একুশের ডায়েরি
বিপ্লব কুমার পাল
পর্ব ০৭
একুশে টিভিতে যোগদানের পর পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় দাদাকে পেয়েছি প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে। আগে সম্পর্ক ছিল শুধু ব্যক্তিগত, এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে ‘বস’ হিসেবে। যদিও কখনও সেই প্রটোকল মেনে চলতে হয়নি। দাদা রুমে আমার যাতায়াত ছিল সরল। যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করতাম তাঁর সাথে। তিনিও একুশে টিভির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার মতামত জানতে চাইতেন।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, পীযূষদা একুশে টিভির খরচ নিয়ে চিন্তিত। ট্রান্সপোর্ট আর ব্রডকাস্টের খরচ জোগাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এই দুই ডিপার্টমেন্টে আজ এটা লাগবে তো কাল ওটা। দাদা বুঝতে পারছেন সেখানে নয়-ছয় হচ্ছে কিন্তু ঠিকমতো ধরতে পারছে না। কখনও কঠোর হলে, যন্ত্র নষ্ট হওয়ার অজুহাত দিয়ে সমস্যা তৈরি করা হয়। একুশে টিভির এসি’র মেশিন দু’দিন পর পর নষ্ট হয়। টাকা দিতে দেরি হলে বিভিন্ন অজুহাতে এসি বন্ধ রাখা হয়। তখন গরমে অস্থির একুশে টিভি। টেলিভিশনের সেনসেটিভ ডিপার্টমেন্টের প্রধান সুজন দেবনাথ কলকাঠি নাড়েন। অসহযোগিতার মাধ্যমে চাপ দেয়া এবং দ্রুত সমাধান করে পীযূষদার আস্থাভাজন হওয়া তার অন্যতম লক্ষ্য।
কারণ সুজন যে নয়ছয় করে, তার বিস্তর বিবরণ পীযূষদ আগেই দিয়েছিলেন আমাকে। একইভাবে বিজ্ঞাপনের রাশ টেনে দিয়ে একুশে টিভির আয় কমিয়ে পীযূষদাকে চাপ দেয়ারও চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তখনকার বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের প্রধান আলমগীর কবির ভাই ওই চক্রান্তে পা দেননি। তাই ইটিভির আয়-রোজগারে কোনো সমস্যা হয়নি।
ইটিভির অহেতুক খরচ কমাতে রাতদিন পরিশ্রম করছিলেন পীযূষদা। খরচের কিছু বিষয়ের কথা আমাকে জানান। আমি একটি ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিলাম। আন্তর্জাতিক খবরের জন্য দুটি ইন্টারন্যাশনাল নিউজ এজেন্সি থেকে ভিডিও-সংবাদ কিনতো একুশে টিভি। এতে বছরে ব্যয় হতো ৮০ লক্ষ টাকারও বেশি। আমি দাদাকে বললাম, ইন্টারন্যাশনাল নিউজ এজেন্সি থেকে ভিডিও কেনার প্রয়োজন নেই। দাদা জানতে চাইলেন, এতে নিউজের কোনো সমস্যা হবে না? আমি বললাম না। দাদা প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দিলেন।
এরপর একুশে টিভিতে গত এক মাসের আন্তর্জাতিক সংবাদগুলো সংগ্রহ করলাম। সেখানে দেখলাম ভিও এবং প্যাকেজে, ওই দুটি নিউজ এজেন্সির ফুটেজের খুব একটা ব্যবহার নেই। বিভিন্ন সোর্স থেকে ফুটেজ নিয়ে প্যাকেজ এবং ভিও তৈরি করা হয়েছে। কথা বললাম, ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কের আজিজুল ইসলাম ও দুলি মল্লিকের সাথে। দু’জনই খুব দক্ষ কর্মী, দারুণ কাজ করেন। তারা বললেন, যেসব বিষয় নিয়ে আমরা প্যাকেজ তৈরি করি তার ফুটেজ ওই দুটি নিউজ এজেন্সির কাছ থেকে প্রয়োজন মতো পাওয়া যায়না। তাই বিকল্পভাবে ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়।
দুটি নিউজ এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি বন্ধ হলেও কাজে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানান তারা। এরপর আমি কথা বলি, হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী ভাইয়ের সাথে। সব ঘটনা তাকে খুলে বলি। রাশেদ ভাই, কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা ও ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, দুটি নিউজ এজেন্সি না থাকলেও কোনো সমস্যা হবে না। পরে রাশেদ ভাই ও আমি পীযূষদাকে বিষয়টি জানাই। পীযূষদা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
এই একটি সিদ্ধান্তের কারণে ইটিভিতে বছরে ৮০ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে, কম কি! ফ্রিতে ইন্টারন্যাশনাল ফুটেজের সোর্স ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য একাত্তর টিভির ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কের সাবেক সাংবাদিক বর্ণা তারানাকে ইটিভিতে আমন্ত্রণ জানালাম। নিজেদের মধ্যে তারা অভিজ্ঞতা বিনিময় করলেন। এরপর দুটি নিউজ এজেন্সি ছাড়াই দারুণভাবে কাজ চলতে থাকে ইটিভির ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে।
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পাশাপাশি ইটিভির জন্য সংবাদ ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা চাইলেন পীযূষদা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অনুষ্ঠান “জনরায়ে জনসেবা”’ এবং “তিনি বলেছিলেন, তিনিই করেছেন” অনুষ্ঠান নির্মাণের পরিকল্পনা লিখিত আকারে পীযূষদার কাছে জমা দিলাম। এছাড়া এক ঘণ্টার “একুশের সকাল”, নতুন আঙ্গিকে “মুক্তখবর”, “একুশের জানালা”, “একুশের রঙধনু”, “মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”সহ বেশি কিছু অনুষ্ঠানের প্রস্তাবনা পীযূষদার কাছে জমা দেই।
সবগুলোই দাদা ভীষণ পছন্দ করেন। এরমধ্যে “একুশের সকাল” অনুষ্ঠানটি শুরু করার নির্দেশ দেন। অনুষ্ঠানটি ছিল অনুষ্ঠান ও সংবাদ বিভাগের যৌথ আয়োজন। প্রডিউসার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় অনুষ্ঠান বিভাগের তরুণ প্রডিউসার সবুজকে। স্বল্প বাজেটের বৈচিত্রময় অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক-উপস্থাপিকার জন্য অডিশন নেয়া হয়। কয়েকজনকে চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু তলে তলে ষড়যন্ত্র শুরু করে অনুষ্ঠান বিভাগের কমিশনিং এডিটর সাইফ উদ্দীন আহমেদ। সাইফ-অখিল-সুজন একটি আলাদা বলয় তৈরি করে। এদের সাথে যুক্ত ছিল তাদের কিছু অনুগত-সুবিধাভোগি।
যদিও এই সাইফকে ইটিভিতে নেয়ার জন্য আমিই নাম প্রস্তাব করেছিলাম। কখনও চাকরি করেনি। কয়েকটি নাটক বানিয়েছে আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খ্যাপের কাজ করতেন। সেখানে পীযূষদারও অবদান ছিল। একই থিয়েটার করার কারণে পীযূষদার স্ত্রীর সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সে কথা পুরো ইটিভিতে ছড়িয়েছে। ইটিভির ড্রাইভার থেকে ক্যান্টিনবয় সবাই জানেন যে, সাইফ সিইও স্যারের স্ত্রীর বন্ধু। কিন্তু সাইফ কেন আমার বিরাধীতা করছে? তারও কারণ আমি। দাদা আমাকে চিফ প্ল্যানিং অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর বানিয়েছেন, রুম দিয়েছেন, গাড়ি দিয়েছেন।
বিষয়টি সহজে মানতে পারছিলেন না। কারণ সাইফ তার পদবি নিয়ে অখুশি ছিল। প্রায় আমাকে বলতেন, দাদাকে বলতে। তাকে যেন প্রমোশন দেয়া হয়, রুম দেয়া হয় ইত্যাদি। পীযূষদার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিতেন। বলতেন, ‘অনুষ্ঠান প্রধান পঙ্কজ বণিক কোনো কাজ জানেনা, আমাকে সেখানে বসাতে পারতেন। এতোদিন সম্প্রীতি বাংলাদেশে সময় দিয়ে কি লাভ হলো। পরিশ্রম করবো আমরা, আর মধু খাবে পঙ্কজ।’ আমি বললাম, দাদার ওপর ভরসা রাখুন, আপনার তো চাকরি করার অভিজ্ঞতা নেই, তবুও আপনাকে ভালো পোস্ট দিয়েছেন। কিছুদিন মনোযোগ দিয়ে কাজ করুন। নিশ্চয় দাদা কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন।
নানাভাবে সাইফকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। ইটিভির নাটকের জন্য ব্যাংক কর্মকর্তা ও অভিনেতা টুটুল চৌধুরীর সঙ্গে আমি পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। এরপর থেকে টুটুল চৌধুরীর নাটক ইটিভিতে নিয়মিত প্রচার হয়। এছাড়া ঈদের নাটকের জন্য বৃন্দাবন দাস দাদাকে দিয়ে নাটক লিখে নিয়েছিলাম। চঞ্চল চৌধুরীর সিডিউল নিয়ে, সাইফকে বলেছি কাউকে দিয়ে নাটকটি বানিয়ে নিতে। এছাড়া চঞ্চল চৌধুরীকে দিয়ে একটি অনুষ্ঠান করার প্রাথমিক আলাপও করেছিলাম। প্রখ্যাত শিল্পী মান্না দে’র গাওয়া কালজয়ী গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ এর সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষকে নিয়ে ইটিভির অনুষ্ঠানটি হয়েছিল আমার উদ্যোগে, পীযূষদা সেখানে উপস্থাপনা করেছিলেন।
ঈদের জন্য সাইফ নিজে একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিল। ওই অনুষ্ঠানটি অনুমতি দিতে আমাকে দিয়ে দাদার কাছে তদবিরও করিয়ে নিয়েছিল সাইফ। এতো ভালো সম্পর্ক থাকার পর কেন সাইফ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার শুরু করলেন? এর অন্যতম কারণ অনুষ্ঠান প্রধানের চেয়ার। যেটি আমার কাছ থেকে পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সাইফ-অখিল-সুজন গ্রুপটি অনুষ্ঠান প্রধান পঙ্কজ বণিককে পদ থেকে সরাতে সব কৌশল নিয়েছিল। পঙ্কজকে সরাতে পারলে, অনুষ্ঠান বিভাগের পুরো কর্তৃত্ব পেয়ে যাবে সাইফ। যদিও আমি পীযূষদার সাথে কথা বলে সেই যাত্রায় পঙ্কজকে সরানোর ষড়যন্ত্রে জল ঢেলে দিয়েছিলাম।
একজন আমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করেছিল পীযূষদার কাছে। দাদা তাকে জবাব দিয়েছিলেন- ‘তোমার মতো একশ’জন যোগ করলেও আমার কাছে একটি বিপ্লব হতে পারবে না।’ তখনও দাদার কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। আমার ভাবনাকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। ২০২০ সালে বাজেট নিয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করি। দাদা তাতে সম্মতি দেন। ৯ জুন বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পযন্ত টানা তিন ঘণ্টার লাইভ বাজেট শো’ প্রচার হয়।
তিন ঘণ্টায় তিন প্রেজেন্টার, ছয়জন অতিথি। এছাড়া ৭টার একুশে সংবাদের শেষে ১৫ মিনিটের আলাদা বাজেট শোতে আরেক জন অতিথি এবং রাত ১২টায় তিন জন অতিথিকে নিয়ে টকশো একুশের রাত অনুষ্ঠান হয়। সমালোচনার মুখে ছাই দিয়ে অর্থনৈতিক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং একুশে টিভির ডেপুটি হেড অব নিউজ সাইফ ইসলাম দিলাল ভাইকেও শো’তে হাজির করেছিলাম।
টাকা-পয়সার জটিল এই হিসেবের অনুষ্ঠানটি দারুণ হয়। বিজনেস ডেস্কের আমিন জালাল তালুকদার ও রাজীব জামান, সেন্ট্রাল ডেস্ক, রিপোর্টার, স্টুডিও, পিসিআর, গ্রাফিক্স, আইটি ও এইচআর এডমিন বিভাগ সহযোগিতা করে। বাজেটের অনুষ্ঠানটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। একটি টিভির বিজনেস এডিটর আমাকে ফোন করে বলেন, ‘সব অর্থনীতিবিদ কি আজ একুশে টিভিতে। যাকে ফোন দিচ্ছি তিনিই বলছেন আজ ইটিভি আছি। আমার এমডি তো বলছেন, ইটিভি দেখ তারা কী করছে।’ আমি তার কথা শুনে শুধু হাসলাম।
ইটিভির এই সফলতার কারণে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরও বেগবান করে সুজন-অখিল-সাইফ গ্রুপ। তারা ভেবেছিল বাজেট অনুষ্ঠানটি হয়তো ভালোভাবে হবে না। জুতা সেলাই থেকে চন্ডি পাঠ পুরোটাই যে আমি পারি সেটি তারা বুঝতে পারিনি। কাজ নিয়ে আমাকে মোকাবেলা করা যাবে না, এজন্য পীযূষদার কাছে আমাকে ভিলেন বানানোর ষড়যন্ত্র করতে মনোযোগ দেয় তারা। তাই আবার তারা ফিরলো- সেই পুরনো কৌশলে…
চলবে
বাকি অংশ, পর্ব -৮ এ
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।