দেবাশীষ কুমার সরকার : টেলিভিশনের পর্দায়, কিংবা পেপার পত্রিকা খুললেই প্রতিদিনই চোখে পড়বে করোনা আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যু হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন। এসব প্রতিবেদনে অধিকাংশটাই জুড়ে থাকে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নানা অনিয়মের পাশাপাশি আমাদের অসহায়ত্বের কথা। শুধু অনিয়ম নয়, শুধু অসহায়ত্ব নয়, আমাদের হাসপাতালগুলোর সার্বিক চিত্র, রোগ-জীবাণুর কাছে তিল তিল করে হেরে যাওয়া আমাদের মানবিকতার চিত্র, সবকিছুই ফুটে উঠছে শিল্পীর রঙিন তুলিতে। আসলে এসবের পেছনে কি শুধু সরকারের অক্ষমতা দায়ী? দায়ী কি আমাদের দুর্নীতি গ্রস্থ প্রশাসন? না কি আমাদের সমাজ ব্যবস্থা? নাকি দায়ী পুঁজিবাদী সভ্যতার অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক।
হ্যাঁ আজ আমাদের জবাব খুঁজবার সময় এসেছে। কয়েকদিন আগে ফেসবুকের পাতায় একজন ডাক্তারের করুন কিছু কথা চোখে ভেসে উঠলো। তিনি আমাদের দেশের বড় দু’টি বেসরকারি হাসপাতলে করোনা পরীক্ষার যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা মর্মান্তিক। এই করোনা কালীন সময়ে তারা যে গলাকাটা ব্যবসা করছেন তা একজন ডাক্তার ভুক্তভোগী তুলে ধরলেন। সরকার নির্ধারিত ফি এর চেয়েও বেশি টাকা নিয়ে করা হচ্ছে করোনা পরীক্ষা। স্কয়ার হাসপাতাল ও আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিত্র তুলে ধরেছেন ওই ভুক্তভোগী ডাক্তার। সরকার নির্ধারিত সাড়ে তিন হাজার টাকার অতিরিক্ত আরো ১০০০ টাকা মোট সাড়ে চার হাজার টাকা করে নিচ্ছে তারা। এই যদি হয় সেবার চিত্র তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
আমরা সাধারণরা তো নিরুপায় নিঃসহায় আমরা না হয় নীরবে নিভৃতে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসা নেওয়ার পরেও সামর্থের কাছে হেরে গিয়ে মৃত্যুকে মেনেই নিলাম। কিন্তু যাদের সামর্থ্য রয়েছে?? যারা আমাদের দেশের তথাকথিত ধনিক শ্রেণী। তাদের কি অবস্থা? তাদের ব্যাংকে জমানো লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা, তাদের সম্পর্কের মানুষগুলো, সবকিছু পড়ে থাকছে। আর নির্মম মৃত্যুর কাছে তাদেরকে হেরে গিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। কিন্তু কেন? গত কয়েকদিন আগে খবরের কাগজের বড় একটি লাইন দেখলাম। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন এস আলম গ্রুপের মোরশেদুল আলম।
কি হয়েছিল তার? প্রশ্নটি খুব সহজ, উত্তরটাও খুব সহজ। কিন্তু কেন? সামান্য জ্বর সর্দি হলে সামান্য কাশি হলে শরীর ব্যথা হলে যে মানুষগুলো ছুটে যেতেন সিঙ্গাপুর। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যাদের কোন আস্থা ছিল না। অথচ কোটি কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও এই দুঃসময়ে তাদেরকে চিকিৎসা নিতে হলো দেশের হাসপাতলে। পরিশেষে অক্সিজেনের অভাবে, একটি আইসিইউ বেডের অভাবে মৃত্যু হল তার। অথচ এই এস আলম গ্রুপের দখলে রয়েছে আটটি ব্যাংক, তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দুটি বীমা কোম্পানি সহ মোট ৩৪ টি কোম্পানি।
শুধু বাংলাদেশ নয় সিঙ্গাপুর কানাডার ধনীদের তালিকায় স্থান পেয়েছে এই গ্রুপটি। গ্রুপের পাঁচ ভাই সহ মোট ছয়জন করোনা আক্রান্ত। এর মধ্যে এক ভাই মারা গেলেন, আরেক ভাইয়ের অবস্থা সংকটাপন্ন। দুই ভাই যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তখন তারা দুই ভাই মিলে পেয়েছিলেন একটিমাত্র আইসিইউ বেড। অক্সিজেন ছিল শুধু একজনের জন্য। অল্টারনেট করে ব্যবহার করতে হচ্ছিল অক্সিজেন। পরিশেষে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন বড় ভাই মোরশেদুল আলম।
এটাই হচ্ছে তাদের নিয়তি। অথচ তাদের যে পরিমাণ টাকা রয়েছে তার সামান্য অংশ দিয়ে দিয়ে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে হাজার হাজার আইসিইউ বেড নির্মাণ করতে পারতেন। দান করতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। তারা ভাবতেই পারেননি দেশের অবস্থা এই পর্যায়ে যাবে। কারণ তাদের অর্থ রয়েছে তারা চিকিৎসা নেবেন বিদেশে গিয়ে। কখনো এরকম নির্মম নিয়তি আসবে তারা কখনো ভাবতেই পারেননি।
তাহলে করোনা আমাদেরকে কি শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে কিংবা গেল?? আজকে আমাদের সেগুলো ভাবতে হবে। যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য রয়েছে তারা শুধু দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি, স্বাস্থ্য বিভাগের অক্ষমতা নিয়ে ভাবলে হবে না, তাদের কে এগিয়ে আসতে হবে সহযোগিতার হাত নিয়ে। পুঁজিবাদী সভ্যতায় শুধুমাত্র নিজের আখের গোছানোর যে ব্যবস্থাপনা তা থেকে আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে।
লোক দেখানো জনকল্যাণ নয়, অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে সবার কল্যাণ, সবার মঙ্গল। বাংলাদেশের বিত্তশালী যে কয়টি গ্রুপ রয়েছে ইচ্ছা করলে তারা রাতারাতি পাল্টে দিতে পারেন দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৈন্যদশা। সেখানে শত শত আক্রান্তদের চিকিৎসা হতে পারে সাবলীল সক্ষমতায়। সে বোধোদয় কি হবে তাদের???