মহাকালে রেখাপাত – স্বকৃত নোমান

0
586
Swakrito Noman

জ্ঞানের স্তর তিনটি। প্রথম স্তরে ওঠার পর নিজেকে মহাপণ্ডিত মনে হয়। মনে হয়, সবই তো পড়ে ফেললাম, পড়ার মতো আর তো কিছু নেই। এই পাণ্ডিত্য সে প্রচারও করে বেড়ায়। বিপুল ঔদ্ধত্য দেখা দেয় তার মধ্যে। নানা ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলে বেড়ায়। যেমন, ‘আনিসুজ্জামান কী ছাতা লিখেছেন? তার অবদান কী? তিনি তো অমুক দেশের দালাল। দেবেশ রায় কী কচুটা লিখছেন, এ্যাঁ? তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, তিস্তাপুরাণ, খরার প্রতিবেদন, শিল্পায়নের প্রতিবেদন―এগুলো তৃতীয় শ্রেণির রচনা। পড়া যায় না, একেবারেই অপাঠ্য, বোগাস।’ ঔদ্ধত্যের কবলে পড়ে কখনো কখনো সে হোমারকেও খারিজ করে দেয়, গ্যাটেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, রবীন্দ্রনাথকেও আক্রমণ করে, জীবনানন্দকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। সবাইকে শত্রু ভাবতে শুরু করে। সে ছাড়া জগতের সবাই খারাপ, সবকিছু খারাপ। আইন-কানুন-নীতি-নৈতিকার তোয়াক্কা করে না। কখনো কখনো রাষ্ট্রকেও অস্বীকার করে বসে। জাতীয়তাবাদকে ঘৃণা করে। নিজেকে অপ্রতিরোধ্য মনে হয়। মুর্খের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়। সে বুঝতেই পারে না তার যে একটা চোখ কানা। এই স্তরকে তুলনা করা যেতে পারে পাহাড়ের শিখর থেকে ঝর্ণার জলের পতনের সঙ্গে। উঁচু থেকে ঝর্ণার জল নিচে পতিত হওয়ার সময় খুব শব্দ হয়। সেই জলকে খুব অপ্রতিরোধ্য ও আগ্রাসী মনে হয়। ‘খালি কলস বাজে বেশি’ প্রবাদটি এই শ্রেণির জ্ঞানীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তরে ওঠার পর জ্ঞানকে সে বুঝতে শেখে। জ্ঞানকে ধারণ করতে শেখে। উপচে পড়ে না। আনিসুজ্জামান, দেবেশ রায়ের লেখাজোখাকে নতুন করে আবিষ্কার করে। তাঁদের অবদানটা কী, তা বুঝতে পারে। জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। জ্ঞান অর্জনে আরো গভীর মনোযোগী হয়। ব্যাপৃত হয় অনুসন্ধানে। হোমার, বাল্মিকী, বেদব্যাস, ফেরদৌসি, গ্যাটে, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ প্রমুখকে মাথার ওপর দেখতে পায়। তাঁদের দেখে খানিকটা লজ্জিত হয়। বিনয়ী হয়ে ওঠে। মূর্খকে যুক্তি দিয়ে শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। বন্ধু ও শত্রু নির্বাচনের ক্ষমতা অর্জন করে। আইন-কানুন-নীতি-নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। বুঝতে পারে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা। জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয় তার মধ্যে। নিজ জাতির জন্য সে গৌরববোধ করে। তখন তার দ্বিতীয় চক্ষুটির মুক্তি ঘটে। সে দু-চোখেই দেখতে পায়। এই স্তরকে তুলনা করা যেতে পারে ঝর্ণার জল নদীতে পতিত হওয়ার সঙ্গে। নদীতে পতিত হয়ে ঝর্ণার জল নিঃশব্দে ধাবিত হতে থাকে বিশালের দিকে। অর্থাৎ সমুদ্রের দিকে।

জ্ঞানের তৃতীয় স্তরে ওঠার পর তার প্যান্টটা খুলে যায়। নিজেকে নেংটা মনে হয়। নাদান বালক মনে হয়। মনে হয়, আরে! আমি তো মহামূর্খ। কিছুই তো জানি না। তখন তার অর্জিত জ্ঞানসমূহের বিলুপ্তি ঘটে। সে নির্বাক হয়ে যায়। কিছুদিন এই বিলুপ্তি বা বিলয়ভাব-এর মধ্যে থাকার পর তার চেতনার জাগরণ ঘটে। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। নিজের পুনরুত্থান ঘটানোর জন্য তৎপর হয়। সে তখন জ্ঞান উৎপাদনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন তার আইন-কানুন-নীতি-নৈতিকার প্রয়োজন হয় না, সে এসবের উর্ধ্বে উঠে যায়। কাউকে শত্রু মনে করে না। শত্রুর গালাগালিও গায়ে মাখে না। সবাইকে, সবকিছুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে সে হয়ে ওঠে বিশ্বমানব। তখন তার তৃতীয় চক্ষুর উন্মীলন ঘটে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বসে দেখতে পায় হিমালয়ের চূড়া। তখন তাকে বলা যেতে পারে পরিপূর্ণ জ্ঞানী, পরিপূর্ণ মানুষ, সুপার ম্যান। এই স্তরকে তুলনা করা যেতে পারে ঝর্ণার জল সমুদ্রে পতিত হওয়ার সঙ্গে। মহান সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঝর্ণার জলের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। বেশ কিছুদিন এই নিমজ্জমান অবস্থার মধ্যে থাকার পর একটা সময় সে মেঘ হয়ে আকাশে ওঠে, বৃষ্টি হয়ে জমিনে পড়ে। শস্যক্ষেত্রসমূহ উর্বর করে তোলে, জলাশয়সমূহের সৌন্দর্য বর্ধন করে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ মানুষ জ্ঞানের প্রথম স্তরের নাগাল পায় না। এই শ্রেণিটি সংখ্যায় বিপুল। আবার প্রথম স্তরে উত্তীর্ণদের মধ্যে বিস্তর মানুষ দ্বিতীয় স্তরে উঠতে পারে না, প্রথম স্তরেই তার বিনাশ ঘটে। এই শ্রেণিটিও সংখ্যায় কম নয়। আবার দ্বিতীয় স্তুরে উন্নীতদের মধ্যে বিস্তর মানুষ এ স্তরেই আটকা পড়ে যায়। যেমন ঝর্ণার সব জল সমুদ্রে পতিত হয় না। কিছু জল হাওড়-বাওড়-পুকুর-হৃদ-কুয়ায় আটকা পড়ে। সেখানেই তারা ঘুরপাক খেতে থাকে। একটা সময় সেই জলকে মাটি শুষে নেয়।

মহাকালে রেখাপাত
১৫.০৫.২০২০

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদায়ের নতুনধারা-কবি এম আসলাম লিটনের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধবাগাতিপাড়ায় “নওশেরা যুব কল্যাণ সংঘ’র” উদ্যোগে ঈদ উপহার সামগ্রী বিতরণ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে