তাম্রাক্ষের অবসান ১৯৭১

0
174
Mahfuza Polok

তাম্রাক্ষের অবসান ১৯৭১

গল্প হলেও সত্যি

মাহফুজা আরা পলক : চলছে তাম্রাক্ষ কাল।নিশুতি রাত,অনিশ্চিত সময়।রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে কাছাকাছি কোন গাছের ঝোপ থেকে কিছুক্ষণ পর পর ভেসে আসছে পেঁচার অশুভ ডাক।ধূর্ত শেয়াল গুলো হয়তো অশরীরী ছায়ায় ভীত হয়ে প্রহরে প্রহরে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে দলবেঁধে। ঘোর অমাবস্যার আঁধারে ডুবে আছে চারিদিক।

আমেনা খাতুন শুনতে পাচ্ছেন কে যেন তাকে বার বার ডেকে বলছে -ওঠ,ওঠ, ওঠে গোসল করে এক্ষুনি পঞ্চাশ রাকাত নামাজ পড়।বঙ্গবন্ধুর বড় বিপদ। আমেনা খাতুন ঘুম থেকে এক লাফে ওঠে বসলেন। তার হৃৎপিণ্ডটা এখনো ধুকপুক করছে।

কী হলো তবে বঙ্গবন্ধুর? তার স্বামী মালেক সাহেব আজকাল প্রায়ই বলছেন এবার একটা কিছু হবে।বঙ্গবন্ধু ৭’মার্চে যে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছেন এর পর বাঙালি গর্জে উঠবেই। পাকিস্তানিদের এবার এদেশ ছাড়বার সময় এসেছে নিশ্চিত।

আমেনা খাতুনের পাঁচ মেয়ে তিন ছেলে। বর্তমানে সে আবারও অন্তঃসত্ত্বা। শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। একবার ভাবলো তার স্বামীকে ডেকে তুলবে -পরক্ষণে আবার চিন্তা করলো থাক, এতরাতে ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না।

অলসতা না করে তিনি ওঠে গিয়ে গোসল করলেন। এরপর নামাজের বিছানা নিয়ে বসলেন পঞ্চাশ রাকাত নামাজ পড়তে। মনে মনে দোয়া করতে থাকলেন আল্লাহ পাক যেন বঙ্গবন্ধুকে শতায়ু দান করেন।

নামাজ শেষ করতে করতে ফজরের আজান পড়ল। সুবহে সাদিকের পর ধীরে ধীরে পূব আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠল। আমেনা খাতুন সাহেরাকে ডেকে তুললেন উঠোন বাড়ি ঝাঁট দেওয়ার জন্য। গোমস্তা মুইখ্যাকে ডেকে গরু গুলোকে গোয়াল ঘর থেকে বের করে পানি ভূষি দিতে বললেন।

তিনি নিজে গিয়ে হাঁস মুরগি গুলোকে খোঁয়াড় থেকে বের করলেন। এরপর রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। বাড়ির পেছনের পাঁচিলে বসে একটা কাক কা কা করে একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে। তার মনে কু গাইতে থাকলো।

বেলা বাড়লে সকলে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। আমেনা খাতুন আজ খিচুড়ি আর নিজের ঘরের হাঁসের ডিম ভুনা করেছে। ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি পেয়ে সকলেই খুব খুশি।বড় মেয়ে দোলনার বিয়ে হয়ে গেছে। তার বড় মেয়ে অত্যন্ত রূপবতী।

তুখোড় ছাত্রী হওয়ার পরও পাত্রপক্ষের চাপাচাপিতে এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সে এখনো পড়াশোনা অব্যাহত রেখেছে।কামাল, নাজরিণ,শামীম, চায়না ও পারভেজ খেতে বসেছে। খেতে খেতে নাজরিণ বললো আম্মা আজ কিন্তু পিঠা বানাতে হবে।

আপনার হাতের পিঠার মতো স্বাদ করে কেউ বানাতে পারেনা। চায়না বললো আপা আমাকে একটু বেশি দিতে হবে। আমেনা খাতুন ছোট মেয়ে নাভানাকে কোলে নিয়ে একটু হেসে বললেন, পিঠার চাল ভিজিয়েছি। সাহেরাকে বলেছি ঢেঁকিতে চালগুলো কুটতে।

বাড়ির বিশাল উঠোনের একপাশে আমেনা খাতুন ঢেঁকিঘরও করে রেখেছেন, যেন তার সন্তানদের যখনতখন পিঠা বানিয়ে খাওয়াতে পারেন। তিনজনই খুব খুশি হলো।তার বড় ছেলে কামাল পিঠা খেতে খুব ভালবাসে, তবে আজ কেন জানি চুপচাপ খেয়ে উঠল।

কিছুক্ষণ পর আব্দুল মালেক সাহেব মোটরসাইকেলে করে গঞ্জের দিকে রওনা হলেন। আনোয়ার কামাল এবার দশম শ্রেণিতে ওঠেছে। খুব সাহসী হয়েছে ছেলেটা। এজন্য আমেনা খাতুনের মনে মনে একটু ভয়ও লাগে।

দুপুর বেলা মালেক সাহেব তার মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরলেন চিন্তিত মুখে।উঠোনের এক কোনে মোটরসাইকেলটা দাঁড় করিয়ে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে এলেন। এল প্যাটার্নের বারান্দায় পেতে রাখা ইজি চেয়ারে বসে তিনি খুব ঘামছেন।

আমেনা খাতুন হাত পাখা নিয়ে এসে জোরে জোরে বাতাস করতে লাগলেন। মালেক সাহেব বললেন- আমেনা সর্বনাশ হয়ে গেছে! গতকাল গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নং বাসভবন থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে গেছে।

(২৬’ মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।)শুনেছি ঢাকা শহরে সারারাত ধরে বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপর নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। দেশের যে এখন কী হবে তা কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমেনা খাতুনের গত রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। সত্যিইতো এখন কী হবে!

(১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচালিত অভিযানে প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছিল বলে দাবি করে বাংলাদেশ।) বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার পর কামাল সহ স্বাধীনতার স্বপক্ষের কিছু লোকজন বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে রাস্তায় নামে।

মুক্তিকামী জনতা সোচ্চার হয়ে ওঠতে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণটি কামালের কানে অনুরণিত হতে থাকে।
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জয় বাংলা”।

এই কথা গুলো অবচেতন মনে কামালের মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসলো। সে আরো জোরে বলে উঠলো – জয় বাংলা।
পেছন থেকে একটা রব উঠলো – জয় বাংলা।
কি এক শক্তিশালী শান্তির বাণী!
উচ্চারণ করলেই মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়।

দিন কয়েক পর কামালের গতিবিধি আমেনা খাতুনের কাছে বেশি সুবিধা ঠেকল না। তিনি একদিন বললেন -বাজান প্রায়ই মানিক,শহীদুল,বাবুল,মতি মিয়া দেখছি তোমাকে ডেকে নিয়ে যায়। তারা ইদানীং ঘন ঘন আসছে। তোমাকে নিয়ে আবার কোথায় যেন চলেও যাচ্ছে। কী বিষয় বাজান? আমাকে খুলে বল। নইলে যে মনে শান্তি পাচ্ছি না।

কামাল তার আম্মাকে বলে- না আম্মা তেমন কিছু না।কিছু হলেতো আপনাকে জানাতাম। কামাল সকালে গোসল সেরে ক’টা মুখে দিয়ে দ্রুত স্কুলে চলে গেলো। রাস্তায় বের হয়ে দেখলো ঝকঝকে রোদ উঠেছে। আজ মনটা তার ভালো হয়ে গেল। স্কুলের মাঠে আজ টিফিনে একটু ফুটবল খেলতে পারবে। তার ফুটবল খেলার খুব শখ।

ক্লাসের ঘন্টা গুলো এত দীর্ঘ কেন মনে হচ্ছে? আজ সময় যেন পার হতে চাচ্ছে না। টিফিন ঘন্টা বাজতেই তার আনন্দের সীমা রইল না। মাঠে গিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে হঠাৎ শ্লোগান ধরলো – জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

এই শ্লোগান শুনে প্রধান শিক্ষক জনাব আমিরুদ্দীন আহমদ এসে বললেন – গরুর মতো কে চেঁচাচ্ছেরে? তখন সকল ছাত্র নিশ্চুপ হয়ে যায়। কামালকে সকলে ভালোবাসে বলে ওর নাম কেউ বলতে চাইছে না।

প্রধান শিক্ষক তাদের কিছু করবেন না বলে আস্বস্ত করলেন। তখন কামাল স্বীকার করলো যে, সে শ্লোগান দিয়েছে। সেদিন প্রধান শিক্ষক তাকে আর কিছু বললেন না। ১৯৭১ এর এপ্রিলের উনিশ তারিখ পাকসেনারা কিশোরগঞ্জে প্রবেশ করে।

স্কুল থেকে বের হতেই থানার চত্বরে পাকসেনাদের জমায়েত কামালের চোখে পড়লো। তার মনে একটা অজানা সংশয় দেখা দিল-তাহলে এবার আমরা কী পাকসেনাদের মুখোমুখি হয়ে স্বাধীকার ফিরিয়ে আনতে পারবো? সে মনে মনে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়, না আমরা এবার আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবোই।

সে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবে জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়াতে হেডস্যার এত রাগ করলেন কেন? উনি কী তবে স্বাধীনতা চায় না? না ভয় পেয়েছিল।তবে একজন প্রধান শিক্ষক এমন হবেন কেন? নানান চিন্তা মাথার ভেতর খেলা করতে থাকে।

আমেনা খাতুন চালের গুড়ো নিয়ে বসেছেন পিঠা বানাতে। আজ বাড়ি জমজমাট। কারণ আজ বাড়িতে কামালের নানু এবং বড় মা এসেছেন। সাথে তাদের দু’একজন নাতিও এসেছে। বড় কড়াইয়ে অনেকটা তেল দিয়েছেন আমেনা খাতুন। ডুবা তেলের পিঠা বানাবেন তিনি।

উনুনের আগুন মাঝারি আঁচে রেখে তিনি গুড় আর চালের গুঁড়ো গুলাতে লাগলেন। বাড়ির বাচ্চাদের আগ্রহের সীমা নেই। ফুলকো পিঠা গুলো একদিক দিয়ে ভাজা হচ্ছে অন্য দিক দিয়ে ফুরিয়েও যাচ্ছে। পিঠাতে পাটখড়ির কাঠি গেঁথে ছাতার মতো হাতে নিয়ে বাচ্চাদের পিঠা খেতে দিয়েছেন তিনি।

বাচ্চাগুলো মহানন্দে সেই কাঠির মাথায় গাঁথা গরম গরম পিঠা বাড়িময় ঘুরে ঘুরে খাচ্ছে। পিঠা কাঠিতে গাঁথার মূল কারণ হলো, পিঠা অনেক গরম। হাতে নিয়ে এখন খাওয়া সম্ভব নয়।বাড়িতে উৎসব উৎসব একটা ভাব চলছে।

আগামীদিন গুলোতে এই দেশে কী হতে চলেছে তা এ বাড়ির কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পেল না সেদিন। বাড়িতে মেহমান থাকায় আজ কামালের স্কুলের জন্য বের হতে একটু দেরি হয়ে গেছে। স্কুলে ঢুকে দেখে এসেম্বলি শেষ হয়ে গেছে। ক্লাসে সবেমাত্র ছাত্ররা ঢুকছে।

তখন প্রধান শিক্ষক আমিরুদ্দীন আহমদ কামালকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন- এসেম্বলির পরে কেন এসেছ? এই বলে হাত পাততে বললেন এবং উপর্যুপরি বেত্রাঘাত করতে লাগলেন।একপর্যায়ে হাত থেকে কামালের রক্ত পড়তে লাগলো।

কামালের বুঝতে বাকি রইল না যে,গতকালের শ্লোগানের রেশ চলছে আজ। তার দৃঢ় দৃষ্টি দেখে হেডস্যার বেত্রাঘাত বন্ধ করলেন। (পরবর্তীতে কামাল জেনেছিল এই প্রধান শিক্ষক জামাতে ইসলামের অনুসারী ছিলেন।)

আজ কিশোরগঞ্জ বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে আর্মিদের জিপগাড়ির বহর।কামালের বড় বোনজামাই এম এ আারী খান এই স্কুলের একজন শিক্ষক। সারা স্কুলে কারা যেন পাকসেনাদের বিরুদ্ধে পোস্টার দিয়ে ছেয়ে ফেলেছে। পোস্টারের শ্লোগান গুলো হলো-

‘বইয়ের পাতা ছুঁড়ে মার
বাংলাদেশ স্বাধীন কর’
‘ইস্কুল কলেজ বর্জন কর
মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়’।

একজন আর্মি অফিসার উঁচু গলায় কথা বলে যাচ্ছে -“এ কাম কিসনে কিয়া?তুরন্ত পাকড়াও উনকো।ইয়ে পাকিস্তান থা, পাকিস্তান হে অর হামেশা পাকিস্তান রেহেগা।” একটা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পাকসেনারা স্কুলের সব সার্চ করছে। তখনও কামাল জানতো না এই যন্ত্রটি কী জিনিস।

স্কুলের এ্যাসিস্ট্যান্ট হেড টিচার বারী স্যার স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। কামালকে ডেকে বললেন তুমি স্কুল থেকে চলে যাও।এখন তুমি স্কুলে থাকলে তোমারও যেমন বিপদ হবে তেমনি আমাদেরও বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।

কামাল তাকিয়ে দেখলো অদূরে স্কুলের দপ্তরি নিজাম দাঁড়িয়ে আছে। তখন সে বুঝতে পারলো পোস্টার লাগানোর সময় নিজাম তাকে দেখেছিল আর সে বারী স্যারকে বলেছে।
কামাল সেদিন স্কুল থেকে বের হয়ে বিজয়ের হাসি হেসে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল।

দুপুর বেলা কামালের মা তরকারি কুটার জন্য বটি খুঁজে পাচ্ছিল না।সেই সময় তিনি দেখলেন কামাল বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়ির মুল ফটক দিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি কিছুটা বিস্মিত হলেন।ছেলেটা ব্যাগ হাতে যাচ্ছে কোথায়?

নগুয়া এলাকার মোড়ে দুটো জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মোড়ের কাছে কিছু হিন্দু বাড়ি। সেই বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করে গৌরাঙ্গ চন্দ্র বসাক এবং তার বাবা ফনিন্দ্র বসাক শিক্ষিত একটি পরিবার। পাকিস্তানি আর্মি তাদেরকেও নির্যাতন করতে ছাড়লো না।

পাশের বাড়িতে সজোরে আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। ষোল বছরের মালতীকে আর তার বোন মিনতিকে রাজাকাররা তুলে নিয়ে যাচ্ছে আর্মি ক্যাম্পে।মালতীর বাপ ভাই তাদের বাঁধা দিলে তৎক্ষণাৎ তাদের উপর নির্যাতন শুরু করে। মালতী ও তার বোনের চুল একত্রে বেঁধে নিয়ে টেনে হিঁচড়ে জিপগাড়িতে তুলে।

আজ আর্মিরা শহরে টহল দেওয়ার সময় এক জায়গায় কিছুক্ষণের জন্য তাদের গাড়ি থামিয়ে ছিল। গাড়িতে স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখে প্রতিটা গাড়ির একটি করে চাকা কে যেন কেটে রেখে গেছে। অফিসার রাগে ফুঁসে অকথ্য ভাষায় প্রচন্ড গালিগালাজ শুরু করে দিল।

কামালের আজ খুব আত্মতৃপ্তি লাগছে। সে কিছু একটা করতে পেরেছে। যদিও প্রাণ নাশের সম্ভাবনা ছিল পুরোপুরি। মালেক সাহেবের জন্য তার স্ত্রী বাইন মাছ রেঁধেছে। আমেনা খাতুন যদিও বাইন মাছ কাটতে ভয় পান তবুও স্বামীর পছন্দ বলে সাহেরাকে দিয়ে কাটিয়ে যত্ন করে রেঁধেছেন।

তার রান্নার সুনাম সকলেই করে। খেতে বসে মালেক সাহেবকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। তিনি সি এম বিতে চাকরি করতেন। টাঙ্গাইল বদলি করাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় সেই সরকারি চাকরি ছেড়ে প্রথম শ্রেণির ঠিকাদারির কাজ শুরু করেন।

কিছুদিনের মধ্যে তিনি সবকিছু ভালো ভাবেই গুছিয়ে নিয়েছেন। কিশোরগঞ্জ শহরের লোকজন তাকে সততা এবং ব্যক্তিত্বের জন্য যথেষ্ট সমীহ করে। তার বাসা নগুয়ার ঠিক মোড়ে। এই মোড়টাতে আসতে গিয়ে লোকজন মালেক সাহেবের মোড় বলে পরিচয় দেয়।

মালেক সাহেবকে রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান বানানো হয়েছে। উনার সততার সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। [পদ পদবীর মোহহীন এই মানুষটিকে পরবর্তী সময়ে
(১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত) হয়বত নগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি করা হয়,একই সাথে কিশোরগঞ্জ শহর আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি নির্বাচন করা হয়৷]

দেশের আশঙ্কাজনক অবস্থা দেখে তিনি তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে বাজার থেকে কয়েক দিনে পর্যায়ক্রমে চাল, ডাল, তৈল, সাবান, কেরোসিনের টিন থেকে শুরু করে কয়েকটা কাপড়ের থান সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র কিনে এনেছেন।দেশের অবস্থা কি হবে তা বলা যাচ্ছে না। উড়ো খবরে দেশ ছেয়ে গেছে।

খাওয়া শেষ করে তিনি বললেন, আমেনা আমি চিন্তা করেছি তোমাদেরকে খুব শীঘ্রই তোমার বাবার বাড়ি কামালিয়ারচর গ্রামে পাঠিয়ে দেব। দেশের অবস্থা একদম ভালো না। ঢাকায় নাকি গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ঢাকা থেকে আমার বন্ধু খুরশিদের বড় ভাই শাহেদ ভাইজান টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন।

তারাও চলে আসবেন গ্রামের বাড়িতে।শাহেদ ভাইজানের ছেলে ফয়সালও নাকি গেরিলা যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। দীনা ও সোমাকে নিয়ে চিন্তা করছেন তারা। আমেনা খাতুন তখন বলে ওঠেন- শাহেদ ভাইজানের মেয়ে দুটোর গানের গলা বেশ মিষ্টি।

আমি একদিন শুনেছিলাম।মালেক সাহেব নাজরিণকে ডেকে বললেন রেডিওটা দিয়ে যেতে। এই মেয়েটা রেডিও নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। কখনো গান,কখনো শিক্ষনীয় অনুষ্ঠান অথবা নিত্যনতুন সংবাদ সবার আগে তার পাওয়া চাই।

নাজরিণ তার বাবার হাতে রেডিওটি দিয়ে বললো- আব্বা দেশের অবস্থা শুনলাম খুব খারাপ। তিনি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। মালেক সাহেব রেডিওর ভলিউম কমিয়ে নতুন খবরের আশায় টিউনিং করতে থাকেন।

কয়েকমাস হলো আমেনা খাতুনের গরুর বাছুর হয়েছে। গোমস্তা মুইখ্যা খুব যত্ন করে গরু-বাছুর গুলোকে। বেশ ভালো দুধ দেয় গরুটি। ঘন করে জ্বাল দিয়ে কাঁসার মগে করে কামালের জন্য দুধের সর সহ এক মগ দুধ নিয়ে আসেন তিনি।

আমেনা খাতুনের বাবার মতো দেখতে হয়েছে বলে, বড় ছেলেকে তিনি সবসময় বাজান বলে ডাকেন।কাঁসার মগ ছেলের হাতে দিয়ে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- বাজান তোমাকে আজকাল এমন দেখায় কেন? কী হয়েছে তোমার?

কামাল হেসে বলে,কিছু হয়নিতো আম্মা।আপনি আমাকে নিয়ে শুধু শুধু সবসময় চিন্তা করেন। আমেনা খাতুন স্নেহ মাখা কন্ঠে বললেন-বাজান তুমি যদি যুদ্ধে যাও তবে আমাকে না বলে যেওনা। আমাকে বলে যেও। কামাল শুধু চুপ করে রইল।

কামালের তখন ভাটির সাহসী সন্তান এডভোকেট আব্দুল হামিদ এম পির সাথে পরিচয় হয়।তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। এলাকার ছেলেদের সংগঠিত করে দলে দলে যুদ্ধে পাঠাবার মহৎকর্ম হাতে নিয়েছেন। তিনি গুরু দয়াল সরকারি কলেজের ভি পি ছিলেন।

কর্মীবান্ধব আচরণের জন্য চারিদিকে উনার দক্ষ নেতৃত্বের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছিল। দুদিন পর রাতের বেলা হঠাৎ কামাল এসে বললো,আম্মা আমাকে এবার বিদায় দিন।আমি যুদ্ধে যাচ্ছি।
আমেনা খাতুন অকস্মাৎ আকাশ থেকে পড়েন।

বাজান তুমি কী বলছ এসব! হ্যাঁ আম্মা ঠিকই বলছি। সময় খুব কম।আপনি নিষেধ করলে লুকিয়ে যাবো, তাই আপনার দোয়া নিয়ে যেতে চাই। মালেক সাহেব নির্বাক হয়ে গেলেন। আমেনা খাতুন আর কামালের বোনরা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা কামালকে তার দলের সাথে যুদ্ধে চলে যাওয়া দেখছিল। এরপর সে যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে চলে যায়। সেখানে ভারতের সেনা কর্তৃক অস্ত্র চালনা এবং যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়। বর্ডার থেকে তাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

তারা একত্রিশ জন ছিল সেখানে। একদিন এম এ জি ওসমানী তাদের ক্যাম্প পরিদর্শন করলেন। তাদের এ খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার করা হলে তারা আরো উৎসাহিত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানিরা সেখানে হঠাৎ আক্রমণ করে বসলো।

এল এম জি, রকেট লঞ্চার প্রভৃতি যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে একত্রিশ জনের একটি বাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে।তুমুল যুদ্ধ হয় মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে। তারা এই যুদ্ধে জয় লাভ করে সেখানে গিয়ে দেখে বিশজন পাকিস্তানি সেনা তাদের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে মরে পড়ে আছে।

খুশিতে সকলে লাল সবুজ পতাকা টাঙিয়ে জয় বাংলা শ্লোগানে চারিদিক মুখরিত করে তোলে। মালেক সাহেব খুব শখ করে তিন তলার ফাউন্ডেশন দিয়ে বিশাল বাড়ি করেছেন।সেই বাড়ি আজ অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে তার পরিবারকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।।তার শ্বশুর বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়।

মালেক সাহেব মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কাজে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি একজন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী। তিনি বাড়িতে থাকতে পারেন না, উনার খালা শাশুড়ির বাড়ি চরপুমদী গ্রামে বিলের উপর মাচা করে কোন রকমে থাকেন।

পাক সেনাদের কালো তালিকায় উনার নাম ওঠেছে। উনাকে রাজাকার এবং পাকিস্তানি আর্মি খোঁজাখুঁজি করছে। ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের মধ্যে এক অনিশ্চিত সময় পার করছেন তিনি। একদিন তিনি জঙ্গলের ভীতর লুকিয়ে আছেন। ঠিক সেই সময় তার পায়ের উপর দিয়ে একটা সাপ চলে যায়।

তিনি অসম্ভব ভয় পেলেও একচুলও নড়েননি। মানুষ কত কঠিন বাস্তবতার ভিতর দিয়ে যে যাচ্ছে তা কল্পনাও করা যাচ্ছে না। যুদ্ধ তখন পুরোপুরি শুরু হয়ে গিয়েছে। স্কুল গুলোতে পাক আর্মিরা তাদের ঘাঁটি করেছে। রাতে ঘুমোতে গেলে থেকে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। মাঝে মাঝে আর্তচিৎকারের ধ্বনিতে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে গ্রামবাসী।

মাঝে মাঝে দূরের গ্রামে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায় সেই সাথে কান্নার মাতমে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। দম বন্ধ করা একটা পরিবেশ বিরাজ করছে চারিপাশে। পাকিস্তানি ও রাজাকাররা মানুষকে নির্দ্বিধায় ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলছে হরহামেশা। গণিতের মাল লুটপাট চলছে হরদম।

আমেনা খাতুনের বড় মেয়ে দুলনা তার শ্বশুর বাড়ি নানশ্রীতে আছে। বাবা-মা, ভাই-বোনদের কোন খবর পাচ্ছে না অনেক দিন হলো।এদিকে তুমুল ভাবে যুদ্ধ চলছে চারিদিকে। মনটা তার একদম ভালো নেই। চারিদিকের হত্যাযজ্ঞের খবরে মনটা তার অস্থির হয়ে আছে।

এই পরিস্থিতিতে সে বাবার বাড়ি যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না।অগত্যা একদিন তার স্বামীকে ডেকে বললো – বাড়ির সকলের একটু খবর নিয়ে এসো না গো। বারী সাহেব তাতে রাজি হয়ে রওনা হলেন। তার শ্বাশুড়ি অবস্থান করছেন উনার নানি শাশুড়ির বাড়িতে। পথে তার দাদী শাশুড়ির বাড়ি পড়ায় দাদী শাশুড়িকে দেখতে গেলেন।

নাত জামাইকে পেয়ে দুপুর বেলা দাদীজান না খাইয়ে ছাড়বে না।অগত্যা বারী সাহেব খেতে বসলেন।ঠিক এমন সময় খানিকটা দূরে বগাদিয়া এলাকার চুনি লাল রায়ের বাড়ির কাছাকাছি একটা হিন্দু বাড়িতে আক্রমণ করলো পাকসেনারা।

এই বাড়ির জগর রায় নামে একজন সবেমাত্র শাক দিয়ে দু লোকমা ভাত গিলেছে, সেই মুহূর্তে পাকসেনাদের একজন তার গলা বরাবর গুলি করে বসে। ফিনকি দিয়ে রক্তের সাথে ভাত আর শাক গলা থেকে ছিটকে আসে।এরপর বাড়িঘর তছনছ এবং লুটপাট শুরু করে।

আর্মিরা চলে গেছে। শুধু পড়ে আছে তাদের জঘন্যতার দৃশ্য।ভাতের থালার সামনে জগর রায়ের নিথর দেহ স্থির হয়ে আছে। চারিদিকে আতঙ্ক বিরাজমান। শুধু মাছিরা নির্ভয়ে জগর রায়ের মৃতদেহের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু উৎসুক জনতা ভয়ে ভয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে সেই দৃশ্য। বাড়ির লোকজন কাঁদতেও যেন ভয় পাচ্ছে।

এই খবর শুনে বারী সাহেব সেই বাড়িতে দেখতে গেলেন। নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছেন না যেন এই দৃশ্য।একটা মানুষকে খাবার খাওয়া অবস্থায় গলায় গুলি করেছে! এরা কী মানুষ? অকল্পনীয় নৃশংসতা চলছে চারিদিকে।

মালেক সাহেবকে রাজাকার লাল মিয়া এবং আর্মিরা খোঁজাখুঁজি করছে, তবুও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মাঝে মাঝে তিনি লুকিয়ে স্ত্রী সন্তানদের দেখে আসেন।উনার শ্বশুর বাড়ির খড়ের পুঞ্জির ভেতর তার মোটরসাইকেলটা রাখা আছে। এ ছাড়া কিছু করার নেই।

প্রায় চারমাস তারা সেখানে অবস্থান করার পর অবস্থা খারাপ দেখে সেখান থেকে আমেনা খাতুন সন্তানদের নিয়ে আরেকটু দূরে তার নানার বাড়িতে চলে যায়।কারণ তার মামা সফিরুদ্দীন একজন গোঁড়া মুসলিম।তিনি পি ডি বির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি মোসলেউদ্দীনের-

একনিষ্ঠ ছাত্র বলে রাজাকার বা পাকিস্তানিরা এই বাড়িতে কিছু করতে আসতো না।তবে সফিরুদ্দীন একজন ভালো মানুষ। তার দ্বারা কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি এই গ্রামে, বরং আমেনা খাতুন অত্যন্ত ধার্মিক হওয়া সত্বেও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে নিজ এলাকা নগুয়ার বেশকিছু-

হিন্দু মহিলাদের এই বাড়িতে এনে প্রায় আড়াই মাস যাবৎ তার সাথে নিরাপদে রাখছেন। নাজরিণকে আমেনা খাতুন বেশি বের হতে দেননা।তবে শামীম অনেক ছোট বলে এদিক সেদিকে খেলতে চলে যায়।একদিন শামীম সামনের মাঠে খেলতে গিয়েছে বাড়ির বাচ্চাদের সঙ্গে।

তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শফি চেয়ারম্যানকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে। লাশটা একটা কাঠের তক্তাতে বেঁধে পাঠিয়ে দেয় গ্রামে। সকল বাচ্চার সাথে ছোট্ট শামীম গিয়ে দেখে শফি চেয়ারম্যানের বুকে বুলেটের আঘাতে বেশ বড় একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে।

সে খুব ভয় পেয়ে যায়। তার ছোট্ট মনে বিষয়টি গভীর ভাবে রেখাপাত করে। এরপর যুদ্ধের ভয়াবহতা বাড়তে থাকার ফলে আমেনা খাতুন আরো দূরে চরপুমদী গ্রামে তার খালার বাড়ি সন্তানদের নিয়ে চলে যায়। দিনে সকলে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রাত হলে ভয়াবহ আতঙ্ক গ্রাস করে সকলকে।

থেকে থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। হারিকেনের আলো নিভিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে সকলে। আমেনা খাতুন তার প্রাণের টুকরো বড় ছেলে কামালকে দেখে না আজ কতটা মাস হলো। একজন মুক্তিযুদ্ধার মায়ের হৃদয় সারা বাংলার দগ্ধ গ্রামের মতো জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে থাকে অহর্নিশ।

তিনি যখন ভাবেন তার ছেলে বালিশ বিহীন ঘুমোচ্ছে তখন তিনি ঘুমোতে গেলে মাথা থেকে বালিশ সরিয়ে নেন। তিনি যখন ভাবেন তার ছেলে যুদ্ধক্ষেত্রে শীতের রাতে কষ্ট পাচ্ছে তখন তিনি মাঘ মাসের শীতের রাতে গরম কাপড় ছাড়া উঠোনে দাঁড়িয়ে কাঁদেন।যখন মনে হয় ছেলে বুঝি রোদে পুড়ে-

যুদ্ধ করছে তখন তিনি প্রচন্ড রোদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছেন। ভাবেন তার ছেলে বুঝি ক্ষুধার্ত হয়ে যুদ্ধ করছে, তখন তিনি কোন খাবার না খেয়ে শুধু পান খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দেন। কখনো ভয়াবহ আতঙ্ক মনকে ঘিরে ধরে – ছেলেটা কী বেঁচে আছে?

ভালোবাসায় পূর্ণ কতো মাতৃহৃদয় সুধু প্রিয় বাংলাদেশকে ভালোবেসে একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড এবং লাল-সবুজ পতাকার আশায় অসীম মনো যাতনা সয়ে সয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন।

ঘরবাড়ি ছেড়ে এই অবস্থায় আর কতদিন থাকা যায়। তাই আমেনা খাতুন আজ আবার সন্তানদের নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে আসলো। ঘর বাড়ির এ কী অবস্থা হয়ে আছে। বাড়ি ফিরেও স্বস্তি পাওয়া গেল না।বাদশাহ মিয়া ডাক্তারের ছত্রছায়ায় থাকা রাজাকাররা আমেনা খাতুনের বাড়ির বসার ঘরটা দখলে নিয়ে তাদের বৈঠক খানা করে নিল।

আমেনা খাতুনের বড় মেয়ের জামাই মাঝে মাঝে রাজাকারদের উপর চটে যায়। তখন তিনি বড় জামাইকে বোঝান- দেখ বাবা সময় এখন ভালো নয়।এদের কিছু বলতে যেও না। হিতে বিপরীত হতে পারে।

বাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এমনকি মালেক সাহেবের ছেলেদের জন্য যে দ্বিতীয় মোটরসাইকেলটি কিনেছিল তা এই বাড়িতে তালাবন্ধ ছিল, এগুলোর কোন ক্ষতি করেনি তারা।
একদিন আমেনা খাতুনের বাড়ির কোনে কল তলায় একটা ঢিল পড়লো।

আমেনা খাতুনের মাতৃহৃদয় ভাবলো তার ছেলে হয়তো দেখা করতে এসে ঢিল ছুঁড়ে ইঙ্গিত দিয়েছে। তিনি বের হতেই কিছু রাজার সদলবলে বেড়িয়ে আসলো। আমেনা খাতুন আতঙ্ক নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে তার মাকে ঘটনাটা জানালেন।

এরমধ্যে পাকিস্তানি আর্মি সেখানে চলে এসে পেছনের জঙ্গল মতো যে জায়গা ছিল তা সার্চ করতে শুরু করলো। কিন্তু ভাগ্য ভালো কাউকে সেখানে সেদিন পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে হোসেপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের গাংগাটিয়ার জমিদার বাবুকে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলেছে।

(বর্তমানে মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী, যার ডাকনাম – মানব বাবু।উনার পিতা সেই জমিদার ছিলেন।) তাদের প্রাসাদ থেকে যা পারে লুটকরেছে রাজাকাররা। ভয়ে দেশ ছেড়ে লাখ লাখ বাঙালি ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।

গ্রামের নদী-নালাতে প্রায়শই কচুরিপানার সাথে ভেসে আসছে বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ও বুলেট বিদ্ধ নারী পুরুষের মৃতদেহ।লাশের বিকট দুর্গন্ধে ভারী হয়ে থাকে বাতাস। সামান্য স্বার্থসিদ্ধির জন্য গ্রামের অনেক মেয়েকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে রাজাকাররা। সুযোগে কি দাপট চালাচ্ছে তারা।

এর মধ্যে মালেক সাহেব খবর পেলেন শাহেদ ভাই ও তার সহধর্মিণী ঢাকা থেকে চলে এসেছেন। তাদের মেয়ে দুটি কলকাতায় দ্বীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় নামক একজনের বাড়িতে- “বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা” তে যোগ দিয়েছে। তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করেছে যা প্রতিনিয়ত রেডিওতে বেজে যাচ্ছে।

এছাড়া প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থী শিবিরে মুক্তির গান গেয়ে তাদের উদ্দীপনা যোগাচ্ছে।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পাঠ হচ্ছে এম আর আক্তার মুকুলের চরমপত্র। দেশের মানুষ সহ মুক্তিযোদ্ধারা এতে দারুণ উদ্দীপ্ত হচ্ছে।

মেজর তাহেরের তত্বাবধানে এগারো নম্বর সেক্টরে কামাল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে।ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল এলাকা তখন এগারো নম্বর সেক্টরের আওতায়। এরপর কামাল সহ তাদের বাহিনী কিশোরগঞ্জ প্রবেশ করে প্রথমে ইটনা এরপর নানশ্রী এলাকয় ঢুকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে।

তাছাড়া বাইলার বাড়ি সহ আরো অনেক গুলো এলাকা শত্রু মুক্ত করেছে। কখনো আধপেটা খেয়ে, বা না খেয়ে মুক্তির গান গেয়ে অভুক্ত উদরের জ্বালা মিটিয়ে সাহসিকতার সাথে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন। কাদাজলে ক্রলিং করে জোঁকের কামড় সয়ে, সাপ অথবা জন্তুজানোয়ারের ভয় উপেক্ষা করে যুদ্ধ করতে হয়েছে।

এ ছাড়াও পাছে পাকসেনাদের সাথে প্রতিনিয়ত জীবন-মরণ যুদ্ধতো ছিলই। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, এ বড় কঠিন খেলা। জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি বসত। এরমধ্যে কামাল কত পরিচিত মুক্তিযোদ্ধারকে শহীদ হতে দেখেছে চোখের সামনে। এরমধ্যে তার নিজ শহরের খায়রুল যখন শহীদ হলো তখন মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

মুক্তিবাহিনীর সাথে কামাল নানশ্রী গেছে শুনে কামালের বোনরা কেঁদেকেটে সেখানে ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেল,কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো গিয়ে দেখে সেখান থেকে তারা অন্যত্র চলে গেছে। তবে নানশ্রী স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে আরো কিছু মুক্তিযোদ্ধা।

শামীম তার বড় বোন দুলনাকে বলে- আপা মুক্তিযোদ্ধা দেখতে কেমন? আমি মুক্তিযোদ্ধা দেখতে চাই। দুলনা ছোট বোনের কথায় হেসে বলে- মুক্তিযোদ্ধা আবার কেমন হবেরে? তারাতো কামালের মতোই মানুষ। এরপর স্কুল ঘর থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে এনে ছোট্ট শামীমের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ে কৌতুহল মিটায়।

একদিন কামালদের মুক্তিবাহিনীকে এক রাজাকারের বাড়িতে নিয়ে খুব আদর যত্ন করে খাইয়ে রাতে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। তারা তখনও জানতোনা যে রাজাকারের বাড়িতে তারা উঠেছে। রাতে তাদেরই বাড়ির লজিং ছেলেটি কামাল সহ সকল আশ্রিত মুক্তিযোদ্ধাদের সব বলে দেয়।

তখন সেই ছেলেটির সহযোগিতায় তারা সেখান থেকে পালাতে সমর্থ হয়। বাড়ির মালিক সেই সময় আর্মি ক্যাম্পে খবর দিতে গিয়েছিল। রাতেই হয়তো তাদের শেষ করে দিত। এরপর সেই লজিং থাকা ছেলেটির শেষ পরিণতি কী হয়েছিল তা আর কামালের জানা হলো না।

একদিন সদলবলে সীমান্তের কোন এক পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধ করতে গিয়েছে কামালরা।তখন বে খেয়ালে পাহাড়ের নিচে তারা ঘুরাঘুরি করছিল। এমন সময় একজন আদিবাসী এসে তাদের সতর্ক করে যে, আর্মির গাড়ি এদিকে আসছে। কামালরা সাবধানে সরে যাওয়ার সাথে সাথে গাড়ি দুটি তাদের ক্রস করে। অল্পের জন্য সেদিনও তারা বেঁচে যায়।

যাই হোক, দেশের অনেক এলাকা এখন শত্রু মুক্ত। কামাল এখন শুধু স্বপ্ন দেখে বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে একদিন বিজয়ীর বেশে গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াবে সে।
এরমধ্যে বাংলার বিজয় যখন আশু, তখন পাকিস্তানি কাপুরুষ নরপশুদের সাথে আমাদের দেশের কিছু ম্লেচ্ছ

হাত মিলিয়ে, ১৪’ডিসেম্বর রাতে দেশকে মেধা শূন্য করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে মিথ্যের আশ্রয়ে ঘর থেকে আমাদের সূর্য সন্তানদের ডেকে নিয়ে নির্মম ভাবে বধ করে। বদ্ধভূমিকে কলঙ্কিত করে লাশের স্তুপে পরিনত করে।

আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,১৬’ডিসেম্বর ১৯৭১।তাম্রাক্ষের অবসান ঘটিয়ে বিজয়ের উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে লাল-সবুজের পতাকা হাতে সারা বাংলা ভেসে গেল। রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের লে.জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ভারতীয় বাহিনী ও –

মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ড জগজিত সিং অরোরার নিকট আজ আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করলো। দুর্ভাগ্য জনক বিষয় হলো কিশোরগঞ্জ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় ১৯৭১ সনের ১৭ ডিসেম্বর। কামালের ছোট ভাই জামালের টাইফয়েড ধরা পরেছে।

তার নানু দা হাতে ধানের গোলার পাশ থেকে ডাব নিয়ে নাতির জন্য তা কাটতে গেল। ওমনি ঝপাং করে গোলার ভেতর থেকে সেই চুনোপুঁটি রাজাকার দুজন বেরিয়ে এসে কামালের নানুর দুই পায়ে ধরে কেঁদেকেটে বলতে লাগলো – আপনি আমাদের ধর্মের মা হোন।

আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দিন। বৃদ্ধা চমকে ওঠলেন। মনে মনে ভাবলেন – দুদিন আগে যাদের এত দাপট ছিল এখন তাদের এ কী অবস্থা! যুদ্ধ শেষ -তবে কিছু কিছু মানুষের জীবনে যুদ্ধের বিভীষিকা ভয়ানক রেখাপাত করে গভীর ক্ষতের দগদগে ঘা রেখে গেছে।

দীনা আর সোমা তাদের শব্দ সৈনিক দের সাথে একটি ক্যাম্পে এসেছে। এখানে ধর্ষিতা নারীদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। এদের নির্যাতনের বিভৎসতা দেখে ও শুনে তাদের গা শিউরে উঠল।৮/১০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত পাকিস্তানি আর্মি নাকি একরাতে এক একটা গণধর্ষণে অংশ নিত।

পাকিস্তান সরকারের কড়া নির্দেশ ছিল তখন ধর্ষণের পক্ষে। মাথা ন্যাড়া করে গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত রাখতো না। ধর্মের নামে এ ছিল তাদের পাশবিক নির্যাতন।বিকৃত রুচির জেনারেলদের পরিকল্পনায় যুদ্ধকালে সংঘটিত হয় ধর্ষণের মহোৎসব। মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত ধর্ষণের সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ।

কামালের মায়ের হাত থেকে বার বার দুধের বাটি পড়ে যাচ্ছে। তার কনিষ্ঠ ছেলের বয়স একমাস। আনন্দে আত্মহারা তিনি। কারণ তার বড় ছেলে যুদ্ধ জয় করে আজ বাড়ি ফিরেছে। কামালকে দেখতে তাদের বাড়িতে ঢল নামল পাড়ার লোকের। কামাল তার একমাসের ছোট্ট ভাইটিকে কোলে নিয়ে উঁচু করে ধরে বললো- এর নাম আজ থেকে বিপ্লব।

তার চেতনায় দেশ মাতা নয় মাসের যন্ত্রণাময় বিপ্লব শেষে একটি সন্তান তুল্য স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্ম দিয়েছে। আনোয়ার কামাল যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে প্রধান শিক্ষক জনাব আমিরুদ্দীন আহমদের বাসায় স্টেনগান কাঁধে নিয়ে যায়। প্রতিবাদী কার্যকলাপের জন্য সেদিন এই প্রধান শিক্ষক তাকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

এবার ভুত দেখার মতো ওঠে দাঁড়ালো প্রধান শিক্ষক। কামালকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। এর পর তার পিতার কাছে এসে সেই প্রধান শিক্ষক নিজের ভুল স্বীকার করে কামালকে সেই স্কুল থেকে এস এস সি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেন।

পনের আগষ্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুকে স্ব পরিবারে হত্যার পর আনোয়ার কামাল কিশোরগঞ্জ শহরে তার নিজ বাসভবনের সামনে থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকজন নিয়ে শহরের দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল বের করে। পরবর্তীতে তাকে রাজবন্দী করা হয়।

প্রায় এক বছর ময়মনসিংহ জেলে Detention এ তাকে রাখা হয়। জেলখানায় আটক থাকাকালীন কামালের সাথে পরিচয় হয় যার সাথে, তিনি অধ্যাপক যতীন সরকার নামেই সমধিক পরিচিত,তিনি বাংলাদেশের একজন প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ ও লেখক।

ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন।কামাল উনার সান্নিধ্যে এসে জেলখানার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে রাজনৈতিক জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিধ্বস্ত এবং লুটের রাজ্যে পরিনত হওয়া বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী-

অকুতোভয় আত্মজার দক্ষ হাতে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আজ দেদীপ্যমান। আনোয়ার কামাল স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর সেতুবন্ধনের একজন সাক্ষী হিসেবে আজ দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণের মাঝে মিশে থাকা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মধ্য বয়স পেরিয়ে এসে

এই আনন্দঘন মুহূর্তে আতসবাজি আর ফানুশে ছেয়ে যাওয়া আকাশের পানে তাকিয়ে স্বাধীন বাংলার বিশুদ্ধ মুক্ত বাতাস তার বক্ষপিঞ্জরে টেনে নিল। কিশোরগঞ্জ বাসীর মাঝে বেঁচে থাকা সেই দুঃসাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি আজ একজন জ্বলজ্যান্ত কিংবদন্তি।

Advertisement
উৎসMahfuza Polok
পূর্ববর্তী নিবন্ধকবি মাহফুজা আরা পলক‘এর ছ‘টি কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের গুরুদাসপুরে ডোবায় পড়ে শিশুর মৃত্যু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে