মরীচিকা -শাপলা জাকিয়া‘র ভৌতিক গল্প -পর্ব ০৭

0
678
Shapla-Zakia

মরীচিকা

ভৌতিক গল্প পর্ব-০৭

শাপলা জাকিয়া : হঠাৎ দৃশ্য বদলে গেলো। রূপালীর ছোট, এলোমেলো রান্নাঘর থেকে মুহূর্তে আমাদের নতুন ফ্ল্যাটে চলে এলাম। হাতে একটা দড়ি মুঠো করে ধরা, সিলিং এ ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ার কথা ভাবছি!
বেডরুমে প্রবাল আর আমি যেভাবে আসবাব সাজিয়েছি, সেভাবে সাজানো নয় রুমটা।

জিনিসপত্র আমাদের চেয়েও কম। ফলে রুমটা অনেক বড় লাগছে। এই রুমের একটা ফার্নিচারের সাথেই আমার পূর্ব পরিচয় আছে, সেটা হলো কম্পিউটার টেবিল ও ডেস্কটপ। যা আমি মাঝে মাঝে আমার ফ্ল্যাটে দেখতাম তারপর আবার অদৃশ্য হয়ে যেতো।

রূপালী অথবা আমি, আরেকবার ডেস্কটপের সামনে গেলাম। ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখলাম কী বোর্ডে খট খট করে- ” ফিরে আয়, ফিরে আয় বলে এতো ডাকলাম তোকে, ফিরলি না। আমি তবে যাই এবার না ফেরার দেশে? তখন যদি ডাকিস তুই, আমি চাইলেও ফিরতে পারবো না। হয়তো আমাদের আর কোন জনমেই দেখা হবে না। তোর এ জন্মের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আমরা আর কোনদিন কেউ কাউকে পাবো না মহিম।”

প্রাইভেসি দেয়া আছে, লেখাটা শুধু মহিমের আইডি থেকে দেখা যাবে। কিছু সময় পার হলো কিন্তু মহিমের আইডি থেকে কোন রেসপন্স এলো না।
রুপালী হয়ে আমি কী প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, কাউকে বোঝাতে পারবো না। কোন শব্দে এই কষ্টগুলিকে বাঁধা যাবে আমার জানা নেই, শুধু অনুভব করছি তা ধীরে ধীরে সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।

চেয়ারটা টেনে সিলিং ফ্যানের নিচে নিয়ে এলাম। দড়ির একমাথা ফ্যানের সাথে বেঁধে আরেকমাথা নিজের গলায় বাঁধলাম। লাথি দিয়ে চেয়ারটা সরিয়ে দেয়ার আগে নিজের জন্য খুব মায়া হচ্ছে, ছোট্ট রূপালীর কথা মনে পড়ছে অথবা দুই বেনী ঝোলানো কিশোরী রূপালী কিংবা লাল বেনারসি পরা নববঁধুর সাজে রূপালী! আহারে রূপালী! তোর জীবনের শেষ দৃশ্যে এই ছিল!

আমি মেঘলা তখন ছটফট করে উঠলাম। রূপালীর মরে যাওয়া মানে কি আমারও মরে যাওয়া? মেঘলা আর রূপালী তো এখন একই জন! রূপালীর শরীর থেকে বের হওয়ার কোন উপায় কি নেই?
আমি বলতে চাইলাম,

-রূপালী চেয়ারটা পায়ের কাছ থেকে সরিও না প্লিজ! আমি মরতে চাইনা। তুমি শুধু মহিমের জন্য মরে যেও না। ওকে ভুলে যাও।
কিন্তু কিভাবে বলতে হবে জানিনা, আমি রূপালীকে অনুভব করতে পারছি কিন্তু ওকে কিছু বলতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।

রূপালী লাথি দিয়ে চেয়ারটা সরিয়ে দিলো আর ঝুলে পড়লো ফাঁসিতে! আহ! এই কষ্ট আরও অবর্ণনীয়, এতোক্ষনের সব কষ্টকে ছাপিয়ে গেলো যেন! মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছি আমি আর রূপালী!
আমি প্রাণপণ চেষ্টায় চোখ মেললাম আর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এতক্ষন যা দেখেছি তা স্বপ্ন বুঝতে পেরে বুকে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো যেন। কিন্তু তৃষ্ণায় জান বের হয়ে যাচ্ছে।

যে বিছানাটায় শুয়ে আছি তা হোটেল রুম নয়। বরং কোন ক্লিনিক মনে হলো। ক্লিনিকে কে আনলো আমায়? কতক্ষণ ঘুমিয়েছি যে ঘুমের মধ্যে এখানে নিয়ে এলো, টের পেলাম না?
মনে পড়লো, গতরাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটা বিড়াল আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আমি প্রবালকে মেরেছিলাম! সত্যিই কি মেরেছিলাম,না ওগুলিও স্বপ্ন ছিল?

উঠে বসার চেষ্টা করে দেখলাম হাতে স্যালাইন লাগানো রয়েছে। মাথাটাও ঘুরে গেলো। মাথার তালুর মাঝখানে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। বেডের পিছনে একজন নার্স দাঁড়িয়ে ছিল, সে ছুটে এসে বললো,
-উঠবেন না প্লিজ, শুয়ে থাকুন।
আমি বললাম,
– পানি খাবো। প্রবাল কোথায়?
-আপনার হাজবেন্ড? এখানেই ছিলেন, এইমাত্র বাইরে গেলেন। ডেকে দিচ্ছি।
আমাকে পানি দিয়ে নার্স বাইরে গেলো। ফিরলো একজন অল্পবয়সী মহিলা ডাক্তার আর প্রবালকে নিয়ে। প্রবালের কপালের ডান সাইডটা ফুলে আছে।

তারমানে কাল রাতে যে ওকে মোবাইল ছুড়ে মেরেছিলাম, সেটা স্বপ্ন ছিল না! বেচারার চোখমুখ উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে । প্রবাল আমাকে সুখী করেছে কিন্তু আমি ওকে সুখে রাখতে পারছি না, কথাটা ভাবতেই প্রবল অপরাধবোধ আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

প্রবল রুমে ঢুকলেও অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো, কাছে আসলো না। ডাক্তার মেয়েটি আমাকে চেক করে টুকটাক প্রশ্ন করলো, কেমন আছি, নাম কি, কোন সমস্যা হচ্ছে কি না এসব। আমি উত্তর দিলাম। মেয়েটি প্রবালকে বললো,

– উনি এখন অনেক ভালো আছেন, আপনি কথা বলতে পারেন।
ডাক্তার ও নার্স বেড়িয়ে যেতেই প্রবাল এসে আমার হাত ধরলো। মুখ এগিয়ে এনে মৃদু স্বরে জানতে চাইলো কেমন আছি। যেন জোরে কথা বললে আমি ব্যাথা পাবো। ওর চোখে রাজ্যের মায়া।
নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
প্রবাল বললো,

– কাঁদছ কেনো, শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তারকে ডাকবো?
– না, তোমার জন্য কাঁদছি। তোমাকে কতো যন্ত্রনা দিচ্ছি।
প্রবাল মৃদু হেসে বললো,
– কিচ্ছু যন্ত্রনা দিচ্ছো না, তুমি সুস্থ হয়ে উঠলেই আমার সব কষ্ট চলে যাবে।
-ডাক্তার কি বললেন? কাল রাতে আমার কি হয়েছিল?
-ডাক্তার বলছেন, নার্ভাস ব্রেকডাউন তাছাড়া প্রেশার অসম্ভব হাই হয়ে গেছিলো তোমার। তোমাকে দুইদিন ঘুমের ওধুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল।
-দুইদিন! আমি দুই দিন ঘুমিয়েছি!
– হুম।
– ঘুমের পুরোটা সময়, জানো আমি রূপালীকে স্বপ্ন দেখেছি?
রূপালীর প্রসঙ্গ আসায় প্রবাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
-আমি রুনা ভাবীর কাজিন দীপু ভাইকে আসতে বলেছি। তোমাকে দেখে যাক। তারপর যা করতে বলবে করবো।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
– সেকি! তুমি তো এসবে বিশ্বাস করো না।
প্রবাল বললো,
-ভালোবাসা, মায়া মনকে দূর্বল করে, নিরূপায় মানুষকে অতীন্দ্রিয় ব্যাপারে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। আমি আমার অবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারতাম কিন্তু তোমার ব্যাপারে কোন রিস্ক নিতে চাইনা। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা জানতে চাই না, শুধু তোমার সুস্থতা চাই।

প্রবাল হয়তো আরো কিছু বলতো কিন্তু রুনা ভাবী ও দীপুকে ঢুকতে দেখে থেমে গেলো। দীপুর সাজসজ্জা আজ অন্যরকম। জিনস -টিশার্টের সাথে মাথায় টুপি পরে এসেছে। দীপু হয়তো আমার বয়সীই হবে বা কিছু বড়। অথচ চোখেমুখে খুব ভারিক্কী ভাব। দীপুকে দেখে আমি আশার আলো দেখলাম কিন্তু মনের মধ্যে কী একটা কু ডাকলো। কু ডাকা অংশটা দীপুকে পছন্দ করছে না।

নার্স এসে বললো,
-আপনারা একসাথে তিন জন রুমে থাকতে পারবেন না। একজন একজন করে দেখা করুন।
আমি দীপুকে এড়ানোর জন্য বললাম,
-রুনা ভাবী, তুমি থাকো। তোমার সাথে কথা আছে।

দীপু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তারপর রুনা ভাবিকে বললো,
– আমি আগে কথা বলি আপা, সেটা বেটার হবে।
নার্স, প্রবাল ও রুনা ভাবি চলে গেলো দীপুকে রুমে রেখে। শুরুতেই বিড়বিড় করে কিছু পড়তে পড়তে পুরো রুম চক্কর দেয়া শুরু করলো দীপু।

আমার কেন যেন দীপুকে অসহ্য লাগছে। বুকের ভিতর কি একটা জ্বালাপোড়া মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যেন কোন আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠার আগে ফুঁসতে শুরু করেছে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে শুরু করলাম। হাতের মুঠো খুলছি আর বন্ধ করছি অস্থিরতায়। ইচ্ছা করছে দীপুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি।

ইচ্ছাটাকে গুরুত্ব দিলাম। খাট থেকে লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলাম, স্যালাইন লাগানোর স্ট্যান্ডটা পড়ে গেলো। কার্পেটের ওপর পড়ায় শব্দ হলো না। আমি থামলাম না। দীপুকে গলা টিপে ধরতে চাইলাম কিন্তু তৈরি ছিল ও, কি একটা গুড়া আমার গায়ে ছড়িয়ে দিল।

আমি ফনা নামিয়ে নেয়া সাপের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। বিছানায় ফিরে আসলাম। রাগটা কমে এসেছে দ্রুত। দীপু এক গ্লাস পানিতে কিছু পড়ে ফুঁ দিয়ে আমাকে খেতে দিলো। ওর চোখে কিছু ছিল, সেদিকে তাকিয়ে বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলাম। খাওয়ার পর ভিতরের আগ্নেয়গিরিটা যেন নিভে গেলো। আমি শান্ত চোখে দীপুর দিকে তাকালাম। দীপু বললো,

-আপনি যে আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করলেন, এটা কিন্তু আপনি করলেন না। এটা করলো ঐ মেয়েটা যে আপনার শরীরে প্রবেশ করার ক্ষমতা পেয়ে গেছে। একটু আগেও সে আপনার মধ্যে এসেছিল, এখন সরে গেছে। এইবার আমরা কিছু কাজের কথা সেরে নেই, কি বলেন?
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম,
-বলুন।

দীপু সামনের সোফায় বসতে বসতে বললো,
-প্রবাল সাহেব আমাকে সে রাতের ঘটনা সবই বলেছেন। দেখুন সব অতৃপ্ত আত্মা কিন্তু হীংস্র হয় না। অনেক ভালো আত্মাও আছে। এরা বরং মানুষদের সাহায্য করে যদি সম্ভব হয়। ধূসর শাড়ি পরা যে মেয়েটির কথা আপনি বলছেন সে কিছুটা আক্রমণাত্মক, পুরোপুরি না। নইলে সে রাতে প্রবাল সাহেবের মৃত্যু হওয়া খুব স্বাভাবিক ছিল।
আমি চমকে উঠে বললাম,

-ব্যাপারটা এতো ভয়ংকর?
দীপু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো এতো ভয়ংকর হতে পারতো, কিন্তু হয়নি, এটাই আশার কথা। সেদিন আপনারা হোটেলে চলে যাওয়ার আগে, প্রবাল সাহেবকে একটা দোয়া পড়া পানির বোতল কাছে রাখতে বলেছিলাম। তিনি বোতলটা নিতে রাজি হননি। রাজি হলে যে বিপদটুকু হয়েছে সেটা হতো না। ঐ মেয়েটার সম্পর্কে আর কোন তথ্য কি অনুভব করতে পারলেন?

-মেয়েটির নাম রূপালী, ওকে নিয়ে দীর্ঘ একটা স্বপ্ন দেখেছি শুধু।
-গুড! ওটা স্বপ্ন নয়, রূপালী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ওখানেই পাওয়া যাবে। কি দেখলেন?
– মেয়েটা ছবি আঁকতো। থাকতো মফস্বলে, স্বামীর সাথে।ওর স্বামী ছিল খুব বদমেজাজি আর সন্দেহপ্রবণ।

সন্দেহ করার কারণও ছিল। মহিম নামের এক ছেলের সাথে পরকীয়া করতো রূপালী। এক পর্যায়ে মহিম ওকে ঐ ফ্লাটে রেখে চলে যায়। রূপালী মহিমের বিরহে সুইসাইড করে।
দীপু কিছুক্ষণ চুপ করে বললো,
-ও মহিমকে খুঁজছে, তাইতো?
-হুম।
-আচ্ছা, তবে আমাকে প্রথমে মহিমের খোঁজ বের করতে হবে। আপনি মহিম নামের কাউকে চেনেন?
-না।
একটা দোয়া লেখা কাগজ, দোয়া পড়া পানি আমার কাছে সবসময় রাখতে বলে দীপু রুনা ভাবিকে ডেকে বললো,
-তুমি কথা বলো আপা, ভয়ের কিছু নেই।

রুনা ভাবী তার পান খাওয়া মুখে এক গাল হাসি নিয়ে বললেন,
– নাহ, ভয় কিসের? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মানুষ। আমি বরং ওকে একটু দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেই।
দীপু চলে যেতে রুনা ভাবী সূরা পড়ে আমায় ফুঁ দিয়ে দিলেন। আমি রুনা ভাবীর হাত ধরে এই প্রথম তুমি করে বললাম,

-তুমি কতো ভালো!
রুনা ভাবী তার উত্তরে তুই এ নেমে আসলেন,
-আমি আর কী ভালো রে, ভালো তো তোর বর। ছেলেটা কি না করছে তোর জন্য। অবশ্য শাশুড়ি ননদ না থাকায় বেঁচে গেছিস, থাকতো যদি এখন, দেখতি তোর এই অসুস্থতাকে কারণ বানিয়ে ডিভোর্সের জন্য কেমন নাচানাচি করতো। বাড়ির বউদের খুব কম শ্বশুরালয় ফ্যামিলি মেম্বার মনে করে। বউদের অধিকাংশ সময় কর্মচারী বা আশ্রিতের দৃষ্টিতে দেখা হয়। বউ অসুস্থ মানে, তাকে বিদায় করো, নতুন একটা আনো।

রুনা ভাবীর কথায় আমার চাচী শাশুড়ির কথা মনে পড়লো। প্রবাল এই চাচীর বাড়িতে ছোটবেলায় থাকতো। যতোবার দেখা হয়েছে তিনি আমাকে কোন না কোন কারণে খোঁচা দিয়ে কথা বলেছেন। এখন যদি আমার এই অসুস্থতার কথা জানেন তবে কি বলবেন? আচ্ছা, প্রবাল ধৈর্য রাখতে পারবে তো, ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“দীর্ঘশ্বাস ফেলিনা আর”- শাহিনা খাতুনের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধমরীচিকা -শাপলা জাকিয়া‘র ভৌতিক গল্প -পর্ব ০৮

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে