আজ ৮ মার্চ নারী দিবসে পৃথিবীর সকল নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা নাটোর কন্ঠের পক্ষ থেকে। নাটোর কে এগিয়ে নিতে নারীদের আকুন্ঠ অবদানের কথা লিখেছেন -সুরজিত সরকার।
নারী শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী বার্ধক্যে পুত্রের অভিভাবকত্বে থাকবে, একজন মহিলা স্বয়ংশাসিত থাকার উপযুক্ত নয়। এধারণা বহু প্রাচীন তবে এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে নিয়েছেন স্বয়ং নারীরা।
একটা সময় কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত থাকা সতী, জওহর এবং দেবদাসীর মতো প্রথা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আধুনিক সভ্যতায় এই প্রথাগুলি প্রায় অবলুপ্ত। যদিও কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও এইসব প্রথা মাঝেমাঝে পালিত হওয়ার কথা শোনা যায়।
কিছু সম্প্রদায়ের মহিলারা আজও পর্দা প্রথা মেনে চলেন। বাল্যবিবাহ গ্রামাঞ্চলে আজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি, যদিও এটি বর্তমান আইন অনুযায়ী অবৈধ। প্রথা অবলুপ্ত হলেও অনুশাসন রয়ে গেছে যা এখনও চলার পথে নারীদের পায়ে বিঁধে।
বেগম রোকেয়ার শুরু করা প্রচেষ্টায়, দেখিয়ে দেওয়া সে পথে হেঁটে আমরা যতটুকু সফলতা অর্জন করেছি সেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব একটা নগণ্য নয়। তবে এ অল্প পথ পাড়ি দিতেই আমাদের সময় লেগে গেছে প্রায় এক শতাব্দী।
নারী আজ অন্ধকার হেঁশেল থেকে বাইরে বের হয়ে এসেছেন। ঘরে বাইরে সমান ভাবে তাদের পদচারণা। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন আজকের নারীরা। পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান তালে কায়িক পরিশ্রম করছেন তারা সর্বক্ষেত্রে ।
কৃষিতে, শিল্পে, গার্মেন্টসে, ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে শুরু করে সর্বত্র আজ নারীদের অংশ আশা জাগানিয়া। কিন্তু এ শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়েছে কিনা সেটি আজ সমাজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।
তবে আজ থেকে প্রায় তিন’শ বছর আগে নারীদের প্রশাসক হিসেবে চলতে দেখিয়েছেন যে নারী তিনি নাটোরের নন শুধু। তিনি তাবৎ বাংলার। অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানী। ১৭৪৮ সালে রাণী ভবাণীর স্বামী রামকান্ত মারা যাবার পর নবাব ‘আলীবর্দি খাঁ’ রাজা রামকান্তের স্ত্রী রাণী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
একমাত্র মেয়ে তারা সুন্দরী কে নিয়ে সুদক্ষতার সঙ্গে রাণী ভবানী সুদীর্ঘ ৫০ বছর বিশাল জমিদারী পরিচালনা করেন। এরপর কতশত চিত্রপট পাল্টে গেছে। সেদিনের সে প্রমত্ত নারদ আজ ভাগারে পরিণত হয়েছে। নদী ও নারী একই প্রকৃতি। নারদ যেমন মুক্ত হতে পারেনি তেমন নারীদেরও আটকে রাখার চেষ্টা অব্যাহত।
বর্তমানে নাটোরকে নিজেদের যোগ্যতায় সুনিপুণ ভাবে পরিচালনা করে চলেছেন অনেক নারী। নাটোরের নারীরা আজ স্বয়ং সম্পূর্ণ। তারা কাজ করছেন ব্যাংকে, শিক্ষা ক্ষেত্রে, সরকারী বেসরকারী দফতরে। সাম্প্রতিক বছরে উদ্যেগতা হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন তারা।
নাটোর নওঁগার সংরক্ষিত আসনের সাংসদ রত্না আহমেদ, নাটোর পৌরসভায় দ্বিতীয় দফায় মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন উমা চৌধুরী। এছাড়া নাটোরের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে নিজেদের প্রমাণ করে চলেছেন বেশ কিছু সফল নারী।
তারা তাদের আজকের অবস্থানে আসতে অনেক পরিশ্রম করেছেন। তাদের লড়ায় করতে হয়েছে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার। ঘর সংসার সামলে কাজ করে যাচ্ছেন সমান তালে গুরুত্বপূর্ণ পদে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহিমা খাতুন, সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট রুখসানা খাইরুন নেসা,
সহকারী কমিশনার ও এক্সকিউটিভি ম্যাজিস্ট্রেট (শিক্ষা শাখা) জোবায়দা সুলতান, সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (রেকর্ডরুম শাখা এবং প্রবাসী কল্যাণ শাখা) সাদিয়া আকতার, নাটোর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ আফরোজা খাতুন, সহকারী কমিশনার ভূমি নাটোর সদর মোছাঃ রনি খাতুন,
বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা দেবী পাল, লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা সুলতানা, বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাঃ মরিয়ম খাতুন, সহকারী কমিশনার ভূমি লালপুর শাম্মী আকতার,
বড়াইগ্রামের সহকারী কমিশনার ভূমি কাজী নাহিদ ইভা, সহকারী কমিশনার ভূমি নলডাঙ্গাতে সুমা খাতুন এছাড়াও অনেকেই আছেন যারা তাদের মেধা, পরিশ্রম ন্যায়, সততা দিয়ে দেশের সেবা ব্রতী হয়ে আমাদের নাটোরকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সকলের প্রতি বিন্রম শ্রদ্ধা।
পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীকেও বহুরুপে প্রকাশিত হতে হয়। কখনও মেয়ে, কখনও মা কখনও বোন কখনও গৃহলক্ষী। দুই হাজার বাইশ সালে পণ্যায়নের এই যুগে নারীকেই প্রধান পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে মহাকাশে পাড়ি দিতে সক্ষম একজন নারী।
মন্ত্রিত্ব সামলে উঠতে সক্ষম একজন নারী। দেশ চালাতে সক্ষম একজন নারী। যুদ্ধবিমান চালাতে সক্ষম একজন নারী। কিন্তু তবুও অস্তিত্ব বিপন্ন হয় বা হচ্ছে সেই একজন নারীরই। এখনও একটি মেয়ে আত্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগে। তাদের জন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে থাকবেন নাটোরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নারীরা।
থাকবেন রত্না আহমেদ, উমা চৌধুরীর মত নারীরা। নাটোর রাণী ভবানীর রাজত্ব। তাঁর উত্তরসরীদের এগিয়ে আসতে হবে পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে আর সে অবস্থান তৈরীতে পুরুষদের হতে হবে নারীর সহযাত্রী। মশালে জ্বালতে হবে সেই বিশ্বাসের আলো, যে বিশ্বাসে একজন নারী বলতে পারবে, আমিও পারি এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেখাতে পারবে।
সর্বপ্রথম সে পরিবেশটা তৈরী করে দিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের। এতে যে সফলতা আসবে তাতে করে সকল অন্যায়, আত্মবিশ্বাসহীনতার অন্ধকার দূর হবে। শুধু নাটোর নয় পুরো দেশ ও পৃথিবীতেই প্রতিষ্ঠা হবে প্রজ্ঞা সাম্যবাদের জয়গান। আর সে জয়গানের সুর উঠবে নারীদের কন্ঠেই।