বনলতা নয় রানী ভবানীর নাটোর -২য় পর্ব
-বেণুবর্ণা অধিকারী
বেণুবর্ণা অধিকারী : আকাঙ্ক্ষিত ক্ষিরিগাছ দেখে আমরা চাপর্ব শেষ করে গাড়িতে উঠলাম, ফেরার পথে একটা দোতলা নকশা করা মাটির ঘর হাতছানি দিল। ছুঁয়ে নিয়ে এগুলাম পরবর্তী গন্তব্যে- হুলহুলিয়া গ্রাম।
এই গ্রামের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এরা নিজেরাই নিজেদের গ্রামের বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন চেয়ারম্যান, মেম্বারদের দ্বারাই। তেমন বড় ধরণের ক্রাইম এখানে হয় না। জমিজমা সংক্রান্ত ক্রাইমই হয় বেশি। এগুলো নিজেরাই আলোচনা সমালোচনার দ্বারাই মিটাতে চেষ্টা করেন, প্রয়োজনে ল-ইয়ারের পরামর্শ নেন।
গ্রামটিতে গিয়ে ভাল লেগেছে। তবে অধিকাংশের আর্থিক অবস্থা ততটা সচ্ছল নয়। পাকা রাস্তা তেমন নেই বললেই চলে। ছোট ছোট মেঠোপথেই যাতায়াত, বর্ষাকালে নিশ্চয় কষ্ট হয়। প্রাচীনতম ২ টা স্কুল দেখলাম এই গ্রামে। এইখান থেকেই পড়াশোনা করে আজ কয়েকজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। তারা এই গ্রামের জন্য সাধ্যমত সাহায্যও করেন শুনলাম।
দুপুরে হুলহুলিয়া গ্রামের চেয়ারম্যানের বাসায় আমাদের নানানপদী খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করলেন চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রী। চেয়ারম্যান হলেন সেখানকার হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি আবার যুবকদের আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের জন্য দক্ষকর্মী হিসেবে যোগ্য করে তুলছেন।
এরপর আমাদের যাত্রা কবিগুরুর পতিশরের কুঠিবাড়ি দেখার। নানান পথ পাড়ি দিয়ে নাটোরের শেষ সীমানায় গেলাম। সেখানে রাস্তা অনেক ভাঙ্গা, কারণ পতিসর নওগাঁ জেলায় পড়েছে। পল্লীর উন্নয়ন ও কর্ম পরিকল্পনার রুপকার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হিসাবে এবং মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে সমবায় পদ্ধতিতে ১৯০৫ সালে কালিগ্রাম পরগনার পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন । নোবেল পুরস্কারের ১লক্ষ ৮ হাজার টাকা এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়।
১৯১০ সালে উত্তরবঙ্গের মহাপ্লাবনের পর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয়ের বন্যাত্রাণ ফান্ডে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত হইয়াছিল এবং এই টাকায় আমেরিকা হইতে কয়েকটি ট্রাক্টর ক্রয় করা হয়। কিন্তু ট্রাক্টর আনা তো হলো কিন্তু কিভাব চালাতে হয় এই প্রযুক্তি সেটা জানেননা সেখানকার কেউ।
কবিগুরুর ছেলে রথীন্দ্রনাথ আমেরিকায় কৃষিপ্রযুক্তি নিয়ে পড়তে গিয়ে ট্রাক্টর চালানো শিখেছিলেন, তাকেই আনা হয় এখানে। সবাই অবাক হয়ে এই মেশিন চালানো দেখে।
যাদুঘরে ঢুকে প্রথমেই কবিগুরুর আবক্ষ মূর্তি নজর কাড়ে,এর ভাস্কর কনক কুমার পাঠান। আশেপাশে কয়েকটা শিমুল গাছ দেখা যায়৷ যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের মানষপটে আঁকা আছে পতিসরে তার আরো অনেক ইয়াং কালের ছবিও দেখা হয় আমাদের।
তার ব্যবহৃত অনেক আসবাবপত্র সেখানে সংরক্ষিত আছে। কবির ব্যবহার্য বিভিন্ন তৈজসপত্র, নানা রকম সামগ্রী, তাঁর হস্তলিপি আর বিভিন্ন ছবিতে ভরা। একটি বাথটাব, একটি নোঙর, বিশাল আয়না, আরাম কেদারা, ওয়্যারড্রব, ঘড়ি, গ্লোব, সিন্দুক, খাজনা আদায়ের টেবিল, খাট, আলমারি, দরজার পাল্লা, জানালা ইত্যাদি।
১৯৩৭ সালে তিনি পতিসর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সব সম্পদ প্রজাদের মধ্যে দান করে দেন।
যাদুঘরের পাশেই রয়েছে কবির ছেলের নামে প্রতিষ্ঠিত রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন।
সবারই সুযোগ থাকলে একবার পতিসর কুঠিবাড়ি দেখতে আসা উচিত। কিভাবে আসবেন? নওগাঁর আত্রাই এর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ খুবই ভালো। তাই আত্রাই এ আসতে হলে ট্রেনে আসাই ভাল। ঢাকা থেকে আন্তনগর ট্রেন নীলসাগর, লালমনি এক্সপ্রেসে চড়ে প্রথমে আত্রাই আসতে পারেন।
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস কিংবা ট্রেনে নওগাঁ, শান্তাহার বা নাটোর এসে পরে আত্রাই আসতে পারেন। নাটোর থেকে আত্রাই বাস, ট্রেন ও নদীপথে নৌকায় আত্রাই আসা যায়।
আত্রাই থেকে পতিসর কাচারিবাড়ি যেতে হবে নসিমনে চড়ে, যা পর্যটকদের ভ্রমণে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। ট্রেন স্টেশনের নিচেই রয়েছে নসিমন/ভুটভুটি স্টেশন। আত্রাই থেকে পতিসরের দূরুত্ব মাত্র ১৪ কিমি।
কোথায় থাকবেন? কাচারিবাড়ির দক্ষিণ দিকে শান বাঁধানো রবীন্দ্র সরোবরের পাড়ে রয়েছে জেলা পরিষদের দোতালা ভবন। থাকতে চাইলে আগে থেকে আত্রাই উপজেলা পরিষদের অনুমতি নিতে হবে এবং খাবার ব্যাপারটিও নিশ্চিত করে আসতে হবে। এখানকার বিশেষ খাবারের মধ্যে রয়েছে নদী ও বিলের দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন সুস্বাদু মাছ।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময় হলো রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিবস ২৫ বৈশাখ। এদিনকে ঘিরে এখানে জাতীয় পর্যায়ের রবীন্দ্র উৎসব ও মেলা হয়। এ সময় দেশ-বিদেশের রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের ঢল নামে, তখন এখানে এলে আপনিও আনন্দ পাবেন ।
বর্ষার সময় এখানে আসলে কুঠিবাড়ির পাশাপাশি এখানকার নদী, পাশের বিশাল বিলে নৌকা নিয়ে ঘুরতে পারেন। তাছাড়াও বছরের যেকোনো সময় আসতে পারেন রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত পতিসরের টানে।
ক্রমশঃ