প্রেম আসে প্রকৃতির গোপন গভীর থেকে – স্বকৃত নোমান 

0
313

প্রেম আসে প্রকৃতির গোপন গভীর থেকে – স্বকৃত নোমান

প্রস্তাব দিয়ে কি প্রেম হয়? না, প্রস্তাবের তোয়াক্কা করে না প্রেম। প্রেম হয়। হয়ে ওঠে। যেমন হয়ে ওঠে লেখা। কখনো সারাদিন টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে বসে থাকলেও একটি শব্দ লেখা হয়ে ওঠে না। আবার কখনো এমন ঝড়ের বেগে লেখা আসতে থাকে, সেই বেগের কাছে হার মানে কলম। প্রেমও তেমনি। প্রেম আসে প্রকৃতির গোপন গভীর থেকে। কবি একেই বলেছেন স্বর্গ : ‘স্বর্গ হতে আসে প্রেম স্বর্গে চলে যায়।’ স্বর্গ তো ইউটোপিয়া। মানবীয় কল্পনার সর্বোচ্চ শিখর। প্রকৃতির গোপন গভীর থেকে আসা প্রেম পতনশীল উল্কার মতো আসে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মতো, ছুটন্ত মৃগের মতো, ধাবমান অশ্বের মতো আসে।

মজনু লাইলীকে কখনো বলেনি আমি তোমাকে ভালোবাসি। একবারও না। মজনু লাইলীর বাড়ির কুকুরটিকেও ভালোবাসত। কুকুরটি যে পথ দিয়ে হেঁটে যেতে, সেই পথের ধুলা হাতে নিয়ে সে চুমু খেত। শিরিও কখনো ফরহাদকে ভালোবাসার কথা বলেনি। থিসবিকে পিরামুসও না। রামগিরি পর্বতের বিজন আশ্রমে নির্বাসিত যক্ষ যে অলকাপুরীর রম্যপ্রাসাদে বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশে বার্তা প্রেরণ করে, তা কিন্তু প্রেম হওয়ার পর, আগে নয়। নির্বাসনের আগেই প্রেম হয়ে গিয়েছিল। ‘আই লাভ ইউ’ বা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’―এটা প্রেমের আনুষ্ঠানিকতা। যখন প্রেম হয় তখন মুখের ভাষা কাজ করে না, কাজ করে ঈশারা ভাষা। তখন চোখ কথা বলে, দৃষ্টি কথা বলে; অলক, নাক, নাকের ওপর ঘামের বিন্দু, ঠোঁট, চিবুক এমনকি কালো তিলটিও কথা বলে। বাংলা গানে তার কী চমৎকার উদাহরণ―
‘এই জ্বালা যে এমন জ্বালা
যায় না মুখে বলা
বুঝতে গেলে সোনার অঙ্গ
পুড়ে হবে কালা।’

ইশারা ভাষায় কথা বলা সাঙ্গ হওয়ার পরেই আসে মুখের ভাষা। কেবল তখনই বলা যায় ‘আই লাভ ইউ’। তার আগে বললে তা ‘টিজিং’ হয়ে উঠতে পারে। টিজিং হয়ে ওঠার সম্ভাবনাই প্রবল। প্রিয় সঞ্জীবন সুদীপ, আপনি যতই দ্বিমত করুন, একজন পুরুষ একজন নারীকে উত্যক্ত করার অধিকার রাখে না। একজন নারী একজন পুরুষকেও না।

প্রেম কি যে কোনো নারীর সঙ্গেই হয়? কিংবা যে কোনো পুরুষের সঙ্গে? মোটেই না। একটি মেয়ের সঙ্গে আপনার প্রতিদিন কথা হয়, আড্ডা হয়, কিন্তু তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নেই। কিন্তু অপর একটি মেয়ে, যাকে কখনো দেখেননি―হোক সে ফর্সা কিংবা শ্যামলা, বেঁটে কি লম্বা―হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা। আপনার মনে হলো, মেঘের আড়ে হঠাৎ বিজলি চমকে উঠল। এই চমকটাই হচ্ছে প্রেম। সে আপনার দিকে কিংবা আপনি তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন, ওই দৃষ্টির সম্মুখে লোহার প্রচীর থাকলেও উড়ে যাবে।

দৃষ্টি কি লোহার প্রাচীর উড়িয়ে দিতে পারে? না, পারে না। এটা আসলে উপমা। এই লোহার প্রাচীর হচ্ছে সমাজ। প্রেম সমাজের ধার ধারে না। সে সমাজের প্রচল প্রথাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এ কারণে প্রেমকে সমাজের ভয়। প্রেম উদ্ধত বলে সমাজ সবসময় প্রেমকে দাবিয়ে রাখতে চায়। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে কী চমৎকার বলেছেন, ‘প্রেম অন্যায়কারী বলে নয়, সাহসী বলেই সমাজের যত ক্রোধ তার উপরে গিয়ে পড়ে। প্রেমিকের আচরণে একটা চ্যালেঞ্জ দেখতে পায় বলে সে তাকে সহ্য করতে পারে না। (সমাজ যেন নীরব ভাষায় বলে ডুবে-ডুবে জল খা না―কে তাতে আপত্তি করে? অত দেখিয়ে দেখিয়ে খাচ্ছিস যে, সাহসের বাড় বেড়েছে বুঝি? আচ্ছা দাঁড়া, তোর বড়াই ভাঙছি।) গোপনে পাপ করে চলো কেউ কিছু বলবে না; না জানলে তো নয়ই, জানলেও না। তুমি যে মাথা হেট করে চলেছ তাতেই সকলে খুশি, তোমাকে অবনতশিরই তারা দেখতে চায়। প্রেমের শির উন্নত বলেই তার বিপদ―সমাজের যত বজ্রবাণ তার মাথার ওপরেই বর্ষিত হয়।’

প্রাপ্ত বয়স্ক দুই যুবক-যুবতী পার্কে বসে প্রেম করছে, তাতে সমাজের ঘোর আপত্তি। একে সাব্যস্ত করে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ হিসেবে। সে কারণেই দেখা যায় পার্কে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছে, প্রেমিক-প্রেমিকাদের গ্রেপ্তার করছে, তিরস্কার করছে, সমুদ্র সৈকতে প্রেমিক যুগলের বিয়ের কাবিন তালাশ করছে। সমাজ কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন অভিযান চলাবে না। ধর্মসৃষ্ট সমাজের কাছে দুর্নীতি-জালিয়াতি অনৈতিক নয়, অনৈতিক প্রেম। সমাজ আসলে ‘অনৈতিক কাম’কে দমাতে চায়। কিন্তু সে প্রেম ও কামের পার্থক্য বোঝে না। দুটোকে গুলিয়ে ফেলে। কাম তো একটা প্রাণবীয় ব্যাপার। পায়খানা-পেশাব যেমন। প্রত্যেক প্রাণীই তা করে। কামের সঙ্গে যখন প্রেম যুক্ত হয়, তখন তা হয়ে ওঠে সুন্দর। স্ত্রীর সঙ্গে কাম একান্তই প্রাণবীয়। কিন্তু কামের পর স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়া হচ্ছে প্রেম। সেখানে কাম থাকে না।

কাম দমাতে গিয়ে সমাজ প্রেমকে দমায়। যুবক-যুবতী পার্কে বসে প্রেম করছে―এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে? যুবক-যুবতী পার্কে বসে চুমু খাচ্ছে―এর চেয়ে পবিত্র দৃশ্য আর কী হতে পারে? কিন্তু ধর্ম ও রাজনীতিসৃষ্ট পশ্চাৎপদ সমাজের এটা সহ্য হয় না। তার কাছে এটা ভয়াবহ অপকর্ম। এই কর্মে সে সমাজের অমঙ্গল দেখতে পায়। সমাজের হিতের জন্য যে প্রেমকে দমানো হয়, তাতে কিন্তু সমাজের হিত হয় না। এই অবদমনের ফলে সমাজ বরং আরো নষ্ট হয়। সে কারণে সভ্যদেশে প্রেম অপরাধ নয়, চুমু অপরাধ নয়। বরং প্রেম ও চুমুর সময় কেউ উৎপীড়ন করলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তার শাস্তি হয়।

সভ্যদেশে বিয়ে-বহির্ভূত কামও কি অপরাধ? মোটেই না। হতে পারে না। একজন নারীকে একজন পুরুষ, কিংবা একজন পুরুষকে একজন নারী কামের প্রস্তাব দিতেই পারে। উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে কাম হতেই পারে। এই কামের জন্য অর্থের বিনিময়ও হতে পারে। তাতে প্রেম থাকে না। তা একান্তই প্রাণবীয়। তা একান্তই প্রয়োজন। পায়খানা-পেশাব যেমন। প্রয়োজনের পর দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে, আর কখনো দেখা না-ও হতে পারে। এই ধরনের প্রস্তাব, এই ধরনের কাম মননে উন্নত জাতির মধ্যেই কেবল হতে পারে। মননে পশ্চাৎপদ মানুষের দেশে এমনতর প্রস্তাব এখনো অপরাধ বলেই গণ্য। এমন প্রস্তাব দিলে নারীটি পুরুষটিকে চরিত্রহীন, কিংবা পুরুষটি নারীটিকে চরিত্রহীনা বলবে। এমনকি পুরুষটির বিরুদ্ধে নারীটি আইনি ব্যবস্থা নিতেও পিছপা হবে না।

প্রেমের প্রসঙ্গে আসি। সমাজের এত দমনের পরেও প্রেম কি থেমে থাকে? থাকে না। ‘ভালোবাসার অপরাধে হয়েছিল দোষী/ তাই বলে কি থেমে ছিল কদমতলার বাঁশি?’ না, থেমে থাকেনি। কখনো থেমে থাকবেও না। আমাদের দরকার প্রেমের অভয়ারণ্য, যেখানে সমাজের দমন-পীড়ন থাকবে না। যেদিন প্রেম ও কামকে আমাদের সমাজ আলাদা করতে শিখবে, কিংবা প্রেম ও কামের সম্মিলনে সৃষ্ট সৌন্দর্যকে বুঝতে না শিখবে, ততদিন আমরা এই সমাজকে সভ্যসমাজ বলতে পারি না।

মহাকালে রেখাপাত
১৩.১০.২০২০

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধবাগাতিপাড়ায় বাল্য বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পেল স্কুল ছাত্রী
পরবর্তী নিবন্ধএকটি বকলম ভাবনা!- কামাল খাঁ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে