একুশের ডায়েরি -বিপ্লব কুমার পাল -পর্ব ০৬

0
211

একুশের ডায়েরি

বিপ্লব কুমার পাল

পর্ব ০৬

একুশে টিভির বার্তা বিভাগে প্রতিদিন বেলা ১২টায় সভা হয়। আজ কি কি প্যাকেজ হতে পারে, আগামীকাল কোন স্পেশাল প্যাকেজ হবে- এসব নিয়ে আলোচনা হয়। পাশপাশি স্পেশাল স্টরির এঙ্গেল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। প্রতিদিনের এই সভায় উপস্থিত থাকেন হেড অব নিউজসহ প্রতিটি বিভাগের প্রধান। একুশে যোগদানের দুদিন পর থেকে আমিও সভায় উপস্থিত থাকি, মতামত দেই।

২০২২ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি, ওই সভায় মানিকগঞ্জ পৌরসভায় অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রচারের প্রস্তাব করেন সিএনই অখিল পোদ্দার। কিন্তু হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী ভাই বললেন, স্টরিটি একপেশে, অসামঞ্জপূর্ণ এবং সাংবাদিকতার নীতিও মানা হয়নি। স্টরিটি সংশোধন না করলে, প্রচার করা যাবেনা। তখন সিএনই বললেন, এই স্টরি করার জন্য সিইও পীযূষদা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন। স্টরটি দ্রুত প্রচার হওয়া দরকার।

রাশেদ ভাই আমাকে স্ক্রিপ্ট দিয়ে প্যাকেজ দেখে মতামত জানাতে বললেন। মিটিং শেষে প্যানেলে গিয়ে স্টরিটি দেখলাম। পরে রাশেদ ভায়ের রুমে এলাম। সেখানে আরও কয়েকজন ছিলেন। আমি বললাম, স্ক্রিপ্ট এডিটিং অত্যন্ত বাজে হয়েছে। যিনি স্ক্রিপ্ট দেখেছেন- হয় তিনি সম্পাদনা জানেননা, নয়তো স্ক্রিপ্ট না পড়েই ছেড়ে দিয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিজনেস এডিটর আতিয়ার রহমান সবুজ খানিক কাচুমুচু হয়ে বললেন, ভাই স্ক্রিপ্টটি আমি দেখেছি।

রিপোরর্টার বললো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেন, সিইও সাহেবের অ্যাসাইনমেন্ট। আমি দু-একটি শব্দ পরিবর্তন করে ছেড়ে দিয়েছি। সবুজ সাহেব এতো বিনয়ের সাথে কথা বলেন, শুনলেই মায়া লেগে যায়। আমার তাই হয়েছে। তার কথা শুনে আমিও লজ্জা পাই। তবে আমি যতোদিন একুশে টিভিতে ছিলাম, ততোদিন সুবজকে কখনো স্ক্রিপ্ট এডিটিং করতে দেখিনি।

যাই হোক, পরে রাশেদ ভাই মানিকগঞ্জের স্ক্রিপ্টটি সম্পাদনা করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। আমি স্টরটি ঠিকঠাক করে রাশেদ ভাইকে জানালে পরদিন তা প্রচার হয়। এই স্টরি নিয়ে একটা রাজনীতিও হয়েছে। কারণ পীযূষদার কাছে এই স্টরির কথা শুনেছিলাম। অখিল পোদ্দার তাকে জানিয়েছিলেন, সিইও অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন বলে, হেড অব নিউজ ইচ্ছে করে স্টরিটি প্রচার করছেনা।

পরে পীযূষদা এই বিষয়টি আমাকে দেখতে বলেছিলেন। স্টরিটি দেখে পীযূষদাকে বিষয়টি জানাই। তখন দাদা বলেন, আমি এই স্টরি করতে বলেছি, তাই বলে আনইথিক্যাল কিছু করতে বলেনি। দাদাকে জানালাম-স্টরি ঠিক করা হয়েছে আগামীকাল প্রচার হবে। দাদা আমাকে ধন্যবাদও দিলেন। বুঝতে বাকী রইলনা, কীভাবে ভুল তথ্য দাদাকে দেয়া হচ্ছে, কীভাবে হেড অব নিউজ আর সিইও’র মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করা হচ্ছে।

একুশে টিভির এক সময়ের জনপ্রিয় টকশো’ একুশের রাত অনুষ্ঠানের আমাকে দায়িত্ব দেন পীযূষদা। একুশে যোগদানের পরই প্রতিষ্ঠানটির কাজের যন্ত্রপাতিগুলো দেখি। পিসিআর থেকে গ্রাফিক্স সবকিছু ঘুটিয়ে ঘুটিয়ে দেখলাম। ব্রডকাস্ট টিম থেকে প্রডিউসার সবার সাথে কথা বলি। উদ্দেশ্য- বর্তমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কতোটা ভালো প্রডাকশন করা যায়।

একুশের রাত অনুষ্ঠানটি বিকেলে রেকর্ড করে রাত ১২টায় প্রচার করা হতো। পীযূষদার অনুমতি নিয়ে একুশে ফ্রেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচারের উদ্যোগ নেই। এজন্য একুশে রাতে প্রডিউসার মনি আর আমি পরিকল্পনা সাজাই। মনি খুব দক্ষ প্রডিউসার। অল্প দিনেই তার সাথে আমার কাজের সম্পর্ক তৈরি হয়।

আমি কি চাই সে খুব সহজে ধরতে পারে। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের জন্য ভাষা সৈনিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে অতিথি চূড়ান্ত করি। এব্যাপারে সহযোগিতা করেন কালের কণ্ঠের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আলী হাবিব ভাই। তিনি গাফফার ভাইকে রাজি করান। গাফফার ভাই লন্ডন থেকে যুক্ত হন, আর স্টুডিও ছিলেন আরও দু’জন অতিথি।

একুশে রাতের প্রডিউসার মনি, ব্রডকাস্ট টিম, গ্রাফিক্স টিম, ক্যামেরাপার্সন সবাই দারুণ কাজ করলো। যেমনটা চেয়েছে তেমনিই হলো। সবাই মিলে এনালক টিভিতে ডিজিটাল ভিউ এনেছিলাম। রাত পৌনে ১২টায় শুরু হলো একুশের রাত। গাফ্ফার ভাই বলছিলেন অগ্নিঝরা ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামের ইতিহাস। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমরা শুনছিলাম। গাফফারে ভাইয়ের ১৫-২০ মিনিট থাকার কথা ছিল।

কিন্তু রাত ১টা পর্যন্ত পুরো অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে বললেন, শরীরের যা অবস্থা এভাবে আর অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাবো কিনা কে জানে। সত্যিই তার ৩ মাস পর, ২০২২ সালের ১৯ মে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। একুশের রাতে ওই অনুষ্ঠানটিই ছিল তার জীবনের শেষ লাইভ টকশো। তাঁর মৃত্যুর দিন ওই অনুষ্ঠানের তাঁর বক্তব্যগুলো পুনরায় প্রচার করা হয়েছিল ইটিভিতে।

যাই হোক ওই একুশে ফেব্রুয়ারির ওই টকশো শেষ হবার পর রাত ১টায় পীযূষদা আমাকে ফোন করলেন। তিনি জানতে চাইলেন কীভাবে এসব করলাম? তিনি বললেন, ইটিভিতে এভাবে করা যায়? সেই সুবিধা আছে? আমি বললাম, অন্য টিভিতে সক্রিয়ভাবে করা হয়। এখানে করতে হয়েছে এনালগ সিস্টেমে। অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। কিন্তু কেউ করতে চায়না, কারণ পরিশ্রম হয়।

পীযূষদা আমাকে কয়েকবার থ্যাংকস দিলেন। অনুষ্ঠানটি শেষ করে আমারও মনে হয়েছে ইটিভিতে অনেক ভালো কিছু করার সুযোগ আছে। যারা আছেন তাদের অনেকে খুব দক্ষ। নানা কারণে তারা কিছুটা আড়ালে থাকেন। এই টিকমে সক্রিয় করা গেলে, দারুণ হবে ইটিভি। সবে মাত্র ৬দিন হলো ইটিভিতে জয়েন করেছি। তাই কাজের আড়ালে স্বার্থষড়যন্ত্রটি চোখে পড়েনি। এই অনুষ্ঠান ভালো হওয়া এবং পীযূষদার অতি খুশি হওয়া কারো কারো রোষানলের লক্ষ্য হলাম আমি…

চলবে

বাকি অংশ, পর্ব -৭ এ

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

Advertisement
উৎসBiplob Kumar Paul
পূর্ববর্তী নিবন্ধজুনের আসরে সংগীতজ্ঞ মুত্তালিব বিশ্বাসকে সংবর্ধনা
পরবর্তী নিবন্ধতিন দিন ব্যাপী কৃষি মেলার সমাপন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে