একদিন সময়ের অনেক আগেই চলে এসেছি সদরঘাটে। তিনতলা লঞ্চের বারান্দায় অলস আলসেমি নিয়ে দেখছি ঘাট, ঘাটে কত মানুষের কত রকম ব্যস্ততা। দুপুরের তুমুল বৃষ্টি দেখে ভয় পেয়েছিলাম। জল জমে রাস্তায় নির্ঘাৎ কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো জ্যাম লাগবে।
তাই বেলা দুটোয় মীরপুর থেকে সদরঘাট অভিমুখে যাত্রা। চারটা বাজেই পৌঁছে গেলাম সদরঘাট।লঞ্চ সাড়ে পাঁচটায়। ফোনে কেবিন বুকিং দেয়া, অনেকটা আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে। তাই সময়ের অন্তত একঘন্টা আগে আসা বাঞ্ছনীয়। কোন ক্লেশ ছাড়াই কেবিন পেলাম।
গতকাল ছিল টিকার ২য় ডোজ গ্রহণের তারিখ। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পুরোমাত্রায় ক্রিয়াশীল। তবুও এই যে চলমান আমি ঢাকা থেকে দশমিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি সে মনের জোরে। আমার এ দেহঘরের যে কারিগর সে বড় অবহেলায় গড়েছে আমায়। প্রকৃতি সর্বদা সদাচারী নয়।
সকালে ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ক্লাশ ছিল। প্রবেশনারী অফিসারদের সাথে সদাচার বিষয়ে কথা বলছি। তাই হয়তো ওটা এখনও মাথায় ঘুরছে। জ্যামের গ্যারাকলে পড়ে ঘাটে পোঁছানোর আগেই নামতে হলো পথে। ছিপছিপে কাদাপানি পথে, তার উপর আমার সাদা জামদানী! মাথার উপরে গুঁড়া গুঁড়া বৃষ্টি।
কেবিনে পোঁছে ক্লান্তিতে গা ছেড়ে দিলাম বিছানায়। খানিক পরে উঠে শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজের আরাম গায়ে জড়িয়ে লঞ্চের বারান্দায় রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বৃষ্টি নেই, ঝকঝকে আকাশ। চনমনে বিকেলের আলোয় দীপ্যমান চরাচর। তিনতলায় আমার কেবিন হওয়ায় উপর থেকে ঘাট দেখছি।
বুড়িগঙ্গার পানি দেখে বেশ একটা স্বস্তি এলো মনে। ভাদ্র মাস, পানি থৈ থৈ করছে নদীতে, পানির রঙ সবুজাভ। আর কিছু দিন পরে এ দৃশ্য থাকবে না, শীত ঘনিয়ে আসতেই পানি কমে যাবে, পানির রঙ হবে ঘন ঘোলাটে কালো আর দূর্গন্ধ ছড়াবে দেদারছে, বড় মায়া লাগে তখন নদীর জন্য।
ফিবছর বর্ষায় বুড়িগঙ্গা নিজেকে ধুয়েমুছে সাফ করে নেয়। তাই এখনও এত অত্যাচার সয়েও বেঁচে আছে। আকাশে ধীরে ধীরে উড়ছে একটি দুটি চিল। কিছুটা উড়ে একটি চিল বসেছে সুউচ্চ ভবনের ছাদে। বসেছেতো বসেই আছে, একটি কাক এসে ওর পাশেই বসলো। একই এলাকার পাড়াপ্রতিবেশি হবে হয়তো।
শুধু কী চিল, আড়াআড়ি পথে কখনো কাক, কখনো দুটি শালিক, কখনো একটি বুলবুলি উড়ে যাচ্ছে আর পাকড়া পাপিয়াতো আছেই। নিবিড় নিলীমায় উড়তেই আনন্দ ওদের। একটি ভবনের পুরোটা দেয়াল জুড়ে সিমেন্টের বিজ্ঞাপন, দেয়ালে দেয়ালে ঘোষণা দিচ্ছে জন্মই নাকি সৃষ্টির লক্ষ্যে।
ঘিয়া রঙের দেয়াল জুড়ে লাল রঙে লেখা বিকেলের আলোয় আলো ছড়াচ্ছে। ঘাটে নানা বয়সের মানুষের হাঁটাচলা, এরা ঘাটের বাসিন্দা, বেশ একটা রিলাক্স হাবভাব তাদের। যাত্রীদের চোখেমুখে লেগে থাকে একটা উদভ্রান্ত ভাব। এত লোকের মাঝেও একটা মানুষের দিকে আমার দৃষ্টি আটকে গেল।
তামাটে গায়ের রঙ, রোদে পোড়া, ব্রাকব্রাশ করা চুল,সবচুল পাকা, ছোট করে কাটা দাড়ি। সাদামাটা শার্ট প্যান্ট পড়া। এত মিল হয় মানুষের সাথে মানুষের। সেই একই রকম চোখা নাক, মুখে মৃদু হাসি, সামনের দাঁত নেই, মানুষের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে কথা বলছেন, ধীর পায়ে হাঁটছেন প্লাটফর্মের উপর, যেন পৃথিবীতে তাঁর কোন তাড়া নেই।
আমি একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম মানুষটির দিকে উপর থেকে। তিনি ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেলেন না তা। আমার প্রয়াত পিতা যেন এসে দাঁড়িয়েছেন মানুষের ভিড়ে। একটু পরেই তিনি হারিয়ে গেলেন। এদিক ওদিক তাকালাম, না কোথাও নেই তিনি।
দেখতে দেখতেই শেষ বিকেলের আলো নিষ্প্রাণ হতে লাগলো। ক্লান্তি চেপে বসতে চাইছে, উঠে গিয়ে কেবিনে পাতা বিছানায় ছেড়ে দিলাম নিজেকে। জ্বরের উত্তাপ ছুঁয়ে রইল নাছোরবান্দার মতো । আধো আধো চেতনা দুলছে, দুলছে স্মৃতির মন্দির, জীবন তরী কতবার পাড়ি দিল উন্মক্ত পদ্মা !
কত নিবিড় সময়, নিবিড় অনুসঙ্গ ভেসে গেছে দূরে কচুরিপানার মতো, জীবন সমুদ্রে সবই ভেসে যায়, ভেসে যায় স্বয়ং জীবন নিজে। বুঝলাম লঞ্চ পদ্মায় গিয়ে পড়েছে। নদী আমায় ডাকছে ফিসফিস করে। কেবিনের দরজায় ছোট্ট তালা ঝুলিয়ে আলগোছে গিয়ে বসলাম বারান্দায়।
নদীর দিকে চেয়ে চেয়ে মনে পড়ল সেই মরমী গান নদীর কূল নাইরে, কিনার নাইরে- কোন অচিনপুর থেকে এই নিশুতি রাতে ভাটিয়ালি সুর যেন বেজে চলেছে বাতাসে। একেতো ভরা ভাদ্র মাস, নদী এখন পোয়াতি নারীর মতো সর্বাঙ্গে ভরাট নিটোল সুন্দরী! তার উপরে চাঁদপুরের মোহনা যেখানে নদী নিজেই খেই হারিয়েছে বিহ্বলতায়।
এখানে বাতাস দেয় পবিত্র স্নানের অনুভূতি। আমার ঠিক সামনেই সুকানির রুম, সুকানি না বলে তাকে এখন আমার নাবিক বলতে ইচ্ছে করছে। তিনি এই লঞ্চটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন বাংলাদেশের দক্ষিণ ভূভাগে, শেষ স্টেশন পায়রাবন্দর। তারপর আর স্থল নেই, আছে বঙ্গোপসাগর। আমি নামবো দশমিনা হাজিরহাট স্টেশনে।
ঢাকা থেকে বিরতিহীন চলবে, দশমিনার আগে দু একটি ঘাট দেবে। এম ভি ইয়াদ নামের এই লঞ্চটিতে আমি এর আগে একবার ভ্রমণ করেছিলাম, দেরিতে সদরঘাট পৌঁছানোর জেরে সেবার ফোনে বুকিং দেয়া কেবিনটি বেহাত হয়েছিল, অগত্য আমি আর মন্ময় সেবার ডেকে ভ্রমণ করি।
মন্ময়কে ডেকে যাতায়াত করার অভিজ্ঞতা দিতে পেরে এক রকম প্রীত হয়েছিলাম। আমি চাই সংকটে আমার ছেলে যেন ভেঙে না পড়ে। তাই কষ্ট করার শিক্ষাটা দেই সচেতনভাবে। সুখে সকলেই থাকতে জানে, কষ্টটাকে সোনার মতো গলিয়ে যে গয়না বানিয়ে ধারণ করতে পারে সে জানে- জীবন কত সুন্দর!
কাছে দূরে ধাবমান আরো লঞ্চ ছুটছে গন্তব্যপানে ধেয়ে। রাতের আঁধারে দূরে দেখা যায় কূলের ধু ধু ছায়া। শরতের আকাশে তারাদের সরব উপস্থিতি। আমার কেবিনের সামনে বাঁদিকে তিনজন ছেলে মেঝেতে তোষক বিছানো বিছানা গেড়ে হেড়ে গলায় হঠাৎ হঠাৎ গান গেয়ে উঠছে।
বারান্দায় একদিকে চেপে অল্প স্বপ্ল কিছু যাত্রী বিছানা পেতে শুয়েছে এবং মোবাইল স্ক্রীনে যে যার মতো ব্যস্ত। পাশাপাশি দুটো কেবিনে একটি সুবিশাল পরিবার স্থান করে নিয়েছে। দুটো কেবিনে বিধিসম্মতভাবে চারজন মানুষ ভ্রমণ করতে পারে, সেখানে এখন বার জনের মতো মানুষ ঠাসাঠাসি করে বসেছে, দলে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা বেশি।
তুমুল খাওয়া দাওয়া চলছে, বিরিয়ানি, রোস্ট, পরোটা এসব শব্দ কানে ভেসে আসছে। আমি সন্ধ্যায় দুটো কলা, এক পিছ কেক খেয়েই আর কিছু খাব না মর্মে নিজেকে বুঝিয়েছি। নিজের বুঝ নিজের কাছেই কাজ করছে না, আমি খিদে টের পাচ্ছি।
থাক পেটে খিদে, আমি বরং দেখি লঞ্চটি কেমন পানি কেটে কেটে চলছে সামনে, অনির্বচনীয় সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ছে নদীর বুকের উপর। ঐ সুবিশাল পরিবারের একটি কিশোর ছেলে বয়স তের কী চৌদ্দ হবে সে তার বিস্ময় ধরে রাখতে পারছে না, সকলকে ডাকছে, বলছে দেখ এত বাতাস! এত বাতাস! তোমরা কেবিনের বাইরে আস।
পরিবারটির কিশোর কিশোরীর দল বিছানার চাদর বিছিয়ে বসল চালকের আসনের সামনে থাকা লঞ্চের একেবার সামনের চত্ত্বরের মতো খোলা জায়গায়। ওরা পরষ্পর হয়তো চাচাতো-মামাতো- খালাতো-ফুফুতো ভাইবোন।
ওদের হৈ চৈ নদীর সাথে আমরা একান্ত অবসরে কাটানোর ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটালেও ওদের ছিপছিপে তারুণ্যে রাঙা দিনগুলো থেকে যে আনন্দ ঠিকরে বেরুচ্ছে তার দিকে আমি দু একবার লোভাতুর চাহনিতে চেয়ে থেকেছি। শরীর জুড়ে এখন শুধু ব্যাথার বসবাস, এদের বাড়ির আঙিনায় রৌদ্র রোজ হেসে ভেসে যায়।
কেবিনে ফিরে এলাম, লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছি, লঞ্চ মৃদুমন্দ দুলছে, আমিও দুলছি, দূর অতীত দুলছে। আমি শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছি সেই কিশোরের গলার আওয়াজ- এত বাতাস, এত বাতাস। ঐ কিশোর বড় হলেও সকলের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করবে, হয়তো দুঃখগুলোকে লুকিয়ে ফেলবে সকলের অগোচরে।