মোহিনী – রত্না চক্রবর্তী’র গল্প

0
379
Ratna

মোহিনী
রত্না চক্রবর্তী

রাগে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে নীতার, এই হতচ্ছাড়া জায়গায় একটা মনের মত কাচার লোকও পাওয়া যায় না। কোনদিনই ভালো কাচতে পারে না নীতা, বাপের বাড়িতে মা বৌদিই কেচে দিত। বিয়ে হয়ে ইস্তক আলাদা সংসার, দীপ নিজের প্যান্ট সার্ট লণ্ড্রীতে দেয়, তার দামীগুলো কাপড় জামাও তাই। কিন্তু তার চুড়িদার, নাইটি, চাদর, বালিশের ওয়ার, পর্দা, বারমুডা, গেঞ্জি এগুলো তো কাচতেই হবে ঘরে। না নীতার বাবুয়ানি নেই, রান্না নিজে করে, বাসন মাজা,ঘর ধোয়া মোছা ও নিজে করে। কিন্তু সাবানে তার হাত চুলকায়, র‍্যাশ বার হয়, বাসন মাজে বালি দিয়ে, তাতে কিছু হয় না কিন্তু কাচা? তাই কাচার ব্যবস্থা একটা করতেই হয়। ওয়াসিং মেশিন কেনা বা কারেন্টের বিল দেবার মতো অবস্থার তারা নয়, সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত অতএব কাজের মেয়ে ভরসা। তাও কি টাকা চাইছে!! কষ্টেসৃষ্টে তাই রাখল কিন্তু বনিবনা হয় না।

মালতী এত বাজে কাচে জাস্ট জলে চুবিয়ে টাঙিয়ে দেয়। রাখা গেল না। এরপর পলির মা, তার রোজ কামাই, মাসে দশদিন। এরপর বালতি হিসেবে কদিন কাচানো হল কিন্তু অনেক টাকা পড়ে যাচ্ছে। শেষে এই মোহিনী। মেয়েটা বেঁটে হাট্টা কাট্টা মজবুত গড়নপিটন, ঝপাঝপ কাজ করে, টাকাটাও সাধ্যের মধ্যে, কথা কম কয় আর বলবেই বা কি করে সারাদিন দিনরাত তো মুখে ওই প্যাকেট, কি যেন বলে ওই সুন্দর গন্ধওয়ালা, হ্যাঁ হ্যাঁ গুটখা, গুটখা ঠোসা। এসে দাঁড়ালেই গন্ধ পাওয়া যায়। আবার পাশের বাড়ির রান্নার মাসি বলে মেয়েটার বর নাকি অবাঙালী, ওরা নাকি বর বৌ দলবল মিলে রাতে মদও গেলে। তা মরুকগে, ওর বাড়ি যা খুশি গিলুক, এখানে বেচাল না করলেই হল। তা সে দিকে ঠিক আছে। কিন্তু এর আবার শর্ত আলাদা, সকালে কাচার সময় হবে না, সকালে দশটা নাগাদ এসে ভিজিয়ে চলে যাবে বিকেল চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ এসে কেচে মেলে দিয়ে যাবে। বৌদির ঘুম থেকে ওঠার দরকার নেই, ছাদেই তো জল কল আছে, কেচে মেলে দিয়ে চলে যাবে। পরিষ্কার কাচা।

বাধ্য হয়েই রাজী হল নীতা। বেশ চলছিল। দুদিন আসে নি সেটা আগে বলে গেছে, রেখে দিতে বলেছে, পরে এসে একসাথে কেচে দেবে। তা দিয়েছে। এরপর হল মুশকিল, নীতার দূর সম্পর্কের এক খুড়শ্বশুর মারা গেছেন, কাজ মিটলে শ্বাশুড়ি বলে পাঠিয়েছেন সব কেচেকুচে নিতে। নীতা বলে রেখেছিল মোহিনীকে। একস্ট্রা মোটা টাকা দেবে। মোহিনী বলেছিল ” বড় গামলা আর বড় বালতিতে ভিজিয়ে দিও একসাথে কেচে দেব। ” তা নীতাও তাই দিয়েছিল, মেয়েটা সকাল সকাল এসে ভিজিয়ে দিয়েছিল, বলল ” আজ একটু পরেই কেচে দিয়ে যাব, অন্য বাড়ি ছুটি নিয়েছি ” আর কিছু বলে নি। নীতাও খেয়াল করে নি। সকালবেলা দাঁত মাজতে নীতা রোদ ছাদে ওঠে। সেদিন সকালে গিয়ে চোখ কপালে। গামলা বালতি ভর্তি সব যেমনকার তেমন রইছে, মোহিনী কাল আসেনি!! রাতে কোনদিনও ওরা ছাদে আসে না। নেড়া ছাদ বলে দীপ আসতে মানা করে। তাছাড়া সন্ধ্যের দিকটা রুটি তরকারী বানাতে বানাতে নীতা সিরিয়ালগুলো দেখে।এখন কি হবে ? এত কাচা! কোনকারণে কাল আসতে পারে নি আজ নিশ্চয় ই আসবে, হে ভগবান যেন আসে, নীতা ঠাকুরকে ডাকতে লাগল। বেলা বেড়ে গেল, মোহিনী এল না।

নীতা জানে মোড়ের মাথার ওই প্রফেসরের বাড়ি ও কাচে। বাধ্য হয়ে নাইটি ছেড়ে চুড়িদার গলিয়ে সেই অপরিচিত বাড়ির দোরে দাঁড়াল নীতা। প্রফেসরের বাড়ি ও আসেনি। রান্নার লোকটি বলল ” মোহিনীদি তো কামাই করে না, বলে পাঠিয়েছে কাজ করতে পারবে না, কাল সারা রাত নাকি বমি হয়েছে, কোনরকমে একবাড়ি কাচা ভিজিয়ে ফেলেছে সেটা করে দিয়ে বাড়ি চলে যাবে, আজ কাল আর আসবে না। রান্নার মাসি তার বাড়ি চেনে না। নীতার পাগল লাগছে, হাতে প্ল্যাস্টিক জড়িয়ে কেচে নেবার চেষ্টা করছিল, ওগুলো নাড়াচাড়া করতেইএমন বিটকেল গন্ধ ছাড়ল যে বমি উঠে এল। দীপ তো অনেক রাত্তিরে আসবে। নীপা এবার আশপাশের বাড়ির কাজের লোকের কাছে গিয়ে প্রায় হাতে পায়ে ধরতে লাগল, কেউ রাজী হয় না, শেষে একজন রাজী হল তিনশ টাকা নেবে, কেচে দেবে কিন্তু মেলে দেবে না। অগত্যা তাই করতে হল। রাগে নীতার মাথা আগুন হয়ে আছে, আরে পারবি না তো ভেজালি কেন।? তুই তো জানতিস তোর শরীর খারাপ, তাহলে এভাবে নাকাল করার কোনো দরকার ছিল! আসুক একবার আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দেবে।কিন্তু তিনদিন হয়ে গেল মোহিনী আর এল না।

কাচা তো জমছে, কোন রকমে জল কাচা করে চলছে। রাগ কমে গিয়ে অপেক্ষাই যেন করতে লাগল মোহিনী। দীপ বলল ” চিন্তা কোরো না পরশু তো মাসের এক তারিখ মাইনে তো নিতে আসবে আজ না হোক কাল। কিছু আর বোলোটোলো না, লোক পাওয়া দুর্ঘট, বরং বুঝলে সামনের মাস থেকে কিছু বাড়িয়ে দিও। কিন্তু সেদিন সকালে ও মোহিনী এল না। সন্ধ্যে বেলা হঠাৎই ফেস থেকে তাদের কারেন্ট চলে গেল, সিরিয়ালটা গেল..বিরক্তি লাগছিল এমন সময় বাইরে গ্রীলের গেটের মাথার আংটা খোলার টং করে শব্দ হল। কে আসছে এখন, বৌদির একদিন আসার কথা আছে, চটচট করে হালকা চটির শব্দ পেল, শব্দটা চেনা, মোহিনীর প্ল্যাস্টিক এর চটীর। হ্যাঁ ঠিক তাই দরজায় ঢ্যাক ঢ্যাক ঢ্যাক করে তিনবার ধাক্কার শব্দ হল, মোহিনী.. মনটা খুশি হয়ে উঠল। মোহিনী বেঁটে মানুষ কলিং বেলটা বেশ উঁচুতে, কারেন্ট থাকলে ও এইভাবে দরজা মুঠি পাকিয়ে ঠোকা দেয়, যাক শান্তি, নীতা ছুটে গিয়ে দরজা খুলল। হ্যাঁ মোহিনীর গুটখার সুন্দর গন্ধটা চারদিকে ছড়িয়ে গেছে, কিন্তু মেয়েটা গেল কই? বাইরের গ্রীলটা খোলা, কিন্তু মোহিনীকে দেখতে পেল না। খুব বিস্মিত হল নীতা, ওমা, এরকম এসে চলে যাবার মানে কি? কেউ ডাকল না কি? একটু বেরিয়ে বাইরে উঁকি দিল, ফেস থেকে কারেন্ট গেছে পাড়াটা অন্ধকার , কাউকেই দেখল না, কি আর করে ঘরে চলে এল। রাতে দীপ শুনে বলল ” তোমার দুম করে দরজা খোলাটা ঠিক হয় নি, কোন চোর ডাকাত ও তো হতে পারত! মোহিনী হলে চলে যাবে কেন? ” নীতা একটু ঘাবড়ালো।

কিন্তু গন্ধটা! যে এসেছিল সেও খায় হয়তো! পরদিন নীতা সন্ধ্যে পেরিয়ে আটা মাখতে মাখতে টিভি দেখছিল এমন সময় আলোগুলো দপদপ করতে লাগল, কি কান্ড টিভিটা যাবে তো, আজও সিরিয়াল বরবাদ। টিভিটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট চলে গেল। ইস আজকাল তো লোডশেডিং বড় একটা হয় না, কাল দুটো মোমবাতি ছিল আজ নেই, কেনার কথা মনেও হয় নি। কোনরকমে উঠে গলির দিকের জানলাটা খুলল, ঘরে আশপাশ থেকে খানিকটা আলো এল। সবার বাড়ি আছে! তার মানে তাদের মেন থেকে গেছে! আজ কি গুমোট গরম, একটুকু হাওয়াও নেই। সর্বনাশ, এখন লোক পাবে কোথায়? এক্ষুনি অবশ্য দীপ এসে পড়বে, ফোন করেছিল একটু আগে, নীতা ভাবল ফোন করে একটু জানিয়ে দেবে দীপকে যাতে ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে নিয়ে আসে এমন সময় দরজায় ধাক্কার শব্দ, হ্যাঁ মোহিনীর ধাক্কা দেবার শব্দ কিন্তু দীপের সাবধান করার কথা মনে পড়ে গেল, নীতা গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল “কে? ” উত্তর এল না কিন্তু মোহিনীর পরিচিত খুশখুশে কাশির শব্দ পেল আর কাঁচের চুড়ির শব্দ। নীতা দোর খুলতে গেল, খুলতে না খুলতেই পাওয়া গেল সেই গন্ধ, দরজা খুলে নীতা কাউকেই দেখতে পেল না, অবাক হয়ে উঁকি মারল, দোরের পাশেও কেউ নেই, কিন্তু যাবে কোথায়, খোলা জানলা দিয়ে তো কাউকে যেতে দেখা গেল না! হঠাৎ হু হু করে ঠান্ডা কনকনে হাওয়া বয়ে গেল ঘরের মধ্যে যেন ঢুকে এল, খালি পলিথিনের মগটা টেবিলের উপর থেকে পড়ে গেল, চাপা দেওয়া খবরের কাগজগুলো ও ফরফর করে উঠল। এই গরমে এত ঠান্ডা হাওয়া ! আকাশে মেঘ নেই একটু ও।

গুটখার গন্ধটা যেন ঘরের ছড়িয়ে গেছে, হঠাৎ ই নীতার গা ছমছম করে উঠল, একটা অজানা ভয় তাকে পেয়ে বসল, ঠিক সেই সময়ে দীপ খোলা গেট দিয়ে ঢুকল। ” “কি হল গেট খুলে রেখেছ কেন ? এখনই কুকুর ঢুকে নোংরা করে যাবে ” দীপ বলল। আবার একটা হাওয়ার ঝড় বয়ে গেল, নীতার মনে হল যেন হাওয়াটা ঘরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। ওর গায়ে কাঁটা দিল আর ঘরের আলোগুলোও আবার আপনি জ্বলে উঠল। দীপ বলল “লুজ কানেকশান হচ্ছে বোধহয় কাল চেক করাতে হবে। ” নীতার মনে কেমন একটা ভয় ভয় অস্বস্তি চেপে বসছিল, কিন্তু ও কিছু বলল না। দীপ টয়লেট থেকে এসে বলল “মোহিনী এসেছিল বুঝি? ” চমকে উঠে নীতা বলল ” কেন?” দীপ বলল ” না বাথরুমে মনে এল তোমার ওই মোহিনীর মশলার গন্ধ। ” নীতা ঘাড় নেড়ে না বলল, তারপর আসতে করে বলল ” কাল ভাবছি ওর অন্য কাজের বাড়ি খুঁজে গিয়ে একটু খোঁজ নেব। ” দীপ ফেসবুক চেক করতে করতে ঘাড় নাড়ল। পরদিন দীপ অফিস বেরোবার আগেই একটা আধময়লা পোষাক পরা লোক এল নীতার বাড়ি, বলল “আমি মোহিনীর ঘরের লোক, ভাবী আমার জেনানা মোহিনী চলে গেল, বমি পাখানা করে করে শেষ হয়ে গেল, ডাকডারবাবু বললেন খাবারের সাথে খারাপ কুছু খেয়েছিল, বস্তির আরো চারজন শেষ।

আমি ও বীমার ছিলাম তাই খপর দিতে পারিনি। ওর কাজটাজ তো করতে হবে তাই..” মোহিনীর মাইনে ছাড়াও পাঁচশটাকা দিয়ে দিল দীপ। লোকটা চলে গেল। নীতা ফ্যাঁকাসে মুখে দাঁড়িয়ে রইল, দীপকে বলল ” জানো আমি পরপর দুদিন স্পষ্ট শুনেছি মোহিনী দরজা ধাক্কা দিয়েছে, আমি দেখিনি ঠিকই কিন্তু অনুভব করেছি.. “দীপ অন্য সময় হলে হেসে উড়িয়ে দিত কিন্তু আজ কিছু বলল না। সে আর নীতাকে বলে নি কাল যখন সে খোলা গেট দিয়ে ঢুকছিল তখন হঠাৎ তার মনে হয়েছিল তার পাশ দিয়ে একটা কনকনে ঠান্ডা বাতাস ঝড়ের মতো বয়ে গেল আর সে নিজে বাথরুমে তীব্র গুটখার গন্ধ পেয়েছিল। দীপ বলল ” দেখ হয়ত কথা দিয়ে আসেনি তাই তোমায় জানাতে চেয়েছিল, মেয়েটা ভালো ছিল, আমরা ভগবানের কাছে ওর আত্মার শান্তি কামনা করি। আমি শুনেছি ওই এরিয়ায় বিষাক্ত মদে অনেকে অসুস্থ হয়েছে, কজন মারাও গেছে। হয়তো মোহিনী ও… ভয় নেই আর আসবে না ও দেখো। ”

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনা আক্রান্ত সাংবাদিক পিপলু’র বেড়েছে শ্বাসকষ্ট, দেওয়া হলো অক্সিজেন, দোয়া কামনা
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে অনুমোদনহীন সাপের খামারের সন্ধান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে