ভায়লেট হালদার : ভারতীয় উপমহাদেশে উনিশ শতকের সমাজে ছিল ব্রাহ্মণ্য প্রথার বাড়বাড়ন্ত; নারীদের স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। নারীদের অবস্থান ছিল অন্তঃপুরে; ঘরের চৌহদ্দি ছিল তাদের পৃথিবী। এতটাই নিচুস্বরে কথা বলতে হতো যে পাঁচহাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কোন মানুষ নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেত না।
সাধারণ লোকেদের (পুরুষ-নারী) লেখাপড়া শেখার অধিকার ছিল না; শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরা প্রথাগত বিদ্যালয় বাংলায় ‘টোল’ এবং উত্তর ভারতে ‘চতুস্পাটি’ থেকে শিক্ষা লাভ করতেন। আর টোল বা চতুস্পাটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছিল মিশনারী স্কুল- যেখানে বিদেশী এবং কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা ওই মিশনারী স্কুলে পড়াশুনা করতেন।
শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল নগণ্য। সেই যুগেই জন্মগ্রহণ করেন এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, মহীয়সী নারী সাবিত্রীবাঈ ফুলে; তিনি একদিকে নারী জাগরণের অগ্রদূত, শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক ও কবি। অন্যদিকে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে শিক্ষার প্রসার ও প্রচারে অন্যতম প্রধান অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব তিনি। নারী অধিকার রক্ষায় তার আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
সাবিত্রবাঈ ফুলে মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার নওগাঁও গ্রামে ১৮৩১ সালের ৩ জানুয়ারী এক মালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাবা খান্দোজি নেভেশি পাতিল ও মা লক্ষী পাতিল এর জ্যৈষ্ঠ কন্যা সন্তান। জন্মের পরে বাবা-মা তার নাম রেখেছিলে সাবিত্রী পাতিল। মাত্র নয় বছর বয়সে তের বছর বয়সী জ্যোতিরাও ফুলে’র (১৮২৭-১৮৯০) সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর থেকেই তিনি সাবিত্রীবাঈ ফুলে নামেই পরিচিত হন।
যখন তার বিয়ে হয় তখনও তিনি লেখাপড়া জানতেন না। স্বামী জ্যোতিরাও ফুলে’র তের বছর বয়স হলেও, তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তার পক্ষে লেখাপড়া করা ছিল বেশ দুরহ ব্যাপার। কেননা তিনিও জন্মগ্রহণ করেছিলেন সাধারণ পরিবারে, বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। সমাজের মতে, নিচু জাতের ছেলেদের সংকৃত ভাষা শেখা ও বেদ পাঠ করা নিষিদ্ধ। তাই তিনি অন্যান্য উচু জাতের ছেলেদের সঙ্গে পাঠ গ্রহণ করার অন্য টোলে’তে যেতে পারেননি।
জ্যোতিরাও ফুলে’র মামাতো বোন সাগুনা আউ- যিনি এক ইংরেজ পরিবারে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। তার কাছেই জ্যোতিরাও ফুলের প্রথম শিক্ষাপাঠের হাতেখড়ি। পরে সাগুনা’র সহযোগিতায় তিনি ভর্তি হন স্কটিশ মিশনারি স্কুলে। শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আপন চেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। এদিকে সাবিত্রী লেখাপড়া না জানলেও সকলের অগোচরে স্বামীর পাঠ্য বইপত্র নেড়ে চেড়ে দেখতেন।
একদিন তিই বই খুলে দেখছিলেন সেসময় জ্যোতিরাও ফুলের কাছে ধরা পড়ে গেলেন। স্বামী জ্যোতিরাও চাইতেন তার স্ত্রী সাবিত্রী লেখাপড়া শিখুক। এরপরেই স্বামী তাকে শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করেন। আর সাবিত্রী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন এবং শিক্ষালাভের সংকল্প নেন। বাড়িতে বসেই স্বামীর হাত ধরেই শিক্ষার প্রথম পাঠের হাতেখড়ি নেন তিনি।
মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’র মতে, ‘কোনটা সত্য এবং কোনটা মিথ্যা তার সঠিক নির্নয় যিনি করতে পারেন তিনি শিক্ষিত।‘ সত্যকে শোধন করে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শিক্ষাই হচ্ছে হাতিয়ার। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষের মাঝে কিভাবে শিক্ষার বিস্তার করা যায়! ব্রাহ্মণদের আধিপত্য খর্ব করে বর্ণবাদ প্রথার অবসান ঘটাতে চাইতেন তিনি।
জ্যোতিরাও ফুলে মনে করতেন, তার স্ত্রী শিক্ষিত হলে অন্যান্য নারীরাও একদিন শিক্ষিত হবে এবং একদিন নারী জাগরণ হবেই। তিনি যা শিখতেন এবং পড়তেন, সাবিত্রীকেও তিনি সেটুকু শেখাতেন। পরবর্তীতে এই জ্যোতিরাও ফুলে’ই হলেন মহারাষ্ট্রের দলিত নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ ও বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক।
তৎকালীন সমাজে প্রচলিত গোত্র ও লিঙ্গভেদে প্রচলিত বৈষম্য দূরীকরণে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই ছিলেন নির্ভীক যোদ্ধা। তারা নারীসহ সমাজের সকল মানুষের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং সফলও হন।
শিক্ষারাম যশবন্ত পরাঞ্জপে ও শিবরাম ভাওয়াল্কার- এই দুই বন্ধুর সহযোগিতায় জ্যোতিরাও তার স্ত্রী সাবিত্রীকে আহমেদনগরের আমেরিকান মিশনারি পরিচালিত এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে যেটুকু প্রথাগত শিক্ষা লাভ করেন সেইটুকুত উপর ভিত্তি করে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসে শ্বশুরবাড়ির উঠানে চালু করেন পাঠশালা। সঙ্গে ছিলেন স্বামী জ্যোতিরাও আর ননদিনী সাগুণা।
শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু অর্থকড়ি হাতে নেই। সাধ ও স্বপ্ন থাকলেও স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সাধ্য নেই। কিন্তু তাদের স্বপ্নকে সফল করতে এগিয়ে আসেন তাতেয়া সাহেব ভিদে এবং ভিদেওয়াড়াতে নিজের বসত বাড়িটি দান করে দেন স্কুলের কাজে। এরপর ওই বাড়িতে ১৮৪৮ সালের ১৪ই জানুয়ারি- দলিত সম্প্রদায়ের নয়জন ছাত্রী নিয়ে ‘ভিদে ওয়াদা’ নামে প্রথম প্রথাগত স্কুল চালু করেন ফুলে দম্পতি।
ইতোমধ্যে আট বছরের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করছেন ফুলে দম্পতি। স্কুল খোলা, মেয়েদের প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত করার মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানায়নি ব্রাহ্মণ সমাজ; কারণ নিচুজাতের মানুষের প্রথাগত শিক্ষালাভের অনুমতি ছিলনা। মনুস্মৃতি অনুসারে তাদের কাজকে পাপকাজ বলে গণ্য করা হতো। ফলত ফুলে দম্পতির শিক্ষা বিষয়ক কার্যক্রম নিয়ে চারিদিকে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
সমাজের বিশাল অঙ্কের মানুষ প্রচলিত শাস্ত্রীয় কুসংস্কারে নিমজ্জিত। ফুলে দম্পতির দলিত শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করতে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরাই নয়,স্থানীয় নিচুজাতের কিছু মানুষও তাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল। পরিস্থিতি এমন যে গোবিন্দরাও ফুলে সমাজে এক ঘরে হওয়ার ভয়ে, বাধ্য হয়েই পুত্র জ্যোতিরাওকে স্ত্রী সমেত বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন।
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ, সাবিত্রীকে নিয়ে বাবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েন অজানা গন্তব্যে। পথে দেখা হয় বন্ধু উসমান শেখ এর সঙ্গে। তাদের সব কথা শুনে উসমান শেখ এই দম্পতি নিজ বাড়িতে নিয়ে যান এবং আশ্রয় দেন। উসমান শেখ’র বোন ফাতিমাও লেখাপড়া করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। এরপরে সাবিত্রী ও ফাতিমা দুজনেই একসঙ্গে পড়াশুনা চালিয়ে যান।
ফুলে দম্পতি, ফাতিমা ও উসমান শেখ (ভাইবোন) এর বাড়ির আঙ্গিনায় দলিত বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য শিক্ষাদান পাঠকেন্দ্র খোলেন। নিজেরা যেটুকু শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, সেটুকুই অন্যদের শেখাতে শুরু করলেন। কয়েকজন ছেলে পাঠকেন্দ্রে ভর্তি হয়,তখনও মেয়েরা পাঠদান কেন্দ্রে আসেন নি। কিন্তু উসমান শেখের বোন ফাতিমা শেখও তাদের কাছে পড়তে শুরু করলেন।
এরপরে ফাতিমা শেখকে সাথে নিয়ে সাবিত্রীবাঈ বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে লাগলেন। সেসময় সমাজের গোঁড়া, পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনার মানুষ পথিমধ্যে সাবিত্রীবাঈকে নানা ভাবে হেনস্থা করতেন। তারা তাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতেন। কারণ সমাজের চোখে তিনি এক অপরাধী!
একে তো নিচুজাতের হিন্দু ঘরের মেয়ে ও বউ, মুসলমান ঘরে আশ্রিতা! তারপরে আবার শাস্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ!কাজের উদ্দেশ্যে সাবিত্রীবাঈ ঘরের বাইরে বের হলে স্থানীয় লোকেরা তার দিকে ছুঁড়ে মারতো ঢিল, কাদার ঢেলা, গোবর… তিনি থেমে যান নি। তিনি ব্যাগের ভেতর একখানা অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে বের হতেন।
যেসব এলাকায় নিচুজাতের মানুষ বসবাস করতেন তিনি তাদের কারো বাড়িতে ঢুকে পরনের কাপড় বদলে নিতেন; তারপর হাত মুখ ধুয়ে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসতেন। স্বামী জ্যোতিবা ফুলের সহযোগিতায় সাবিত্রী সমাজের সমস্ত গোঁড়ামিকে উপেক্ষা করে তীব্র সাহসের সঙ্গে নারী শিক্ষার কাজ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এভাবেই কেটে গেছে বছর। এরপরে তিনি আহমেদনগরে মার্কিন মিশনারী মিস সিন্থিয়া ফারারের পরিচালিত টিচার্স ট্রেনিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘নর্মাল স্কুল’ থেকে সাবিত্রী ও ফাতিমা শিক্ষক শিখন এর উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেইসাথে ইংরেজী ভাষাও রপ্ত করেছেন তিনি।
শিক্ষক ও শিক্ষণের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর মহিলাদের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করতে তিনি ১৮৫২ সালে তিনি মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেই তো আর হবে না, তার অন্য চাই শিক্ষার্থী। আর শিক্ষার্থী পেতে হলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মানুষদের সচেতন করে তুলতে হবে। আরও আলোর কারিগর তৈরি করতে হবে। তবে না অন্ধকার দূর করে আলোর পৃথিবী গড়ে উঠবে।
কি করে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়! তিনি ফাতিমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পথে, গ্রামের বাড়ি ঘুরে ঘুরে মানুষকে বোঝাতেন শিক্ষার গুরুত্ব, তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠ নিতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন ও উৎসাহ দিতে শুরু করলেন। কুসংস্কার আর সামাজিক অনাচার ও শাস্ত্রের নামে সাধারণ লোকেদের ওপর অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলতেন।
এই সময় সমাজের একাংশ দন্ডমুন্ডের কর্তা রক্ষণশীল ও গোঁড়ামীতে পূর্ণ চিন্তাভাবনার মানুষ সাবিত্রীবাঈকে নানা ভাবে হেনস্থা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে Native Female school এবং The society for promoting the education of Mahrs, Mang, Etceteras নামে দুইটি ট্রাষ্ট গঠন করেন ফুলে দম্পতি।
এই ট্রাস্ট্রের অধীনে আঠারোটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন ফুলে দম্পতি। উল্লেখ্য, সে সময় মিশনারীদের পরিচালিত স্কুলের চেয়েও তাদের পরিচালিত স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশী ছিল। শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৮৫২ সালে বৃটিশ সরকার জ্যোতিবা এবং সাবিত্রী বাই ফুলে’র প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেয়।
ফুলে দম্পতি উপলব্ধি করলেন শুধুমাত্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রথাগত শিক্ষা দিলেই চলবে না। সমাজের লিঙ্গ ও বর্ণবৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে হলে আরও অনেক কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে। সাবিত্রীবাঈ ফাতিমার হাতে স্কুল পরিচালনা দায়িত্ব দিয়ে, স্বামীর সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমাজ সংস্কারের কাজে।
১৮৫২ খ্রীস্টাব্দে সাবিত্রীবাঈ নারীর সম্মান ও মানবিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শুরু করেন আন্দোলন। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন রক্ষণশীল সমাজে অকাল বৈধব্যের শিকার নাবালিকা মেয়েরা ছিল নিদারুণ অসহায়। প্রথানুযায়ী সে যুগে সদ্য বিধবা নারীদের চুল কেটে ফেলা বাধ্যতামূলক ছিল এবং তাদেরকে ব্রহ্মচর্য্য পালন করতে হতো।
এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেন সাবিত্রীবাঈ এবং তিনি এক ধর্মঘটের ডাক দেন। মহারাষ্ট্রের ক্ষৌরকর্মীদের নাবালিকা বিধবাদের মাথা কামানোর কাজ বয়কট করতে অনুরোধ করেন। কারণ কামানো মাথার বালিকা দেখলেই, সমাজের কুচরিত্রের পুরুষেরা ওই মেয়েদের ছলে বলে কৌশলে নিজেদের ভোগের বস্তু বানিয়ে পৈশাচিক লালসা চরিতার্থ করতো।
সাবিত্রীবাঈয়ের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্ষৌরকর্মীরা ঘোষণা করেন যে তারা বাল্যবিধবাদের মাথা আর কামাবেন না। বাল্যবিধবা ও নারীদের মানবিক অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ‘মহিলা সেবা মন্ডল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
‘মহিলা সেবা মন্ডল’ সংস্থায় বাল্য বিধবা, কিশোরী ও নারীদের সদস্য সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। তিনি সকল বয়সের নারীদের লেখাপড়া করার পাশাপাশি ছবি আঁকা, হাতের কাজ, সাহিত্য রচনায় উৎসাহ দিতেন। এর পাশাপাশি নারী শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বিষয়ে লিখেছেন অনেক কবিতা।
অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী সাবিত্রী বাই ফুলের আরও একটি গ্রন্থ ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে অন্যটি হলো ‘ভবন কাশি সুবোধ রত্নাকর’ ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তিনি আধুনিক মারাঠি কবিতার পথিকৃত হিসেবেও পরিচিত।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হয় সিপাহি বিদ্রোহ। যার আঁচ লাগে ফুলে দম্পতির প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোতে। ব্রিটিশ’রা অনুদান দেওয়া বন্ধ করে দেয়। আর সমাজের যারা যৎসামান্য কিছু অনুদান দিতেন তারাও সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন সমাজের রক্ষণশীল শাসকদের ভয়ে।
ফলে অর্থাভাবে সে বছর তিনটি স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। তবুও হাল ছাড়েনি তারা। তাদের সঙ্গে ছিলেন ফাতিমা, উসমান শেখ ও সাগুণা। এই পাঁচজন কঠোর শ্রম আর অধ্যাবসায় দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাদের লালিত স্বপ্ন। এরপরে তারা একে একে প্রতিষ্ঠা করলেন ১৮টি স্কুল।
সমাজের শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজ করে চলেছেন। সংস্থায় বাড়ছে ধর্ষণ, নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার বাল্যবিধবা নারীর সংখ্যা। যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে যে সকল বাল্যবিধবা বা বিধবা’রা গর্ভবতী হয়ে পড়তেন; তারা মানসম্মান বাঁচাতে হয় তারা ভ্রুণ হত্যা করতেন, নয় তারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হতেন।
অবৈজ্ঞানিক উপায়ে ভ্রুণ হত্যা করতে গিয়ে অনেক অল্পবয়সী মেয়েরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন। আবার যাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীর মুখ দেখতো; তারা ছিল সমাজে অবাঞ্ছিত। ফলে ভূমিষ্ঠ সন্তান নিয়ে তারা আর ঘরে ফিরে যেতে চাইতেন না আর পারতেনও না। এসব নাবালিকা বিধবাদের দুঃখে তিনি ব্যথিত হয়ে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভ্রূণ হত্যা’ প্রতিরোধ সংস্থা- যা ‘বালহত্যা প্রতিবন্ধক গৃহ‘ (Home for prevention of infanticide) নামে পরিচিত।
এই সংস্থাটি ছিল গর্ভবতী বাল্যবিধবা ও ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী বালিকাদের আশ্রয় কেন্দ্র। এই ঘরে ধাত্রীমায়েরা গর্ভবতী কিশোরী/নারীদের সন্তান প্রসব করাতেন। যারা সন্তান নিয়ে আর ঘরে ফিরতে পারতেন না, তারা সন্তানদের এই সংস্থায় রেখে যেতেন। এই বাল্যবিধবাদের পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সাবিত্রীবাঈ।
ব্রিটিশরা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে, ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করলেও, এরপরেও মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় টিকে ছিল বর্বর সতীদাহ প্রথা। প্রচলিত কুসংস্কার, লিঙ্গ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষদেরকে শোষণের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ফুলে দম্পতি ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘সত্য শোধক সমাজ’।
তাদের এই ‘সত্য শোধক সমাজ’ এ যোগ দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ- অব্রাহ্মণ, হিন্দু, মুসলিম, সরকারি আধিকারিকসহ সর্বস্তরের মানুষ। এই সমাজের উদ্দেশ্য ছিল, পিছিয়ে থাকা মানুষদেরকে শোষণের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া। এই সত্য শোধক সমাজকে সাথে নিয়ে, সাবিত্রীবাঈ লড়াই করেছিলেন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে।
অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধেও লড়াইয়ে নেমেছিলেন সাবিত্রীবাঈ। নিচুজাত বা দলিত মানুষদের অস্পশ্য বলা হতো এবং ওসব মানুষের কায়িক ছায়াকেও অপবিত্র মনে করা হত। ওই দলিত মানুষের কাতারে দাড়িয়ে থাকা তৃষ্ণার্ত অস্পৃশ্যদের জল দিতে রাজি ছিল না সেসময়কার উচ্চবর্ণের লোকেরা; তাদের দখলেই ছিল বেশিরভাগ পানীয় জলের কুয়ো।
সমাজের তথাকথিত দলিত মানুষেরা, সে সব কুয়ো থেকে জল নিতে পারতেন না। খাল ও পুকুরের দূষিত জল পান করতেন তারা। ফলে নানা ধরণের শারিরীক সমস্যা বা রোগে আক্রান্ত হতেন সাধারণ মানুষ। এ থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে সাবিত্রীবাঈ, নিজের বাড়ির ভেতরে বানিয়েছিলেন প্রকাণ্ড এক কুয়ো। সেই কুয়ো থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করতেন নিম্নবর্ণের মানুষেরা।
একদিন জ্যোতিবা ফুলে নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলেন, এমন সময় তার চোখে পড়ল অল্পবয়সী এক বিধবা নারী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। তিনি ওই বিধবার কাছে গিয়ে তাকে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া থেকে নিবৃত্ত করেন এবং তাকে বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সাবিত্রীবাঈ জানতে পারেন ওই নারী একজন বিধবা ব্রাহ্মণ। নাম কাশীবাই। ধর্ষণের শিকার হয়ে তিনি গর্ভবতী হন।
এই কারণেই তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে সাবিত্রীবাই-এর যত্ন এবং পরিচর্যায় ওই বিধবা নারী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু সন্তান নিয়ে গ্রামে ফিরতে অস্বীকৃতি জানান কাশীবাই। তিনি ফুলে দম্পতির হাতে তুলে দেন পুত্র সন্তানকে; তারা তাকে দত্তক নেন। দত্তকপুত্রের নাম রাখেন যশবন্ত রাও। নিজের সন্তান হিসেবে তাকে সমাজে পরিচয় দেন। এরপরে তারা ফুলে দম্পতির আদর ও স্নেহে সে বড় হতে থাকে।
যশবন্তকে তারা ডাক্তারী পড়ান- যাতে যশবন্ত মানবসেবায় নিজেকে নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে এক বাল্যবিধবার সঙ্গে পুত্র যশোবন্তের বিয়ে দেন। বিয়ের আগে ভাবী পুত্রবধুকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন সাবিত্রী। তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে যশবন্তের উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন- যাতে নতুন পরিবার ও স্বামীর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। সংসারের কাজ থেকে পুত্রবধুকে দূরে রেখেছিলেন, যাতে তার পড়াশুনায় বিঘ্ন না ঘটে।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের নিয়মিত শস্য রপ্তানির কারণেই ভারত জুড়ে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। এই মহা দুর্ভিক্ষ ১৮৭৬-৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। চারিদিকে ভয়াবহ অবস্থা। খাদ্যের অভাব। চারিদিকে রুগ্ন কঙ্কালসার মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।
দুর্ভিক্ষের প্রথম দিকে সাবিত্রী নিজেই স্বামী ও শিশু পুত্রকে নিয়ে রান্না করতে শুরু করেন ভুখা মানুষদের জন্য। রান্নার পরে সেসব খাবার প্যাকেটবন্দী করে স্বামীকে সাথে নিয়ে পৌঁছে দিতেন ক্ষুধার্তের ঘরে ঘরে। এসময়ে তার অন্য সকল কাজ সাময়িক স্থগিত করে ক্ষুধার্ত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে খোলেন বাহান্নটি লঙ্গরখানা।
সাবিত্রীর জীবনে সবচেয়ে মর্মান্তিক দুঃখ সংবাদ নেমে আসে ২৮ নভেম্বর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে। তার পথপ্রদর্শক সহযোদ্ধা স্বামী মহাত্মা জ্যোতিরাও আর নেই। ১৮৮৮ সালে স্ট্রোক হওয়ার পর তিনি প্যারাপ্লেজিকে ভুগে তিন বছর অচল থাকার পরে প্রয়াত হন। সাবিত্রী নিজেকে শক্ত করেন। সৎকারের প্রাচীন সামাজিক প্রথা ভেঙে স্বামীর শবযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবিত্রীবাঈ।
নিজের মাথায় করে বয়ে নিয়ে যান স্বামীর অস্থিকলস। সেদিন সাবিত্রী এসকল কর্মে বাধা দিতে সাহস পায়নি সমাজ শাসকেরা। বরং তারা নিশ্চুপ থেকে অবলোকন করেছিল সেই দৃশ্য। সৎকার শেষে সমাজ কর্মে মনোনিবেশ করেন তিনি।
১৮৯৬ – ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ জুড়ে দেখা দেয় ভয়ংকর বিউবনিক প্লেগ। শুরুর প্রথম এক সপ্তাহে প্রায় ২০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ হয়। এই মহামারীতে আক্রাতদের সেবায় লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। প্রতিটা বাড়িতে নেমে আসে নিরব শ্মশান। একদিকে জাতিগত বিদ্বেষ; ফলে ব্রাহ্মণ ডাক্তাররা কিছুতেই অস্পৃশ্য শূদ্র এবং দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের চিকিৎসা সেবা দেয়ায় অনীহা প্রকাশ; অন্যদিকে মহামারী প্লেগ।
আক্রন্তদের সেবার ব্রতী হন সাবিত্রীবাঈ ফুলে এবং তার পুত্র ডা. যশবন্তরাও ফুলে। জাতপাত নির্বিশেষে সকল মানুষের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে সাবিত্রীবাঈ ও পুত্র যশবন্ত পুনেতে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র খোলেন। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে পথে-ঘাটে পড়ে থাকা রোগীদের তুলে নিয়ে আসতেন চিকিৎসা কেন্দ্রে এবং চিকিৎসা করতেন।
সেসময় মান্ডোয়ায় দশ বছর বয়সী আক্রান্ত একটি ছেলেকে রাস্তায় ফেলে যান তার পরিবার। সাবিত্রীবাঈ রাস্তা থেকে ওই ছেলেকে তুলে আনেন চিকিৎসা কেন্দ্রে। রাতদিন সেবা করে তাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করেন। এরপরেই নিজেই আক্রান্ত হন প্রাণঘাতী প্লেগে। সাবিত্রীবাঈকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন পুত্র যশবন্ত।
১০ মার্চ, ১৮৯৭ সব চেষ্টা বিফল করে মাত্র ৬৬ বছর বয়সে মহীয়সী সাবিত্রীবাঈ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঘুণেধরা পৈশাচিক বর্বর সমাজের ভীত নাড়িয়ে দিয়ে এবং সভ্যতার বাতি জ্বালিয়ে তিনি চলে গেছেন দূরে। আজও সেই দূরের আলোয় আলোকিত হয়ে বেঁচে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারী। যার হাত ধরে সমাজের অন্তজ বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সভ্যতার আলোয় আলোকিত হয়েছে- তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাকে ঠাই দিয়েছেন উপেক্ষিত ইতিহাসের পাতায়…
তিনি গত হওয়ার প্রায় ৯০ বছর পরে ১৯৮৩ সালে পুনে সিটি কর্পোরেশন একটি স্মৃতি স্মারক স্থাপন করেন। এরপর ২০১৫ সালে পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘সাবিত্রীবাঈ ফুলে পুনে বিশ্ববিদ্যালয়’ নামকরণ করে। এরপরে ১৯৯৮ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ তার সম্মানে একটি ডাকটিকেট প্রকাশ করে।
মহীয়সী সাবিত্রীবাঈ ফুলে কি বিস্মৃতির অন্তরালেই স্তব্ধ হয়েই থাকবেন?
তথ্যসূত্রঃ
১। Dr. Renu Pandey, Crusaders of Female Education in Colonial India: A case study of Savitribai Phule
২। Savitribai Phule: Her Life, Her Relationships, Her Legacy by Reeta Ramamurthy Gupta
৩। https://indiatoday.intoday.in/…/who-is…/1/561392.html
৪। https://www.ndtv.com/…/who-is-savitribai-phule-19th…
৫। https://www.studymamu.in/2022/03/blog-post_20.html