পাঁচু কাকা ও আশ্বিন বাউল

0
646
mahabub

দেবাশীষ সরকার : সকাল বেলা চোখ মুছিতে মুছিতে পাঁচু কাকা বিছানা হইতে উঠিবে, কিন্তু প্রতিদিনের ন্যায় আজ ঘুঘুর ডাক শুনিতে পাইতেছে না কেন? প্রাকৃতিক এলার্ম ঘড়ির মতোই নারিকেল গাছের ডালে ঘুঘুটি না ডাকিলে সকালে বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে ভালো লাগে না পাঁচু কাকার। তাহা হইলে কি আজ বেশি সকালে ঘুম ভাঙিয়াছে? আরো কিছুক্ষণ বিছানায় গড়া গড়ি পাড়িয়া ভাঙা জানালা দিয়া নারিকেল গাছটির দিকে চক্ষু মেলিল পাঁচু কাকা।

দেখিলো ঘুঘুটি তাহার প্রেমিকের সহিত খুনসুটি করিতেছে। আজ আর ডাকাডাকি নাই। অবশেষে ঘুঘু দুটিকে দেখিতে পাইয়া প্রফুল্ল চিত্তে বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে যাইবে এমন সময়- শুনিতে পাইলো কে যেন – “আমার সোনার ময়না পাখি কোন দেশেতে উইড়া গেলিরে পাখি দিয়া মোরে ফাঁকি ” গানটি গাহিত গাহিতে পথ দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছে। উদাস করা কন্ঠের গানটির সাথে বিরহের এক আবেগী ক্রন্দন চারিপাশে ছড়াইয়া পড়িতেছে।

গানটি শুনিয়া বাউল কাজলের কথা মনে পড়িল আহারে বেচারা! বিনা চিকিৎসায় শেষে মারাই গেলো কিন্তু দুস্থ শিল্পীর ভাতা আর তার কপালে জুটিলো না। আর তো কখনো কাজল গান গাইবে না, তার দোতরায় সুর বাজিবে না। অসহায় পরিবারটি আজ কেমন আছে! কেউ কি তার খোঁজ লইয়াছে! কে জানে! শিল্পের জন্য সংস্কৃতির জন্য যারা নিবেদিত হইয়া সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিলো তাহাদের কি এমন করিয়াই মরিতে হইবে!?

আর মতলববাজ ভুমি খেকো শয়তান বড়লোক শিল্পী নামধারীরা দুস্থ শিল্পীর জন্য বরাদ্দ টাকা আত্মসাৎ করিবে? এমন কথা ভাবিতে ভাবিতে আবাগী গানটি শ্রবন শেষ করিয়া পাঁচু কাকার মনে পড়িল লালবাজারের সাধু গান শুনিবার আমন্ত্রন করিয়াছে। হালকা চা- মুড়ি খাইয়া একখান বিড়িতে সুখ টান মারিয়া সেখানে যাইবার জন্য পা বাড়াইলো। রাস্তায় বাহির হইয়াই দেখিতে পাইলো কয়েকজন কলেজ ছাত্র জটলা করিয়া সবার হাতে হাতে মোবাইল নামক আজব বাক্সটার দিকে তাকাইয়া ঘাড় নিচু করিয়া আলোচনা করিতেছে।

বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সমর্থন করিয়া বাপ নাকি তার পুত্ররে কোপাইয়াছে। আহারে কি দিন আইলো! খেলার জন্য বাপ ছেলেরে কোপাইতেছে!? সবাই বলাবলি করিতেছে বিভিন্ন দলের সমর্থকদের মধ্যে এরই মধ্যে কথা বলাবলি বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে, চলিতেছে রেশারেশি। আশংকা আর উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করিতেছে, কেহ কেহ বলিতেছে যে কান ধরনের অনাকাংঙ্কিত পরিস্তিতি এড়াইবার জন্য প্রশাসনকে সজাগ থাকিতে হইবে।

তবে এইরূপ পরিস্থিতির জন্য কাহাকে দোষারোপ করিবে বুঝিতে না পারিয়া, সবকিছু শোনিয়াও না শুনিবার ভান করিয়া আশ্বিন বাউলের গান শুনিবার জন্য পা বাড়াইলো। পাঁচু কাকা দুলালের দোকানের বেঞ্চিতে বসিবা মাত্রই প্রতিদিনের ন্যায় ফ্রিতে পাওয়া গরম গরম আরো এককাপ চায়ে চুমুক দিলেন। রাস্তায় পড়িয়া থাকা খুড়কুটা কুড়াইতেছে কয়েক জোড়া চড়ুই পাখি, উড়িয়া পাশের টিনের চালার টুইয়ে আর দালানের ভেন্টিলেটরে বাসা বানাইতেছে।

দেখিয়া খুব ভালো লাগিলো পাঁচু কাকার কিন্তু সাথে সসাথে অনেক আগে পড়া সেই কবিতার কথা মনে হইলো, বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়ুই কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই?? আহারে!!! চড়ুই তবু দু একটা দেখিতে পাওয়া যাইতেছে কিন্তু প্রকৃত শিল্পী সেই বাবুই পাখি আজ আর নাটোরে চোখেই পড়ে না। সুন্দর সুন্দর ঝুলন্ত বাসা কিচিরমিচির ডাক কোথায় হারাইয়া গেলো কে জানে! নাটোরে এইতো কিছুদিন আগেও অনেক পাখি হারাইয়া গিয়াছিলো।

এখনো যে প্রচুর পাখি আছে তাহা নহে তবু প্রসাসনের টনক নড়িবার ফলে বেশ কিছুদিন হইতে পাখি শিকারীদের সাজা দিয়া পাখি শিকার কিছুটা রোধ হইয়াছে। গ্রামে গ্রামে সচেতন যুব সমাজের উদ্যোগে পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য তৈরী হইয়াছে, তাহা দেখিয়া প্রশাসনের উদ্যোগেও তৈরী হইতেছে অভয়ারণ্য। এসব কথা শুনিলে ও দেখিলে ভালোই লাগে পাঁচু কাকার। এরই মধ্যে আশ্বিন বাউল ধুপ ধরাইয়া দোকান ঘর খুলিতেছে দেখিয়া টুক টুক করিয়া দু কদম হাঁটিয়া হাতটি বাড়াইয়া দিলো।

একটি দামী বিড়ি পাইয়া চোখ চকচক করিয়া উঠিলো পাঁচু কাকার।বিড়িটি ধরাইয়া শুখটান দিয়াই চোক বন্ধ করিলো পাঁচু কাকা পাছে স্বাদ গ্রহনের বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটে। আশ্বিন বাউল বলিতে আরম্ভ করিলো- দেকো কাকা এবারের বাজেটে নাকি বিড়ির দাম আরো বাড়বি তকন বিড়ি খাওয়াই নাকি দায় হবি। তা হোকগ্যা ওসব কোতা শুনার জন্যিতো এটি আসিনিরে বাউল, চারদিকের সব কোতা শুন্যা মুনডা ভালো না কয়ডা গান শুন্যা মুনডা এট্টু ভালো কোরতে চানু তুই আর মুনডা খারাপ করিস ন্যা।

কি কবো কাকা! না কলি যে থ্যাকতে পারি ন্যা কাকা, ঠোট যে নিসপিন নিসপিস করে। তা কাল রাতে কি দিয়ে ভাত খাছিলে। কি খাবো ক তোর কাকী ওই দীঘির ধার থ্যাকে কয়ডা কচুর ডাটা কাটিছিলো আর ডুম্বোর ভাজিছিলো তাই দিয়্যই খাতি অম্মিতের মতো লাগলো আহ। ওই দেকো কাথায় কথা উঠে আগের মতো আর ডুম্বর গাছ দেখতে পাও কওতো, আগে যেটি সেটি ডুম্বর গাছ আছিলো, যেটি সেটি কচু হয়ে থাকতো এখন কত খুঁজতে হয় কও! বলে আশ্বিন বাউল।

হ তোর কাকিও খালি খেপে যায় বলে শাকপাতারি আর পাওয়া যায় না কচুও নাকি বাজারে বিক্রি হয়। কতো গাছ হারায় গেলো! সেই যে বছর আষাঢ় মাসে তোর কাকিক বিয়ে করে ঘরে লিয়ানু, বাড়ির পাশে দিঘির ধারে সকালে যখন তোর কাকী দিঘির জলে ভেসে থাকা হিজল ফুল দুই হাতে সড়ায়ে ডুব দিতো, কি যে ভালো লাগতো! ইস্!! সেই হিজল গাছ আর চোখেই পড়ে না। আশ্বিন বাউল আবার বলিল- সড়া গাছ, খয়ের গাছ, কড়ই গাছ, বাবলা গাছ, গাব গাছ, বান্দর লাঠি ( সোনালু) গাছ, কাঠ করবি, দেশি নিম, বড় বড় পুরাতন বিভিন্ন জাতের আম গাছ, অর্জুন গাছ, কতো কতো দেশি প্রজাতির গাছ হারায় যাচ্ছে।

তবে কি জানো কাকা, সারা দেশে বজ্রপাতে বহু মানুষ নাকি মারা যাচ্ছে গাছ না থাকার জন্য। এজন্য নাটোরে তো হাজার হাজার তাল গাছের বিচি লাগানো হলো সে সব বিচি থেকে গাছ কি হসে? জিজ্ঞেস করিল পাঁচু কাকা? সরকার খুব জোর দিছে গাছ লাগানোর জন্য, কিন্তু যেসব গাছ লাগাচ্ছে তা ঠিকমতো পরিচর্যা হচ্চে না। ঠিকমতো পরিচর্যা করা দরকার কাকা, বলিল আশ্বিন বাউল।এদিকে পাঁচু কাকাকে দেখিয়া সুরুজ বাবু আগাইয়া আসিয়া বলিল- ক্যারে পাঁচু কাল তোকে দেকনু জঙলী শশ্বানে নারদ নদের ধারে বসে আছু, তো ওটি কি করুচ্চুলু।

পাঁচু কাকা বলিল – নারোদ আর কি নদী আচে! সে তো কতোকাল হয় জোলা হসে, তা যেটুকু আছে এখুন তাও ড্রেনের মতো, যে ভাবে দুই পাড় দখল হোচ্চে তাতে কয়দিন পর ওইটুকুও থ্যাকপি ন্যা। কোটি কোটি টাকা দিয়ে খনন করলো সব ভাওতা, বিভিন্ন কোম্পানির গাদে জলই তো নাই, আর মাছ থাকপি কি কোরা!? হবে বলে আবার খনন!? ওই আবার হয়তো টেকা লুটপাট কোরর জোন্যি, কি জানি বাপু ওসব লিয়্যা আমারে আর ভাবনা কি?

এমন সময় ভটভট করিয়া দুই চাকার যন্ত্ররথ লইয়া একজন তুখোর উদিয়মান কলমসৈনিক আসিয়া উপস্থিত হইলো। পাঁচু কাকাকে দেখিয়াই লইলেন একচোট- “খুব মুখ খুলিছো না?, দেখো নিজের ধুতি ঠিক রাখো কিন্তু, যাকা তাক লারো না, যা খুশি তাই বলো না, সুখে থাকতে ভুতে কিলায় না?, তোমার ভাতা কিন্তু বন্ধ করে দেবো বলে দিলাম।” এসব শুনিয়া মিটমিট করিয়া হাসে পাঁচু কাকা। দামী বাড়িতে লম্বা টান দিয়ে বলিল – ও আশ্বিন একখান গান ধরো দেকি — গান ধরে আশ্বিন বাউল –
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনবেড়ি
দিতাম পাখির পায়।
আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।
কপালের ফ্যার নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার।
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে।
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।
গান শুনিতে শুনিতে ঝিমাইতে থাকে পাঁচু কাকা, হারাইয়া যায় এক অন্য জগতে……

Advertisement
উৎসDebashish Sarker
পূর্ববর্তী নিবন্ধমায়ার সংসার -কবি শাহিনা খাতুন‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে