আধুনিকতা – রত্না চক্রবর্তী এর ছোটগল্প

0
247
Ratna

গল্প-আধুনিকতা
রত্না চক্রবর্তী

প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। তখন আমার মাত্র কিছুদিন বিয়ে হয়েছে। বালীগঞ্জের ষ্টেশনে নেমে একটু ভিতরে বাড়ি। আমার বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি সে সময়কার সাধারণ আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মত। অতি আধুনিক নয় আবার গ্রাম্যও নয়। আমাদের ওই পাড়ায় একটি দুটি পরিবার ছিল যারা বেশ শিক্ষিত ও আধুনিক ধরনের। পাড়ার আর আর পাঁচজন তাদের বেশ আলাদা মানে একটু সম্মানের চোখেই দেখত। তাদের বেশভূষা বাচনভঙ্গিকে নকল করতে চেষ্টা করত বা ঈর্ষার চোখে দেখত। এমনি একটা বাড়ি লিলির মাদের বাড়ি। লিলির মা ছিলেন এক অতি নামকরা সাহিত্যিকের বোন। সভা সমিতিতে যেতেন, সে যুগে বাড়িতেও কুঁচিয়ে শাড়ি পড়তেন। আমার মা বা শ্বাশুড়ি বাইরে বার হতেন কুঁচিয়ে শাড়ি পড়তেন, ঘরে সাধাসাধি করে পরতেন। ওনার হাতে বেশির ভাগ সময়ই বই থাকত। আমার ও বেশ সম্ভ্রমপূর্ণ ভালোলাগা ছিল। আমার শ্বশুরমশাই মারা যাবার দুদিন পর উনি এলেন আমাদের বাড়ি। আমার শ্বাশুড়িকে সময়োচিত কথা বললেন, দুটি বই হাতে এনেছিলেন, বললেন ” ভাই আপনি একদম পুরোনো কথা ভাববেন না, যত ভাববেন তত কষ্ট, বই পড়ুন, বইয়ের মত এত বড় বন্ধু আর হয় না। ” আমি মুগ্ধ। তিনি নিজে একটি সুন্দর গান গাইলেন, আমাদের বললেন রবীন্দ্র সংগীত শোনাতে। আমাদের বললেন ” দেখ একমাত্র মেয়েরাই পারে মেয়েদের অপমান কষ্ট দূর করতে, লোকের কথায় মাকে একদম আবোলতাবোল নিয়ম পালন করাবে না। মাছ,মাংস ডিম সব খাওয়াবে, স্বামী জীবনে আসার আগেও আমরা এসব খেতাম, কাজেই চলে গেলেই বা বন্ধ করে দেবে কেন? সিঁদুর শাঁখা পলা ওনার আসার সূত্রে পেয়েছিলাম, উনি চলে গেলে ভাসিয়ে দিয়েছি। ব্যাস, শ্বাশুড়িকে একদম নিরামিষ খেতে দেবে না। ” কি যে ভালো লাগল কি বলব। আমি নিজেও এই সব নিয়মের ঘোর বিরোধী যদিও জোর গলায় বলার সাহস পেতাম না। বিশেষ করে যেখানে অন্য প্রতিবেশীরা একাদশী – টষির বিধান শিখিয়ে যাচ্ছে সেখানে…।এরপর উনি মাঝে মধ্যে আসতেন। আমার শ্বাশুড়ি মা ও যেতেন কখন কখন। ওনার সাথে দুএকটি সভা সমিতিতেও গেছেন।
ওনার ছেলে সুবীরের বিয়ে হল। আমাদের নিমন্ত্রণ হল। শ্বাশুড়ির সাথে গেলাম। সত্যি বড়লোক আর আধুনিক এদেরই বলে, কি সাজে।,কি কথাবার্তায়। ফুলশয্যা বলে না বলে রিসেপশান পার্টি, বৌ আমাদের মত করে বেনারসি পরছে, সামনে আঁচল করে না। মাথায় ভেল বা ওড়না নেই। বৌমাকে কি সুন্দর ‘তুই তুই’ করে কথা বলছে। আমার অল্প বয়স, কি এক মুগ্ধতা ঘিরে রইল।
বেশ কিছুকাল বাদের কথা। সে বছর জামাইষষ্ঠী তে তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল তাই বাপের বাড়ি যাওয়া হয় নি। রবিবার বাবা বলে গেছেন, আমি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি তখন লিলির মা আন্টি এলেন। মাকে ডাকতে এসেছেন, ওনাদের একটা সাহিত্য আলোচনার আসর আছে তাই সন্ধ্যেতে যেতে বলে গেলেন। আমি বাপের বাড়ি যাচ্ছি শুনে আমার শ্বাশুড়িকে বললেন ” এই রমা ভালো একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে,তুমি তো সন্ধ্যেবেলা আমার বাড়ি যাবেই তখন সুবীরের বৌএর সামনে বলবে যে ‘কি জামাইষষ্ঠী র তত্ত্ব এলো? দেখালে না তো?’ আমার বৌমারটা তো দেখালাম। ‘ তখন আমিও শোনাবো। জঘন্য তত্ত্ব দিয়েছে ভাই রমা। লোককে বলার নয়, দেখানোর নয়। নজর ছোট, চার পাঁচটা ঝুড়িতেই প্রথম বছরের জামাইষষ্ঠী সেরেছে। দেওয়া থোওয়ার হাত একদম নেই ভাই। একদমই অভিজাত ঘরের মেয়ে নয়। ” আমি বেরোবার আগে মাকে প্রণাম। করতে গিয়েছিলাম। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই সেই আধুনিক মহিলা!! যিনি আমাকে বলে ছিলেন একজন মেয়েই একজন মেয়ের সম্মান রাখতে পারে। এর থেকে আমার বাড়ি যে অমলার মা কাজ করে সেও তো অনেক বড় মনের, ছেলের বৌকে চেয়েচিন্তে” সিলিকের” শাড়ি পরায়, বৌ মা মরা মেয়ে বলে কাজের বাড়ি ছুটি নিয়ে আঁতুড় তোলে। সেই মূর্খ গ্রাম্য মেয়েছেলে বলে “কি কব্ব মা মেয়েমানুষ হয়ে মেয়েমানুষ এর দু:ক বুঝবুনি। আমরা যে মায়ের জাত মা “আমার অল্পবয়সী মনে খুব আঘাত লেগেছিল। আধুনিকতার মানে বদলে গিয়েছিল। আমি এত বছরেও তা ভুলিনি।।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধবাগাতিপাড়ায় অটো উল্টে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান গুরুতর আহত
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে