আম্মা নেই কোথাও… পলি শাহিনা

0
302
Poly Shahina

আম্মা নেই কোথাও…
পলি শাহিনা

ঘুম ভাঙতেই দেখি আম্মা আমার মাথার পাশে গা এলিয়ে বসে আছেন। আমি মাথাটা তাঁর কোলে রাখি। জানালার পর্দা ভেদ করে সকালের নরম তুলতুলে সোনালি রোদ এসে আমার মুখে পড়ে। আম্মা আলতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আমার চুলে। বুনুনি কাটছেন। আমি দুচোখ বন্ধ করে তাঁর আদর গিলে গিলে খাচ্ছি। জগতে কিছু অনুভূতি বিদ্যমান আছে, যা শুধু অনুভব করা যায়, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আম্মার আদর তেমনি, শুধুই অনুভব করা যায়, ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো যায় না। এবার আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম তিনি আমাকে নাম ধরে ডেকে বলছেন, ‘ওঠ মা, আমাকে ইনসুলিন দিয়ে দে! রুটি, সবজি নিয়ে আয়! খিদে পেয়েছে খুব! ‘
আমি ধড়ফড় করে উঠে বসি। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি, আম্মা নেই কোথাও…।

০১৯৩৯২৪০১০০-এই মুঠোফোন নম্বরটি আমি কোনো দিন ভুলব না। জীবনের কোনো প্রান্তে যদি কোনো দিন স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যায়, তবুও আমার বিশ্বাস এই নম্বরটি আমি ভুলে যাব না। এটি আমার আম্মার নম্বর। বাড়ি ছেড়ে দূরে আসার পর রোজ সকালে ঘুম ভাঙার পর আম্মাকে কল করতাম। আম্মার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দাঁত ব্রাশ করতাম। আমার যত অদরকারি বস্তাপচা রাজ্যের বকবকানি, আম্মা ধৈর্য সহকারে শুনতেন। আমাকে ছেড়ে আম্মা চলে গেছেন পাঁচ বছর আগে। আজও আমি ঘুম ভেঙে আম্মার নম্বরে ভুলে ফোন করে বসি। ওপাশে কেউ ফোন ধরে না। আদর মাখা ‘পলি’ নাম ধরে ডাকে না। সবকিছুই আগের মতন আছে। প্রতিদিন সকাল হয়, আলোর বন্যায় প্লাবিত হয় পৃথিবী। শুধু আম্মা নেই কোথাও…।

হাড় কাঁপানো শীতে কাজ থেকে ফিরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কোনোভাবেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে পারছি না। হাতের আঙুলগুলো শীতে জমে যেন বরফের মতো শক্ত হয়ে আছে। হঠাৎ ভেতর থেকে দরজা খুলে যায়। হকচকিয়ে তাকিয়ে দেখি, আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন। আপ্লুত কণ্ঠে জানতে চাইলাম, কেমন করে বুঝলেন আমি এসেছি! হেসে বললেন, সন্তানের যেকোনো কষ্ট মায়ের বুকে এসে লাগে। জানালায় তোর ঘরে আসার পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে! তোর পায়ের শব্দ, গায়ের গন্ধ আমার চেনা। আজও আমি হাড় কাঁপানো শীতে যখন চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলতে কষ্ট হয়, তখন অপেক্ষায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি, যদি আম্মা ভেতর থেকে দরজা খুলে দেন! আমি অপেক্ষায় দাঁড়িয়েই থাকি। আমার অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলে দেয় না। আম্মা নেই কোথাও…।

ছোটবেলা থেকেই আমি সাজগোছ করতে জানতাম না। সাজগোজের বিষয়ে আমি এখনকার মতো ছোটবেলায়ও খুবই কাঁচা ছিলাম। চুল সুন্দর, পরিপাটি করে বাঁধতে জানতাম না বলে সব সময় চুল খোলা থাকত। তবে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে আম্মা সুন্দর করে আমার চুল বেঁধে দিতেন। আম্মার জন্য আব্বার বিদেশ থেকে পাঠানো সুরমাদানি থেকে আমার চোখে কাজল লাগিয়ে দিতেন। আজও আমি বেড়াতে যাওয়ার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি আম্মা চুল বেঁধে দেবেন ভেবে। চোখে কাজল লাগিয়ে দেবেন বলে। আমার খোলা চুল অযত্নে অগোছালো উড়তে থাকে। দুচোখের সব কাজল ভেসে যায় অথই জলে। আম্মা নেই কোথাও…।

যখন মা কে ছেড়ে বিদেশে আসি, তখন মুঠোফোন ছিল না। চিঠি-ই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। প্রতি সপ্তাহে আম্মাকে চিঠি লিখতে হতো। চিঠি না পেলে কত যে রাগ করতেন। আমার চিঠি না পেলে চিন্তায় নাকি ঘুমাতে পারতেন না। আজও আমি প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখি আম্মার নামে। আম্মার ঠিকানা জানি না বলে সে চিঠিগুলো পড়ে থাকে ডায়েরির ভাঁজে। চিঠিগুলো চোখের পানিতে ভিজে আবার বুকের তপ্ত শ্বাসে শুকায়। আম্মা নেই কোথাও…।

ছোটবেলায় ভীষণ ঘুম কাতুরে ছিলাম। সন্ধ্যাবেলা হাঁস, মুরগির চোখে ঘুম নেমে আসার আগে আমার চোখে ঘুম নেমে আসত। স্কুল থেকে ফিরে কত দিন যে ভীষণ ক্লান্ত শরীরে মাথা বিছানায় আর হাত-পা শূন্যে ঝুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি তার হিসাব নেই। কখন যে আম্মা এসে বিছানায় ঠিক করে শুইয়ে দিতেন বলতেও পারতাম না। পড়ার টেবিলে কত দিন ঘুমিয়ে পড়েছি তারও ইয়ত্তা নেই। টের-ও পেতাম না কখন আম্মা মশারির নিচে বিছানায় রেখে আসতেন। আজও সারা দিনের কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে অগোছালোভাবে ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু কেউ মাথার নিচের বালিশটা ঠিক করে দেয় না। গায়ে কাঁথা টেনে দেয় না। আম্মা নেই কোথাও…।

অল্প বয়সেই আম্মাকে ছেড়ে অজানা, অচেনা বিদেশের পথে পা বাড়াই। প্রথম দিকে বিদেশে আমার বাবা-মা-ভাইবোন কেউ ছিল না। বাবাকে জীবনে খুব কম সময় কাছে পেয়েছিলাম বলে আম্মা-ই ছিলেন আমার পৃথিবী। বিদেশে আসার পর কোনো কারণ ছাড়াই রাত–দিন এমনকি মাঝরাতেও ফোন করে মিছেমিছি আম্মাকে ডাকতে থাকতাম। আম্মা মাঝেমধ্যে দুষ্টুমি করে বলতেন, ‘তোর ম্যা ম্যা (আম্মা আম্মা) বন্ধ কর! তোর মুখে আম্মা ডাক শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছি! আম্মা ডাকা বাদ দিয়ে খালাম্মা ডাক! ‘ এখনো ভীষণ একলা লাগে যখন আম্মা-আম্মা বলে ডাকতে থাকি একা রুমের মধ্যে। আমার এই ডাক দেয়ালের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসে আমার বুকে আঘাত করে। বুকের সব রক্ত ঝরে যায়, তবুও আম্মার কান পর্যন্ত আমার ডাক পৌঁছায় না। আমি দুর্বল শরীরে ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকি শূন্য বুকে। আম্মা নেই কোথাও …।

আমি বিনিদ্র রাত জেগে থাকি যদি আম্মা আসেন। কান খুলে রাখি যদি একবার আম্মা নাম ধরে ডাকেন। আমি মনের সব দরজা-জানালা খুলে বসে আছি, বসে থাকব অনন্তকাল যদি আম্মা আসেন। আমার কপালে একটু হাত রাখেন। নিস্তব্ধ রাত। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দূরের আকাশে ভেসে যাওয়া এক টুকরো রূপালি আলো এসে পড়ে আমার চোখেমুখে। আমি ধরতে গেলেই হারিয়ে যায়। আমি আবারও ডুবে যাই অন্ধকারে। আম্মা নেই কোথাও…।

( ২৬ জুলাই ঠিক এসময় আম্মার চির বিদায়ের সংবাদ পাই। বছর গড়ায়, বুকের ক্ষত ক্রমাগত বেড়েই চলে। এই কষ্টের শেষ নেই…)

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবিরাম যুদ্ধের ক্লান্তি! – জাকির তালুকদার
পরবর্তী নিবন্ধআসুন মানুষের পাশে দাঁড়াই – স্বকৃত নোমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে