হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার;
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার।
এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ, স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।
এই শ্বাশত মহামানবকে আহ্বানের যে আকাঙ্ক্ষা তা আর কারো নয় আমাদের কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের। খুব অল্প বয়সে যিনি এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে। তাই তার কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল এক মহামানবকে আহ্বানের। এই মহামানব হতে পারেন রাজনৈতিক, হতে পারেন বৈজ্ঞানিক কিংবা হতে পারেন কোন বিজ্ঞ চিকিৎসক। কিংবা সবাই। যারা আমাদের এইযে জমে থাকা অন্ধকার, নীরব মৃত্যু, মহামারী, মন্বন্তর সবকিছু থেকে জাতিকে উদ্ধার করবে। সেই কতদিন আগে যে আহ্বান তিনি করেছিলেন আজো তা বর্তমান। বর্তমান করোনার এই মহামারীতে যখন বিশ্ব দিশেহারা তখন তার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে কোন মহামানব কে আহবান করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কিছুই করার নেই। তাই নাটোর কন্ঠ পরিবার কবি সুকান্ত ভাট্টাচার্যের ৭৩ তম প্রয়াণ দিবসে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছে সেই মহান কবি কে।
বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি সুকান্ত ভাট্টাচার্যের ৭৩তম প্রয়াণ দিবস আজ ।১৯৪৭ সালের ১৩ মে মাত্র ২১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।উনিশ শতকের গোড়াতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন এই কবি।এ সময় বিপ্লববাদী ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভেতর থেকে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সুকান্ত ভট্টাচার্য।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা:
সুকান্ত ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতার কালিঘাটের কাছে মাতামহের ৪৩ এর মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা-নিবারন ভট্টাচার্য ও মা-সুনীতি দেবী। পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) কোটালীপাড়া উপজেলার উনশিয়া গ্রামে।
১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। সুকান্তের বাল্যবন্ধু ছিলেন কবি অরুনাচল বসু। সুকান্ত সমগ্রতে লেখা সুকান্তের চিঠিগুলির বেশিরভাগই অরুনাচল বসুকে লেখা। অরুনাচল বসুর মাতা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রস্নেহে দেখতেন। সুকান্তের ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাকে সেই অভাব কিছুটা পূরণ করে দিতেন। কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়ীতে। সেই বাড়িটি এখনো অক্ষত আছে।পাশের বাড়ীটিতে এখনো বসবাস করতেন সুকান্তের একমাত্র ভাই বিভাস ভট্টাচার্য।পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুকান্তের নিজের ভাতুষ্পুত্র।
প্রগতিশীল রাজনীতি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,তেতাল্লিশের মম্বন্তর,ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই বছর আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
সাহিত্যকর্ম:
সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন।তার কবিতায় অনাচার ও বৈষ্যমের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ পাঠকদের সংকচিত করে তোলে। গণমানুষের প্রতি গভীর মমতায় প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২),গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়।সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
মৃত্যু:
পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য রোগ যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।