আইসোলেশনে ঈদ -মৃত্তিকার কাছে লেখা, বনশ্রী বড়ুয়া’র চিঠি

0
871
শ্রী. বড়ুয়া বনশ্রী

মা আমার।
মাটির ঘ্রাণ বুকে চেপে রাখতে চেয়েছিলাম বলেই তোর নাম রেখেছিলাম মৃত্তিকা। তোর দাদীর সে কি রাগ! বরাবরই আমার নিভৃতচারিনী মা ছিলেন ধার্মিক, ধর্মভীরু খাঁটি মুসলমান। তিনি চেয়েছিলেন তোর নাম হবে আসাদ বিনতে মমতাজ।

আমি বলতাম, ওই নাম তুমি খাতা কলমে লিখো মা, আমি ওকে মৃত্তিকা বলেই ডাকবো। মাটি বুকে নেয়ার কি আনন্দ সেটা আমার সাদাসিধা মা’কে বুঝানো সম্ভব ছিল না সেদিন। আমার মৃত্তিকা, আমার মাটি, আমার বুকের খনি রে তুই…
কি অদ্ভুত! তুইও কাদামাটির মত মন নিয়ে আমার পৃথিবীতে এলি। এই কম বয়সে এতটা পরিণত কি করে হয়েছিস তুই? এতটা শান্ত,স্থির কি করে হলি মা!

আমার মা মারা যাওয়ার পরে তুই আস্তে আস্তে আমার মা হয়ে উঠলি। শাসনে আদরে আগলে রেখেছিলি। তোর ছায়ায় ছোট্ট শিশুটি হয়ে গিয়েছিলাম। পৃথিবীর জটিল ব্যামোর কথা ভেবেই তুই আমাকে অফিস থেকে ফিরে সোজা ওয়াশরুমে পাঠাতি, একেবারে গোসল শেষ করেই মুক্তি। একটু পর পর হাত না ধুলে পরে সে কি রাগ তোর!

ইফতার আর সেহেরি সবকিছুতেই জিংক আর ভিটামিন সি যুক্ত খাবার রাখতেই হবে এমনটায় আমার মায়ের নির্দেশ। জানিস, তোর এই কড়া শাসনে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যেতো…
সেদিন অফিসে সারা’দিন টুকটুক করে কাশলাম। তোর ফোন রিসিভ করিনি পাছে তুই দুশ্চিন্তায় থাকিস। বাসায় ফিরে গোসল করে বেরুতেই সে কি জ্বর! টানা ক’ দিন শুয়েছিলাম। জ্বর,কাশি বেড়েই চলেছে দেখে তুই জোর করে পাঠালি করোনা টেস্ট করাতে। রিপোর্ট যখন হাতে আসে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাসায় আর ফিরছি না, সোজা হাসপাতালে….

সেই শেষবার তোর চেহারাটা দেখেছি,পাহাড়ের মত স্থির মেয়েটা কি করে একমুহূর্তে বরফগলা নদী হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। জন্মের পর থেকে কখনো জোরে তোকে কাঁদতে দেখিনি। কান্না আসলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতি, সেই মেয়ের আহাজারিতে যেনো আজ সারা পৃথিবী জেগে উঠবে। হাউমাউ করে কেঁদেছিস, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিস।

মা’রে আমি যে বড়ো অসহায় আজ। মৃত্তিকার বুকেও ঠাঁই হলো না।
শোন মা, আমার বেডের সামনে একজন দেবী বসে আছেন, সারা শরীর ঢাকা কিন্তু তারপরও তিনি দেবী। মৃত্যুর ভয় জয় করে আমার মত অসংখ্য আইসোলেশনে থাকা মানুষদের পাশে থাকছেন। তাকেই আজ অনুরোধ করেছি তোর কাছে একটা চিঠি লিখে দিতে।

প্রথমে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে,তারপর হাসিমুখে বললেন, এখানে তো কাগজ কলম নেই, আপনি বলুন আমি নোট প্যাডে লিখে নিচ্ছি। আপনার মেয়ের আইডিতে সেন্ড করে দেবো। যদিও মন খারাপ হয়েছিল শুনে কিন্তু কি করা! তোকে আজ বড্ড মনে পড়ছে মা। আজ তো ঈদ। এই প্রথমবার আমি ছাড়া তোকে ঈদ করতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই সকাল থেকে কিচ্ছুটি মুখে তুলিসনি। খুব কান্নাকাটি করেছিস?

মা রে,তুই যদি অমন করিস তাহলে তোর মা’কে কে সামলাবে? যদি ফিরে না আসি তবে তোর মা’কে দেখে রাখিস। বেচারি সারাজীবন তোর বাবাকে ভালোবেসে নিজের বাবার সুখের পৃথিবী ছেড়ে তোর বাবার ছন্নছাড়া জীবনকে শেষ আশ্রয় মনে করেছিল। একবিন্দু সুখ তাকে দিতে পারি নি। সংসারের বোঝা টেনেই দিন কেটেছে তার।

তোকে বুকে নিয়েই আমাদের সকল সুখ ছিল। জানিস মা, খুব ইচ্ছে করছে তোদের কাছে ফিরে যাই….
শোন,বাবা যদি এই যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসি,যদি আর একবার তোকে স্পর্শ করার সুযোগ পাই,তাহলে প্রথমেই তোকে কোলে নিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াবো, চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেব তোর চোখ,কপাল। তুই আর আমি মিলে সারা শহর রিক্সা নিয়ে ঘুরবো,ফুচকা খাবো,তোর প্রিয় লাল কাঁকড়া ভাজি খাবো।

একশোটা বেলুন উড়িয়ে দেবো তোর মায়ের নামে। সবগুলো বেলুনে লিখে দেবো, আমরা দুজন শুধু তোমাকেই ভালোবাসি….
মা রে,আমি থাকি আর না থাকি তোকে আকাশ ছুঁতে হবে। যে আকাশের বুকে আমার সামনে বসে থাকা দেবীটির মত মৃত্যু ভয় জয় করার সাহস থাকবে। মৃত্তিকার বুকে প্রেম থাকবে অপার, যাতে সকল মানুষের সেবা করতে পারিস।

খুব কষ্ট হচ্ছে রে মা। হয়ত আমাদের আর কোনদিন দেখা হবে না, নেয়া হবে শেষ স্পর্শ। আর কোন ঈদ আমরা একসাথে কাটাবো না,হয়ত চিরদিনের মতো চলে যাবো মৃত্তিকার বুকে….। সেদিনও জানিস তোর বাবা আছে। প্রতিটি দিনের শুরু কিংবা শেষে তোর বাবা আছে তোর সাথে। তুই আমার এক পৃথিবী সুখ। তোর মুখ চোখে এঁকেই আমি শেষ ঘুম’টা দিতে চাই…
ভালো থাকিস মা…আমার মৃত্তিকা মা।
ইতি-
                                                       তোর বাবা…

Advertisement
উৎসশ্রী. বড়ুয়া বনশ্রী
পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদের রাতেও সিংড়ায় পুকুরে বিষ দিয়ে ৫০ লাখ টাকার মাছ নিধনের অভিযোগ
পরবর্তী নিবন্ধঅস্পষ্ট ভালোবাসা -সুরজিত সরকার‘এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে