একুশের ডায়েরি
বিপ্লব কুমার পাল
পর্ব ০৫
অনেক কথা, অনেক আলোচনা, অনেক পরিকল্পনা, অনেক স্বপ্ন, অনেক প্রত্যাশা। এই অনেকে অনেক কিছু নিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ জয়েন করি একুশে টেলিভিশন। পদবি- চিফ প্ল্যানিং অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর। আমার এই চাকরি পাওয়া পুরো কৃতত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় দাদার।
তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে পহেলা ফাগুন, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের দিন যোগদান করি একুশে টিভিতে। যে টিভির ২০০০ সালের শুরুর পর্ব নিয়ে আমার অনেক কৌতুহল ছিল। যে টিভির একদিন জেলা প্রতিনিধি ছিলাম, সেই টিভিতে আমার এই নবযাত্রা নিয়ে রোমাঞ্চিত ছিলাম। ২০০০ সালের মতো হয়তো আর বিখ্যাত নয় টিভিটি, কিন্তু নামটিকে ঘিরে আবেগটাও কম নয়।
আমার সুপারিশে চাকরি হলো আরো তিনজনের। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক ডেস্কে যোগ দিল আশরাফ শুভ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একুশে টিভিতে জয়েন করলোনা আদিলুর রহমান ও ইবনে কামাল। দু’জনই ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের রিপোর্টার। নতুন কিছু করার আমার এই স্বপ্নযাত্রায় তাদেরও একুশে টিভিতে জয়েন করার কথা ছিল। কিন্তু একুশে টিভির অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরকে তাদের যোগ্য মনে হয়নি।
এজন্য অ্যাপয়েন্ট লেটার নেয়ার পরও ইটিভিতে জয়েন করেনি। তারা বললো, ‘ইটিভিতে নতুন অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর যোগ দিলেন তিনি কখনও টিভিতে কাজ করেনি। পত্রিকা ও টেলিভিশনের সংবাদের ভাষা, ধরণ, গঠন প্রক্রিয়া সবই আলাদা। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর আমাদের কথা বুঝবে না বা আমরা তাকে বোঝাতে পারবো না; আবার তার পক্ষে হঠাৎ করে ব্রডকাস্ট জার্নালিজম বোঝা সহজ হবে না।
এর প্রভাব পড়বে কাজেও’। তাদের যুক্তি কিছুটা ঠিক বলেই মনে হয়েছিল আমার। তাদের সিদ্ধান্ত তাই মেনেও নিয়েছিলাম। যদিও পীযূষদার সাথে এতো বিষয় কথা হয়েছে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ওই পদে নিয়োগের ব্যাপারে কখনও কিছু বলেননি। আগে জানলে- তাদের ব্যাপারে হয়তো অন্য সিদ্ধান্ত নেয়া যেতো। একইভাবে নিউজ এডিটর নিয়োগ দেয়া হয়েছে- যিনি কখনও টিভিতে কাজ করেননি।
তিনি ছিলেন- একটি দৈনিকের সিনিয়র সাব-এডিটর। স্বাভাবিকভাবে একুশে টিভির রানডাউন করতে পারেন না, স্ক্রিপ্ট এডিট করতেও জানেননা। এটাই স্বাভাবিক, কারণ তিনি তো কখও এই কাজটি করেনি, পারবেন কিভাবে। যার প্রভাব পড়েছে কাজেও। নতুন লোক নিয়োগ হয়েছে ঠিকই কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজে আসেনি।
অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর বা নিউজ এডিটর নয়, এক লাইন বাংলা বাক্য ঠিক মতো লিখতে পারেনা, তাকেও নিয়োগ দেয়া হয় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে। ভয়েজ দেওয়া তো দূরের কথা। প্রডাকশন টিমের ইপি তো কাউন্টডাউন দিতে পারেনা। অথচ তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ইপি হিসেবে। স্বাভাবিকভাবে নিউজ রুমে এনিয়ে চাপা ক্ষোভ শুরু হয়। তবে কিছু যোগ্য লোকও নিয়োগ দিয়েছিলেন দাদা।
নতুনদের নিয়োগ দেওয়ার আগে একুশে টিভিতে ইনক্রিমেন্ট ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। সেখানেও প্রায় একই চিত্র ছিল। সেন্ট্রাল ডেস্কে যিনি ভালো কাজ করেন, তার প্রমোশন দেয়া হয়নি। একইভাবে জয়েন্ট নিউজ এডিটরের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে; অথচ তিনি রানডাউন করতে পারেননা, সংবাদ সম্পাদনাও জানেননা। তার যোগ্যতা তিনি সিএনই’র শ্যালিকা। প্রধান বার্তা সম্পাদকের (সিএনই) প্রধান কাজ হলো আউটপুট সামলোনা, সেন্ট্রাল ডেস্কের সবকিছু দেখা। অথচ সেন্ট্রাল ডেস্কের আশেপাশে আসতেন না সিএনই অখিল পোদ্দার।
রানডাউন করা তো দূরের কথা। এটি তার দোষ না। তিনি সারাজীবন রিপোর্টিং করেছেন। কখনও ডেস্কে কাজ করেননি, রানডাউন বানাননি। তার পক্ষে তো সেটি করা সহজ নয়। আমি যেমন পীযূষদার আর্শীর্বাদে চিফ প্ল্যানিং অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর হয়েছি, ঠিক তেমনি অখিল পোদ্দারও সিএনই হয়েছেন। কাজ জানা কিংবা না জানা কোনো বিষয় নয় এখানে।
যাই হোক, বার্তা কক্ষে নতুন আর পুরাতন কর্মীদের মধ্যে কিছুটা রেষারেষি শুরু হলো। ঠিক রেষারেষি বললেও ভুল হয়, আসলে বঞ্চনা আর সুবিধার লড়াই বলা যেতে পারে। যারা দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করছে তাদের বেতন খুবই কম, অথচ যারা নতুন যোগদান করলেন তাদের বেশি। যেমন- একজন রিপোর্টার ৮ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি মাসে ১০ টাকা পান, একই পোস্টে নতুন যোগ দেয়া রিপোর্টারের বেতন ২০-২৫ টাকা হয়েছে। তাই পুরনোদের মন খারাপ।
একুশে টিভিতে জয়েন করার পরই আমার কাজ ও পদক্ষেপ কি হবে জানতে চেয়েছিলাম পীযূষদার কাছে।- নিউজরুমের কাজের সাথে যুক্ত হতে বললেন। পাশাপাশি একুশের রাত টকশো দেখতে বললেন। আমি সরাসরি তাকে দুটি বিষয়ে প্রশ্ন করি- প্রথমটি একুশে টিভির পরিচালক রবিউল হাসান অভির ভাইয়ের সাথে দেখা করবো কিনা।
আর দ্বিতীয়টি হলো- দেবাশীষ রায়ের সাথে কথা বলবো কিনা? দাদা বললেন, দেবাশীষের সাথে কেন কথা বলবে না। সে সেন্ট্রাল ডেস্কে কাজ করে, তুমি কথা না বললে হবে কিভাবে। তবে অভি ভাইয়ের সাথে দেখা না করার নির্দেশ দিলেন। আমি যতো দিন একুশে টিভিতে থেকেছি, অভি ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, কথাও হয়নি।
একুশের নিউজরুমে কমপিউটারে বসা নিয়ে নতুন পুরাতন দ্বন্দ্ব শুরু হলো। সদ্য যোগ দেয়া ফারজানা শোভা কমপিউটারে বসা নিয়ে অনেক কষ্টের কথা বললেন। আরও দু’জনও একই কথা বললেন। আসলে নিউজরুমে যতো ডেস্ক ছিল তার চেয়ে এখন লোক সংখ্যা বেড়েছে। ডেস্ক বাড়েনি, সমস্যা তো হবেই। একই ভাবে নিউজরুমের চেয়ারগুলোও প্রায় নষ্ট ছিল। দাদাকে সবটা বললাম। দ্রুত কমপিউটার ও চেয়ার ক্রয়ের নির্দেশ দিলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যে এলো কমপিউটার ও নতুন চেয়ার।
নিউজ স্টুডিও ফ্রেমটি ছোট ছিল। ইচ্ছে করে ছোট করে রাখা হয়েছিল। পীযূষদার অনুমতি নিয়ে নিউজের ফ্রেমটি আপডেট করলাম, প্রেজেন্টার টেলিবের নিচে নতুন লাইট লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। প্রথমে তারা নানা অজুহাত দিতে থাকে, এটি করা যাবেনা, এটি করলে টেকনিক্যাল এই সমস্যা হবে, ওই সমস্যা হবে ইত্যাদি। যখন সব সমস্যার ব্যাখ্যা দিলাম, তখন সবাই চুপ। কাজ করে দিচ্ছি বললেও দু’দিনেও তা হয়নি।
অথচ কাজটি আধাঘণ্টার। দুদিন পর বিষয়টা পীযূষদাকে জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে ব্রডকাস্ট হেড সুজন দেবনাথকে ফোন দিলেন পীযূষদা। সুজন জানালেন- কিছুক্ষণের মধ্যে কাজটি হয়ে যাচ্ছে। দাদা ফোনের লাইন কাটতে না কাটতে কোথায় থেকে বিদ্যুতের মতো ছুটে এলেন সুজন।
আমাকে বললেন- স্টুডিওর কাজ শুরু হয়েছে। আমি বললাম- ৫ মিনিট আগে সেখান থেকে এলাম, কেউ কিছুই করেনি। সুজন বললেন- বিশ্বাস না হয় আপনি দেখে আসুন। ইশারা দিয়ে দাদা দেখে আসতে বললেন। আমি স্টুডিওতে গিয়ে দেখলাম- টেকনিশিয়ানরা কাজ করছেন। বুঝলাম সুজন বাবু ভয়ংকর ধুরন্ধর মানুষ।
চলবে
বাকি অংশ, পর্ব -৬ এ
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।