প্যারেন্টাল গাইডেন্স (গল্প)- তন্ময় ইমরান

0
284

প্যারেন্টাল গাইডেন্স (গল্প)- তন্ময় ইমরান

মেয়েটাকে ঠিকঠাক মানবিকভাবে বড় করে তুলতে কি পরিশ্রমই না করেছি আমি ও আমার স্ত্রী নোভা।

এই যেমন- ছোটবেলা থেকে তাকে রাস্তার কুকুর ও বেড়াল ভালোবাসতে শিখিয়েছি, ভালোবাসতে শিখিয়েছি পাখিদের। গাছের অনুভূতি আছে, কাজেই তার যত্ন নেয়া শিখিয়েছি। প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ মাংস সে এক বছর বয়স না খাওয়ার অভ্যাস করেছে।

চার বছর বয়সে একবার সে বেঁকে বসলো গাছের যেহেতু প্রাণ আছে, তাই শাক সবজি খাবে না বলে। পরে বেশ কিছু যুক্তি দেখিয়ে, রীতিমত ঘাম ঝরিয়ে মেয়েটাকে সেই পণ থেকে সরিয়ে আনা গেল।

আমার মেয়ের নাম মোচো। ছয় বছরে পড়তে যাচ্ছে সে। এবছর আমি ও আমার স্ত্রী প্ল্যান করেছিলাম- জীবনের আরেকটি শিক্ষা তাকে দিব। তার জন্মদিনটা একটা এতিমখানায় পালন করবো। বঞ্চিত শিশুদের সাথে একটা দিন কাটাবো। সবাইকে খাওয়াবো। সবাইকে নতুন জামা কিনে দিব। খেলাধুলা, পুরস্কার ইত্যাদি ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখবো।

বড় কেইক কেটে এতিমখানায় জন্মদিন শুরু করেছিলাম। মেয়েটা সারাদিন তার রানির মতো ফ্রক পড়ে এতিম খানার বাকি শিশুদের সাথে হৈ হট্টগোল করেছে। শিশুরাও ছিল ঝলমলে।

নতুন খেলনা, পুরস্কার নিয়ে মেতে ছিল সবাই। এতিমদের সবাইকে এক রকম পোশাক কিনে দিয়েছিলাম। খরচে কার্পণ্য করিনি।

দিনশেষে রাতে ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছি। পেছনের সিটে মোচো তার মায়ের সাথে। রিয়ার ভিউ মিররে দেখলাম মোচোর মায়ের প্রশান্ত মুখ। আমার নিজের মধ্যেও তৃপ্তি। মোচোকে স্রেফ আমরা মানুষ বানাতে চাই। আজ একটা শিক্ষা তো অন্তত দিলাম! আমি ও আমার স্ত্রী দুইজনেই জানি, মোচো খুব দ্রুত মানবিক শিক্ষাগুলো আত্মস্থ করতে পারে।

কিন্তু তখনই হঠাৎ মোচোর উদাস মুখ দেখলাম৷ কেন যেন মনে হচ্ছিল তার যতোটা আনন্দিত হওয়ার কথা ততোটা সে নয়। তারপর আমার মনে পড়লো বিকাল শুরু হওয়ার আগ থেকে এতিমখানাতেই সে কিছুটা মনমরা হয়ে গিয়েছিল। তাহলে কি মোচো মনে মনে ভাবছে- আজকের মতো দিন প্রতিদিন হয় না কেন? প্রতিদিন এমন আনন্দ হলে তো ভালোই…

জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম- মোচো তোমার মন খারাপ কেন?

মোচো প্রথমে বললো- কিছু না বাবা।

আমি রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে আড়চোখে তাকালাম। সে বাইরে তাকিয়ে আছে। ভাবলাম-ঘাঁটাবো না। এবং সে উত্তরও দিবে না।

কিন্তু জানালা দিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতেই মোচো বললো- আচ্ছা বাবা ওখানে যারা আছে তাদের তো জন্মদিন পালন করা হয় না, তাই না!

আমি সিগ্নাল পড়ে যাওয়ায় একটা ব্রেক কষলাম। সেটি একটু হার্ড হলো।

মোচো আমাকে বললো- বাবা আমাকে না ওদের একজন মন খারাপ করে বলেছে, বাবা-মা থাকলে ওর জন্মদিনেও এমন মজা করতো। সবাইকে নিয়ে খেত!

মোচোর মায়ের ঝলমলে মুখেও একটা অদ্ভুত ছায়া পড়লো।

মোচোর শেষ বাক্যটা ছিল- আচ্ছা বাবা এমন কোনো দেশ আছে যেখানে সবার জন্মদিন পালন করা যায়!

আমি উত্তর দিলাম- বাড়ি গিয়ে বলবো মা। এখন তো গাড়ি চালাচ্ছি। অনেক কথা বলতে হবে।

সিগ্নাল ছাড়লো। আমার মুখে মুচকি হাসি ফুটলো হঠাৎই। আমি আর আমার স্ত্রী ওকে যা শেখাতে চাই, তার চেয়ে অনেক গভীরে গিয়ে মোচো ভাবছে।

ড্রাইভ করার সময় চোখে পানি এলে তো সমস্যা!

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরে বিএনপির নেতা বাচ্চুর নাতনীর রহস্যজনক মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধএপিটাফ – লিপি চৌধুরী এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে