দিল্লির দাঙ্গা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রয়াস—সৌরাংশু সিংহ

0
604
singho

দিল্লির দাঙ্গা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রয়াস
=========================সৌরাংশু সিংহ

বলেছিলাম দিল্লির ডেমোগ্রাফি, উত্তর পূর্ব ভারতের ডেমোগ্রাফি, সর্বোপরি পুলিশ কর্মীদের ডেমোগ্রাফি নিয়ে লিখব। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে সব কথাগুলো লেখা কতটা সুরক্ষিত হবে জানি না। তবে এটা ঠিক সরকার তার মেশিনারিগুলিকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য। অন্ততঃ ভারতীয় উপমহাদেশ এর অন্যথা কখনই দেখেনি, আই রিপিট কখনই দেখেনি।

এই বিষয়ে কিছু বলতে গেলে আমাকে একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে হচ্ছে। দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেগুলো হয়েছে সেগুলো এতই বিক্ষিপ্তভাবে যে দিল্লিকে সাম্প্রদায়িকভাবে অস্থির শহর বলা চলে না। দিল্লিতে মুসলিম জনসংখ্যা মোটামুটি ১২%। এদের মধ্যে অধিকাংশই থাকে বিশেষ অঞ্চলগুলিতে। অনেকটা ইহুদি ঘেটোর মত বা কলকাতায় রাজাবাজার বা মেটিয়াবুরুজের মতো।

যদিও এর আগে অধিকাংশ মুসলিম জনবসতি ছিল চাঁদনি চক বা তার আশেপাশে, জরুরি অবস্থার সময় সঞ্জয় গান্ধী এবং তাঁর ডান হাত জগমোহনের তত্ত্বাবধানে দিল্লি পুলিশ ঝুগগি ঝোপড়ি বিশেষত ফিরোজ শাহ কোটলা থেকে অনতিদূরের তুর্কমান গেটের আশেপাশে ধ্বংস হয় শহরের সৌন্দর্যায়নের কারণে। বিভিন্ন সময়ে এই সব অস্থায়ী বসতি দিল্লির বিভিন্ন স্থানেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ৭৫-৭৬এর সেই পুলিশই অভিযান বোধহয় তুলনাহীন। এতটাই পুলিশি অত্যাচারের গল্প ধূলিস্যাৎ হয়ে যাওয়া কাঁচা কাঠামোগুলোতে লেখা ছিল।

তার পরে স্থানচ্যুতদেরই সুপরিকল্পিতভাবে অনিয়ন্ত্রতিতভাবে জমি বণ্টন করে বসবাস স্থাপন করতে দিয়ে ভোটব্যাঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। দশ পনেরো বছর আগেও যাঁরা ডিটিসি বাসে চেপেছেন, তাঁরা নিশ্চয় মনে করতে পারবেন যে বাসের গায়ে বড়বড় করে গন্তব্য লেখা থাকত জে জে কলোনি। আসলে ঝুগগি ঝোপড়ি কলোনি। এগুলোই এখন নাম পেয়েছে, মৌজপুর, কারওয়াল নগর, ইত্যাদি। এমনকি ভজনপুরা, জাফরাবাদ, সীলমপুর, শাহদরায় এগুলো বিভিন্ন স্থানে সঞ্জয়নগর, ইন্দিরানগর, নেহরুনগর নাম নিয়ে আছে। স্বভাবতই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের চক্ষুশূল এই একত্রিত বিজাতিয় সম্প্রদায়ের কলোনিগুলি।

এতদিন ধরে উন্নতির আলো না পৌঁছলেও প্রযুক্তির অস্ত্র হাতে উঠে গেছে এইসব স্থানের মানুষদের। য়ার এই সব এলাকার আশেপাশেই তথাকথিত পুরনো হিন্দু কলোনি। অনুন্নত, বদ্ধ জেলখানার মতো। আসলে দিল্লি প্রায় সাড়ে তিনশো গ্রাম নিয়ে তৈরি। গ্রাম বা কোটলা বা জাগির। এখানেই দিল্লির পুরনো বাসিন্দারা থাকেন, খান, দান, ঘুমোন, প্রাতঃকৃত্য করেন এবং তার সঙ্গে কাঁচা অর্থেই দিন কাটান। দিল্লি যবে থেকে বহুমাত্রিক শহরে পরিণত হয়েছে তবে থেকেই এই সব গ্রামগুলির জমির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। মালিকদের হাতে কাঁচা পয়সা সহজেই এসে গেছে। কিন্তু শিক্ষা সংস্কৃতি বা মনন চর্চা আসেনি। প্রয়োজন পড়েনি। এই গল্প গুরুগ্রাম গাজিয়াবাদ নয়ডারও। তবু আসুন দিল্লিতেই কেন্দ্রীভূত করি। এই সব গ্রামগুলোতে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে কোঠাবাড়ি উঠে গেছে। কিন্তু রেল কামরার মতো তিনটে ঘর, আলো ঢোকে না, বাতাস ঢোকে না, মনন চর্চা তো একেবারেই নয়। শুধু হিন্দু মুসলমান নয়। আশ্রম এলাকার সানলাইট কলোনিতে থাকার সময় আমি সুনামির রাতে (২৬শে ডিসেম্বর ২০০৪) আমি এমনি ক্রিশ্চান সভায় অক্রিশ্চানদের মৃত্যুতে উল্লাসও শুনেছি। কাঁচা পয়সা হাতে এসে যাওয়ায় পড়াশুনো না করেও চলে যাচ্ছে। ঠেট হিন্দিতে মটরগস্তি বলে, চেনা হিন্দিতে আওয়ারাগর্দী।

এই হচ্ছে ডেমোগ্রাফি।

এরপর দিল্লি পুলিশ। দিল্লি পুলিশ স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় মানুষদের নিয়ে গঠিত একটি বাহিনী। স্থানীয় মানুষজন কারা? সর্দার বা মুসলিম থাকলেও মূলত জাঠ এবং গুর্জর অথবা উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা যাদব চৌধুরী এবং পূর্ব রাজস্থানের শিশোদিয়া রাঠৌর প্রভৃতি সম্প্রদায় ইত্যাদি। এরা কারা? সুবিধার জন্য জানিয়ে দিই, শ্রীকৃষ্ণ (যদিও ঐতিহাসিক প্রমাণ নয়) যাদব ছিলেন। যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন ইত্যাদিরা জাঠ। দ্রুপদ আবার উত্তরাখণ্ডী। এরাই মূলত এই দিল্লি হরিয়ানা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ বা পূর্ব রাজস্থানের আদি বাসিন্দা। একাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে পশ্চিমী আক্রমণের সম্পূর্ণ ভরকেন্দ্রে এরাই থেকেছে। এদের মধ্যেই যারা সামাজিকভাবে পিছিয়ে ছিল বা ব্রাহ্মণ্যবাদের শিকার ছিল তারা দ্রুত ধর্ম পরিবর্তনে সায় দিয়েছে। এইভাবে তৈরি হয়েছে আজকের এই মিশ্র ডেমোগ্রাফি। দ্য মিক্সড ব্যাগ।

মধ্যযুগে কী হয়েছে কতটা অসহিষ্ণুতার শিকার হয়েছে এই অঞ্চলের সাধারণ জনগোষ্ঠী কতগুলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে এসবের জন্য যদুনাথ সরকার পড়ে নেবেন। আমি আর এখানে ঘাঁটব না। তবে যেটা তৈরি হয়েছে সেটা হল স্বভাবসিদ্ধ অসহিষ্ণুতা। আমরা যাঁরা সুজলা সুফলা বাংলাদেশে বসে ললিত সংস্কৃতি চর্চা করি তারা একেবারেই বুঝে উঠতে পারব না এই রুক্ষ প্রান্তরের মানসিক গঠন। নিজ পুত্র সন্তানকেও যারা ‘খোতে দা পুত্তর’ (খোতে অর্থাৎ শূকর)সম্বোধন করে, বিহারি বা হিন্দুস্তানি লিহাজি ‘আপ’ নয় শ্বশুর কিংবা ভাসুরও যেখানে ‘তু’, সেখানকার মানসিকতার আঁচ পাওয়া সম্ভব নয়। তবে সরল পথে ভাবনাচিন্তা করে মানুষগুলোকে স্বচ্ছন্দে বিগড়ে দেওয়া সম্ভব দু চারটে রেটোরিকে। ‘ইসলাম খতরে মে হ্যায়’ অনুকরণ করে ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’!

এবারে আসি উত্তর পূর্ব দিল্লির ঘটনাপঞ্জীতে।

শুরুতেই বলে রাখি, আমি ব্যক্তিগতভাবে এইসব স্থানে যেতে পারিনি। তবে সূত্র অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং চেষ্টা করব যে কোন ক্লাসিফায়েড তথ্য যেন দিয়ে না ফেলি।

জাফরাবাদে, যে সিএএ বিরোধী প্রতিবাদ হচ্ছে সেখানে স্পষ্টভাবেই শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা হচ্ছিল। সঙ্গত ভাবেই। কারণ একটা চালু ধারণাই আছে অ্যারোবিক নামের লোকেরা খুব দ্রুত অস্ত্র তুলে নিতে পারে যা ফোঁটা কাটা হিন্দুরা পারে না। তাই জাতীয় সঙ্গীত, সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ, জাতীয় পতাকা, এমনকি ‘বন্দেমাতরম’ ‘ভারত মাতা কী জয়’ স্লোগান, এইসব বিশেষ সিম্বলগুলির অবতারণা। অবশ্য আমার ভিতর থেকে হয়তো কিছুটা হলেও এই সিম্বলগুলির সম্পর্কে প্রতিবাদ উঠে আসে। তবু পরিস্থিতির বিচারে সেকথা থাক।

গত বেশ কিছুদিন ধরেই, আমরা জানি, শাহিনবাগ বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের চক্ষুশূল হয়ে আছে। সরকারের বাস্তব ঢেকে রেখে ‘সুনেহরি দিন’এর স্বপ্নে উঠে থাকা এক টুকরো খোঁচ। আদতে হয়তো গণতন্ত্রের মরূদ্যান। এমনকি বিচারপতি মুরলীধরও বদলি হবার আগে শাহিনবাগের প্রতিবাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন অন্তত আগামী ২৩শে মার্চ পর্যন্ত। শহর কেন দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই শাহিনবাগ কায়দায় প্রতিবাদ গড়ে উঠেছে। মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাতে হলেও সব ধর্মের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুক্তচেতনার মানুষ সামিল হয়েছে এর বিরুদ্ধে।

আপাতদৃষ্টি এটি একটি মতামত। একধরণের মতামত, একটা ভয়, যার শিকড় বেশ কিছুদিন ধরে গভীরে নামতে শুরু করেছে। এর বিরুদ্ধ মত থাকতেই পারে। হতেই পারে আপনি সিএএকে যুগান্তকারী এক আইন বলে মনে করছেন, যার ফলে এক ঝটকায় জিডিপি রেট বেড়ে যাবে, দেশে চাকরি পাবে মানুষ, বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস সম্বলিত মানুষ পড়শি দেশ থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত হয়ে মানবতার স্বর্গোদ্যানে এসে পড়বেন, সকাল বিকেল লেভেল ক্রশিংএ রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবর্তে পাখির কলকাকলি বেজে উঠবে, সূর্য মিঠে কড়া আলোয়া আপনার অঙ্গসঞ্চালন করবে, মৃদুমন্দ বাতাস বইবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাবতেই পারেন। কিন্তু একই সঙ্গে আপনাকেও ভাবতে হবে যাঁরা সেটা মনে করছে না তারা ‘টুকড়ে টুকড়ে’ গ্যাঙের সদস্য নয়, বোমা হাতে নিয়ে জন্মায়নি, নিজের দেশের খেয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিগির তুলে দেশের ক্ষতির কথাই চিন্তা করে যায় না শুধু। দেশের জিডিপিতে তাদেরও উল্লেখযোগ্য যোগদান থাকার কথা।
এর উল্টোটাও সত্য, মানে শুধুমাত্র আপনার আর্বান উদার মানসিকতার বলে বলীয়ান হয়ে বিরুদ্ধবাদীদের পরিধেয় নিয়ে খিল্লি করে চিড়িয়াখানার জন্তুর মর্যাদা প্রদান। আসলে দূরত্ব এভাবেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে।

এই পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু এই পার্থক্যটা শুধু আর শিক্ষা অশিক্ষার থাকছে না। তার জায়গায় এক যুগ যুগ ধরে লালন করে রাখা অনিশ্চয়তা বোধ দাঁত নখ বার করছে। কোনও না কোনও অসুরক্ষার অনুভূতি কলাগাছের মতো ফুলে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই ‘… খতরে মে হ্যায়’-এর বুলি নিয়ে। আর আপাত নিরপেক্ষ, সফট ধর্মাচারীরা এর শিকার হয়ে পড়ছে।
এটা অবশ্য ঠিকই, আমরা প্রথমে সিদ্ধান্তে উপনীত হই আর তারপর যুক্তি খুঁজি সেই সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আমাদের দৈনন্দিন যাপনের মধ্যে ইনফর্মড ডিসিশন মেকিং খুব একটা জায়গা জুড়ে থাকে না।

সে যাই হোক, শাহিনবাগ এখন উগ্রমতবাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থকদের চক্ষুশূল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অত্যন্ত চালাক এক ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে প্রেস্টিজ হারিয়ে দিল্লি হারানো। এটাও পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার আছে যে তিনি কখনই সৎ সঠিক রাজনীতির মসিহা নন। কিন্তু বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অনতিশয়তানদেরই বেছে নিচ্ছি ভোট দেবার জন্য।
যাই হোক, শাহিনবাগ বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী বিজয় রথের সামনে একটা ছোট্ট উইঢিপি, যেটা কালক্রমে পাথরে পরিণত হতে পারে। এবং ছোঁয়াচে রোগের মতো আজ নিজামুদ্দিন, কাল শেখপুরা, পরশু জাফরাবাদে গজিয়ে উঠছে।

এখানেই প্রবেশ অধুনা রাজ্যের ক্ষমতাসীন পার্টি হইতে বিতাড়িত কিন্তু কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন পার্টির দ্বারা লুফে নেওয়া কপিল মিশ্রজীর। যিনি মনে হয় জিন্দেগিকে খেল মনে করেন। ইন্দো-পাক ম্যাচ, বহু বেটিও কো সড়কমে পাঁচ’শ রুপয়া কে লিয়ে বেচ দিয়া শাহিনবাগমে টাইপের রেটোরিকের জন্মদাতা। আসলে নামগুলো পালটে পালটে যায়। কখনও সে সঙ্গীত সোম, আর কখনও তিনি কপিল মিশ্র।
কপিল মিশ্রজী শনিবার হুমকি দিলেন আর পরের দিনই হিন্দু এবং মুসলিম জনগোষ্টী একে অপরকে মারতে উদ্যত হল? হয় নাকি!

৮৪তে সজ্জন কুমার, এইচকেএল ভগত বা জগদীশ টাইটলার আর আজকের কপিল মিশ্রর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ভাষায় কূটবুদ্ধিতে আর উস্কানিতে। এখানেই কাজে আসে ডেমোগ্রাফি। যাদের হাতে কাজ নেই শিক্ষা নেই কিন্তু সময় আছে তারা মাঠে নামে। শিক্ষিত অথচ ‘… খতরে মে হ্যায়’ রেটোরিকে বিশ্বাসীরাও মাঠে নামে। কিন্তু অন্যভাবে। তারা আজকের শক্তিশালী মিডিয়ামে হোয়াট্যাবাউট্রিতে ব্যস্ত রাখেন ও থাকেন। জনমত গঠিত হয় আর ডাইরেক্ট অ্যাকশন শুরু হয়ে যায়।

আগেও বলেছি, উত্তর পূর্বের ডেমোগ্রাফিতে অস্ত্র খুব একটা গর্হিত জিনিস নয়। মানুষ তো হামেশাই মারা যায়। জীবনের দাম এক বোতল রামের থেকেও কম। ফলে রামেরই জয়ধ্বনি আর ঘৃণা হিংসার রূপ নেয়। আর মব কালচারে তথাকথিত পৌরুষ বা মানবতার স্থান নেই, যে লড়াইটা একের বিরুদ্ধে একে বা দশের বিরুদ্ধে দশে লোকে ঝুঁকি নেয় না। সেটাই একের বিরুদ্ধে দশে পেশিশক্তি হয়ে দেখা দেয়। মস্তিষ্কের তন্তু গিয়ে আটকায় হাতের হকিস্টিকে, চেনে বা ব্যারেটা ছররা বন্দুকে। আর কী! এভাবেই দু’কদম দূরে থাকা কারুর বাড়ি যাবার রাস্তা ‘শাহিনবাগ’ ঘুরে হয়ে যায়, মসজিদকে মনে হয় উগ্রপন্থার আঁতুড়ঘর আর টায়ারকে মনে হয় ছুঁচোবাজি।

১৯৮৪তে যেটা হয়েছিল সেটা সিস্টেমেটিক গণহত্যা। আর আজ যেটা হচ্ছে সেটা উস্কিয়ে গণহত্যাকে দাঙ্গার রূপ দেওয়া। যেন প্রতিরোধ করা অন্যায়। প্রতিরোধ করতে গিয়ে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষ মরছে আর কপিল মিশ্ররা বেহালায় কাফির সুর তুলছেন, টুইটারে আস্ফালন করছেন।

আর রাষ্ট্রযন্ত্র? দিল্লি পুলিশ। তারা বরাবর রাষ্ট্রের কাছে মাথা বিকিয়ে আছে। ৮৪ হোক, ৯২ হোক বা ২০২০। দিল্লি পুলিশের প্রাইজ পোস্টিং-এর জন্য যে সব উচ্চপদস্থ আইপিএস অফিসার গৃহ মন্ত্রকের আমাদের মতো সামান্য মধ্যপদের অফিসারদের পা ধরতে কসুর করে না তারা তো নিশ্চুপ থাকবেই! কিন্তু অন্য অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে দিল্লি পুলিশ হয়তো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতোই ক্ষমতাবান। আমার মনে আছে, সরোজিনী নগরে বোমা বিস্ফোরণের সময় আমিও লক্ষ্মীনগর মার্কেটে ছিলাম। কত সহজে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে উপস্থিত সব মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিল তারা। অথবা বাটলা হাউস, জাকির নগর অথবা পার্লামেন্ট আক্রমণ। দিল্লি পুলিশ চাইলে সব পারে কিন্তু করে না বা হয়তো করতে দেওয়া হয় না। আর ঘৃণা আর হিংসা তো ক্ষমতাবানদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকে, দিল্লি পুলিশও আর বাইরে নয়। ডেমোগ্রাফিটা তো আলোচনাই করেছি।

সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে সামান্য সরকারি পদাধিকারী হিসাবে লজ্জিত, স্তম্ভিত, দুঃখিত, হতাশ হওয়া ছাড়া আমাদের জন্য আর কিছু বাকি নেই।

না, ভুল বললাম। আরেকটা বাকি আছে। মাথা বিকিয়ে দিয়ে হোয়াট্যাবাউট্রি করা। যখন ঔরংজেব মন্দির ভাঙছিল তখন কোথায় ছিলে, যখন জিজিয়া কর নেওয়া হচ্ছিল তখন কোথায় ছিলেন, যখন স্বাদ্ধী প্রজ্ঞার মতো দেশপ্রেমীকে জেলে পোড়া হচ্ছিল তখন কোথায় ছিলে, যখন হিতেশ মূলচন্দানী, নবীন ত্যাগীদের মবলিঞ্চিং করা হচ্ছিল তখন কোথায় ছিলে, যখন কাশ্মীরের পণ্ডিতদের তাড়ানো হচ্ছিল তখন কোথায় ছিলে, যখন গডসেকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছিল তখন কোথায় ছিলে, যখন সাভারকরকে ভিতু ইংরাজের পা চাটা কুকুর বলে উল্লাসকর দত্ত, বারীন ঘোষরা চেঁচিয়েছিলেন তখন কোথায় ছিলে!

কোত্থাও না। এখানেই থাকব আমরা, যুগ যুগ ধরে থেকে এসেছি। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না এক হয়ে মিশে গিয়েছি। কিন্তু বিভিন্নতা নিয়েই তো এতগুলো শতাব্দী পার করে দিলাম। এখন আগুন লাগাতে ছুটব? আগুন কিন্তু পোশাক বা রক্তের দাগ দেখে না। সামনে যাকে পাবে তাকেই পোড়ায়। পিছনেও!

–সৌরাংশু সিংহ

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“বিভূতিভূষণের বিমাতা হেমাঙ্গিনী ও বৈরামপুরের কথকতা” – অমিতকুমার বিশ্বাস
পরবর্তী নিবন্ধ“সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাক, জয় হোক মানুষের” – স্বকৃত নোমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে