‘রন্ধনশালা’ পরাবাস্তবতা ও রূপকের পোশাকে অদ্ভুত এক নগ্ন-সুন্দর গল্প- অমিতকুমার বিশ্বাস

0
384

‘রন্ধনশালা’ পরাবাস্তবতা ও রূপকের পোশাকে অদ্ভুত এক নগ্ন-সুন্দর গল্প- অমিতকুমার বিশ্বাস

বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ পরাবাস্তবতা ও রূপকের পোশাকে অদ্ভুত এক নগ্ন-সুন্দর গল্প। বরফদেশে নদীপাড়ে লোকালয় থেকে দূরে ইগলু-সদৃশ গৃহনির্মাণের পর কথক সেখানে রান্নার উপকরণ সংগ্রহ করে রান্না নয়, কেবল রান্নাভাবনাতেই জীবনকে উপভোগ করে খুব, আর খিদে পেলে খেয়ে ফেলে বরফদেয়ালে গজিয়ে-ওঠা শ্যাওলা। একটা ভেড়ার বাচ্চাকে মুণ্ডু ছিঁড়ে হত্যা তো খিদের জন্যই, কিন্তু সেটাকে রোস্ট করে খাবার আগেই দুঃখী-দুঃখী এক পাখির ডাকে কেঁদে ফেলে, পরিবর্তে খেয়ে ফেলে ভেড়ার নাড়িভুঁড়ি। খায় বন্ধু রবীনও। ভেড়ার বাচ্চাটাকে কাঁধে নিয়ে ফেরার পর রবীন নিরুদ্দেশ, কথক তাকে আবিষ্কার করে এক সন্ধ্যায় নদীর পাশে হাঁটতে-হাঁটতে। রবীন-কে কারা যেন মারধর করে নদীতে ফেলে দিয়েছে, তাই সে সেখানে!
কারা মারল?
কথক বন্ধুকে নিয়ে ফেরে। ঘর দেখায়। বন্ধুর খিদে পেলে রান্নার কথা শোনায়, দেখায় তার এলাহি ব্যবস্থাপনা, কিন্তু শ্যাওলা খেয়েই দুজনে কাটায়, বেঁচে থাকে কেবল রান্নার স্বপ্নটা।
রবীন নৌকোর কথা বলে। সে নৌকো বানায়। দুজনে নৌকোচড়ে কোনও এক পাড়ে নামতেই সেখানের ছোকরারা এক বৃদ্ধের পরামর্শে তাদের দুজনকে উদোম ‘পুলিশি মার’ দেয়, তাতে রক্তপাত হয় না একটুও!
রাষ্ট্রের মার? গল্প উত্তর দেয় না কোনও। গল্পের সে দায় নেই, জানি। আসল মার তো সেইটেই যেখানে রক্তপাত হয় না, অথচ হাজার হাজার লাশ শুয়ে পড়ে রাস্তায়। মধ্যবিত্তরা উঁহুঁ-আহা করেন কেবল, না তারা মুমূর্ষুদের জড়িয়ে ধরতে পারেন আপন বলে, না নিজেদের কুম্ভীরাশ্রুকে আড়াল করতে পারেন কোনও ভাবে। তবে জড়াতে পারলেই তারা মহামানবের পথে হেঁটে যেতে শুরু করেন নিশ্চয়ই। যা চমকায়, তা যেমন সকলই সোনা নয়, সকল নদীও তেমনই অশ্রুজাতিকা হতে পারে না। অগত্যা নিজস্ব অশ্রুতে মুখ দেখে নিজেই ঘোর লজ্জা পাই। মধ্যবিত্ত মেধার মুখোশে ঢাকি।
কথক ও তার বন্ধু ঘরে ফিরে আসে। ফের রান্নার কথা হয়। শেষমেশ যখন ভেড়াটাকে রোস্ট করা হয়, আচমকা গলে যায় বরফের বাড়ি, অথচ সূর্যের তাপেও তা গলেনি এতদিন! অগত্যা মুছে যায় ঘর ও ঘরের দেয়ালে জন্মানো শ্যাওলা-খাবার। এক প্রাপ্তিতে মুছে যায় অন্য প্রাপ্তি। কী অদ্ভুত এ জীবন! তারপর কিনা ভেড়ার রোস্ট খাওয়াই হল না সেই দুঃখী পাখিটির ডাকে।
“দু’জনে মুখ মুছে তারপর সেই ঢাকা দেওয়া খাবারের থালাটার কাছে উবু হয়ে বসি জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের মতন। রোস্টের গন্ধ চারিদিক আমোদিত করে তোলে, সেই গন্ধের ঝাপটা এসে লাগে আমাদের নাকে। আর আমরা সেই গন্ধ নাকে নিতে নিতে কত দিনের যেন কত রাতের যেন কত বছরের বুঝি হাজার হাজার বছরের ক্ষিধেয় শান দিতে থাকে।…”
এ যেন এডওয়ার্ড টমাসের ‘The Owl’ কবিতার পেঁচা, যার ডাকে ক্লান্ত-শীতার্ত-ক্ষুধার্ত কবির খাবার থেকে আরাম—সব গুবলেট হয়ে যায়। কাদের কথা বলছিল পেঁচাটি? না, যারা কিনা সেই রাতে কবির মতো সৌভাগ্যবান নন।
এই নাম না-জানা বিকট চেহারার দুঃখী দুঃখী পাখিটিই একবার একটি পাতাবিহীন গাছে বসে কথকের জরুরি কাজে ( পড়ুন, মলত্যাগ) চিৎকার করে বাধা দিয়ে ওঠে, ‘এখন জরুরি অবস্থা, এখন জরুরি অবস্থা।’ সাংঘাতিক ভয় পেয়ে ঘরে এসে থরেথরিয়ে কাঁপতে থাকে কথক।
জরুরি অবস্থা কোনটা? খিদে না একুশে আইন? মলত্যাগ না বন্দিদশা? খুব করে ধাক্কা দেয় বুকে।
এ গল্প তৃপ্তি দেয় না। আনাড়ি পাঠে গল্পটা কেঁচে যায়। কিন্তু নিবিষ্টপাঠে রসাস্বাদন জমে ওঠে। নড়ে যায় আমাদের পুরোনো ভিত। শুয়োরকে (পড়ুন, শূকর) শুয়োর বলার মধ্যে আনন্দ পাওয়া যায়, ফুলকে ফুল। ঘুরপথে তৃপ্তি এখানেই।
গল্পের ‘সিরিয়াস টোন’ পালটে দিয়ে গল্পের শেষে তাদের অশেষ খাবার (অশেষ ধরে নিয়ে) যদি বুভুক্ষুসারিতে বিলিয়ে দেওয়া যেত, যেভাবে আকাশ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে খাবার এসে পড়ে গুপি-বাঘার হাততালিতে, তাহলে রূপকথাও হতে পারত হয়তো। কিন্তু এ-যে বুভুক্ষু মানুষের রূপহীন কথা।
গল্পটা লেখা ১৯৬২ সালে। সময়, সমাজ ও সাহিত্য ভীষণ সম্পর্কযুক্ত। সময় বাদ দিলে বাকিটা শূন্য হয়ে যেতে পারে। আজ ৫৮ বছর পরও দেখছি সময়ের ‘শ্যামচাঁদ’ পালটায়নি, হাত পালটায়নি, বাবুদের মুখোশগুলোই কেবল যা একটু পালটে গেছে।

ll অকুবি ll

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনানন্দ দাশের জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস ” কবির পাণ্ডুলিপি ” –  মাসউদ আহমাদ
পরবর্তী নিবন্ধনাটোর- বগুড়া মহাসড়কের সম্প্রসারণ কাজের উদ্বোধন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে