বনলতা নয় রানী ভবানীর নাটোর
বেণুবর্ণা অধিকারী
শেষ পর্ব
বেণুবর্ণা অধিকারী : রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি দেখে ফিরতে ফিরতে অনেকটাই রাত হয়ে গেল, ফেরার পথেই হোটেল থেকে খাবার নিয়ে ফিরলাম। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন একটু দেরিতেই বেরুলাম। প্রথমে নাস্তা করে আমরা চলে গেলাম ঔষধি গ্রাম।
এটা নাটোর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নে। প্রায় ৯৬৭ বিঘা জমিতে শত রকমের ভেষজ গাছ উৎপাদিত ১৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ঔষধি গ্রাম। আমরা সিএনজি নিয়েই প্রথমে গিয়েছি। এরপর হবিয়তপুর পয়েন্ট থেকে ভ্যানে টলটলিয়াপাড়ার উদ্দেশে ৪-৫ কিলোমিটার যেতেই চোখ আটকে যায় বিঘা বিঘা জমিতে ঔষধি গাছের চাষ দেখে।
বাড়ির আঙিনা বা উঠান বলতে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই, যেদিকে চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। লতাপাতা বা কোনো আগাছা নয়, সবই ঔষধি গাছ। এই ঔষধি গ্রামে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় ঘৃতকুমারী / অ্যালোভেরা, শিমুল। এই সময় আমরা এই দুইটারই দেখা পেয়েছি।
এছাড়াও সিজনভেদে চাষ করে – আমআদা, বাসক, তুলসী, হরীতকী, বহেরা, তেলাকুচ, কেশরাজ, ধুতরা, পুদিনা, যষ্টিমধু, নিম, অর্জুন, উল্টোকমল, লজ্জাবতী, হস্তী পলাশ, নিশিন্দা, রাজকণ্ঠ, নীলকণ্ঠ, হিমসাগর, দুধরাজ, ঈশ্বরমূল, রাহুচণ্ডাল, রক্তচণ্ডাল, ভাইচণ্ডাল, বোনচণ্ডাল, ভুঁইকুমড়া, আমরুল,অশ্বগন্ধা, দাউদমূল, শতমূল, কালোমেঘ, পাথরকুচি, মিছরিদানা, কেয়ামূলসহ শত রকমের ঔষধি গাছ। তবে ঔষধি গ্রামে সবচেয়ে বেশি চাষ এবং বিক্রি হয় ঘৃতকুমারী।
এরপর একই ভ্যানে আবার নির্দিষ্ট জায়গায় এসে সেখানকার বাজার থেকে আমআদা আর ভুইকুমড়া কিনলাম কিছু। অটো নিয়ে চলে এলাম কাঙ্ক্ষিত উত্তরা গণভবনে। এখানের গাছপালা বহুদিন ধরে হাতছানি দিচ্ছিল আমাকে। এটা নাটোর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে। মনোরম পরিবেশে ইতিহাস খ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী তথা উত্তরা গণভবন, এর ভেতরে অনেক অচেনা গাছ দেখলাম।
এক ক্ষমতাশালী নারী নাটোরের রাণী ভবানী তাঁর নায়েব দয়ারামের উপরে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করার পর ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষরাজা প্রমদানাথ রায় সপরিবারে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান।
পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজপ্রাসাদটি পরিত্যাক্ত থাকে। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সরকারি ভবন হিসেবে সংস্কার হয়, তখন এতে মসজিদের আকৃতি দেয়া হয়। ১৯৭২ সালে এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এর চারিদিকে লেক, সুউচ্চ প্রাচীর পরিবেষ্টিত ছোট বড় ১২টি কারুকার্যখচিত ও দৃষ্টিনন্দন ভবন নিয়ে উত্তরা গণভবন প্রায় ৪১.৫১ একর জমির উপর অবস্থিত। এখানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এখানে আছে বিরল প্রজাতির নানা উদ্ভিদ, আর এই বাগানের অভ্যন্তরে রয়েছে ইতালী থেকে সংগৃহীত মনোরম ভাস্কর্য। এটাই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারী। এইভাবে দিঘাপতিয়া রাজবংশের ও জমিদারীর গোড়াপত্তন হয় ১৭৬০ সালে।
বর্তমানে এই রাজপ্রাসাদ থেকে হারিয়ে যাওয়া রাজা-রাণীর ব্যবহৃত ঐতিহাসিক দ্রব্যসামগ্রী উদ্ধার করে একটি সংগ্রহশালা নির্মাণ করেন, সাবেক জেলাপ্রশাসক শাহিনা খাতুন, যিনি নিরলসভাবে উত্তরা গণভবনের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নিবেদিত ছিলেন। বর্তমানে উনি স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ের যুগ্ম-সচিব এর দায়িত্বে আছেন।
আমরা মোটামুটি পুরো বাগান ও রাজপ্রাসাদ পরিদর্শন করেছি সেখানে কর্মরত নয়ন সরকার‘এর আন্তরিক সহযোগিতার। নানান গাছ নিয়ে তার আগ্রহ দেখলাম, আশা করি ভবিষ্যতে এদের হাত দিয়েই আরো অনেক দূর্লভ গাছ সেখানে রোপন করা হবে। এবং প্রাচীন গাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবে। সেখান থেকে বেরিয়ে এর সামনের রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়েই চলে গেলাম রানী ভবানীর রাজপ্রাসাদে।
রাজবাড়ির মোট আয়তন ১২০ একর। ছোট-বড় ৮টি ভবন আছে। ২টি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর আছে। রাজবাড়ি বেষ্টন করে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। পুরো এলাকা ২টি অংশে বিভক্ত – ছোট তরফ ও বড় তরফ। রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলো হল শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দির। এতগুলো মন্দিরে প্রতিদিনই অনেক মানুষের সমাগম হয়।
এইকারণে সেখানে অনেক বিক্রেতাও আসে বলে প্রাসাদের চারিদিকে আবর্জনা ছড়িয়ে আছে। এছাড়া এখানে পাবলিক সাংস্কৃতিক মঞ্চ আছে। সব মিলে উত্তরা গণভবনের চাকচিক্যের কাছে এই আসল রাজপ্রাসাদকে বড়ই করুণ লেগেছে। গাছপালাও অনাদৃত বলেই আকর্ষণীয় নয়।
আমাদের নাটোর ভ্রমণের সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন এলাকার সাংবাদিক, পরিবেশকর্মী মাহাবুব খন্দকার।