায় ঘরে নিয়ে আয়, আমি বাইরে থাকব না, তোদের সঙ্গে থাকব। ভয় পাস না, আমি নিজে আসছি,তোদের দোষত্রুটি ধরব না। ” বলার মধ্যে যেন একটা আকুতি আছে বাচ্চামেয়ের মতো। মাঝরাতে উঠে বসে সেই প্রৌঢ় কেঁদে ফেললেন। ভাগনী খেঁদি, স্ত্রী গায়েত্রী আর বজ্রেন সেই রাতেই ঠিক করলেন ভোরবেলা একবার জায়গাটা খুঁজেই দেখবেন, যদি সত্যি কিছু পান তবে মা মঙ্গলচণ্ডীর নির্দেশ মতো ঘরেই এনে পূজো করবেন আর না পেলে মিটেই গেল। সকালবেলা স্নান সেরে আমার মামারবাড়ির লোকেদেরও ডাকলেন। আমার বড়মামী, দিদিমা, আমার মা ( ছয় সাত বছরের), পাড়ার দুএকজন প্রৌঢ়াও সেখানে এসে দাঁড়ালেন। মার সেই মেজদাদু স্বপ্নে দেখা জায়গাটার মাটি খুঁড়তে লাগলেন। সবাই উৎসুক, জোড় হাতে কাঁপা কাঁপা বুকে দাঁড়িয়ে দেখছে।

মেজমামা একটু করে খোঁড়েন আর হাত ঢুকিয়ে দেখেন, খানিক বাদে তিনি একটা অস্ফুট চিৎকার করে উঠলেন মাটির নিচের থেকে তার হাতে উঠে এসেছে একটা লম্বাটে গোল মতো লাল পাথর, যেমনটি তিনি ঘটের উপর দেখেছিলেন। তিনি স্তম্ভিত, আবেগে তার চোখে জল এসে গেছে, সমবেত যেকজন মহিলা ছিল তারা উলু দিয়ে উঠল, কে একজন ছুটে গিয়ে শাঁখ এনে বাজাতে লাগল, সবাই জয়ধ্বনি দিতে লাগল, আশপাশের আরো কজন এই শব্দ পেয়ে এসে দাঁড়ালেন। মেজদাদু সেই বড় শালগ্রাম শিলার সাইজের লাল পাথরটি মাথায় করে নিয়ে চল্লেন ঘরে। ঠাকুরঘরে একটা নতুন পিতলের ঘটে সেই পাথরটি রাখলেন। তারপর লাল চেলি দিয়ে ঘোমটার মতো দিয়ে দিলেন। ঠিক স্বপ্নে দেকগা মূর্তিটির মতো দেখতে লাগল। সেই মঙ্গলচন্ডী প্রতিষ্ঠিত হল। আর বেশ তাড়াতাড়িই পাড়ায় আশপাশে তার মহিমা ছড়িয়ে পড়ল।

সেই বৃদ্ধকে মঙ্গলচন্ডীর জন্য কিচ্ছু কিনতে হয় নি, কিচ্ছু আনতে হয় নি বরং ভক্তরা মঙ্গলচণ্ডীর পূজো দিতে আসার ফলে তার সংসারের উন্নতি হয়েছিল। মহিমা প্রচারের অনেক ঘটনা আছে। অনেক সন্দেহের মুখোমুখি হতে হয়েছে কিন্তু সেই চন্ডীবাড়ি ভক্তজনের খুবই বিশ্বাসের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। সে সব গল্প আর একদিন একে একে বলব ইচ্ছা রইল। আমি আমার বড় বয়সেও দেখেছি মায়ের গায়ে সোনার গয়না, সোনার চোখ, রমরমা করে পূজো অনুষ্ঠান। মানুষের ভক্তি আর মঙ্গলবার মঙ্গলবার ভক্তের ভিড়। ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের ঘটনার একটি আমার শোনা অপরটি দেখা পরের বারে সেই গল্প নিয়ে আসছি। এই সব গল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু মানুষ আমরা আজও আছি।।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনীল মাহাবুবের একগুচ্ছ কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“হারুকাকার পদক”- ভাস্কর বাগচী’র রম্য রচনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে