মমতার আলো – স্বপন চক্রবর্ত্তী  

0
510
Shapon

মমতার আলো – স্বপন চক্রবর্ত্তী

আচ্ছা, মমতার কি কোন আলো হয়?
ভালোবাসার বা প্রেমের?
– হয় বৈকি ! সেই আলো পৃথিবীর শ্রেষ্ট আলো।
– তা’হলে এর উল্টোদিকে থাকে ঘৃণা, হিংসা, রিরংসা – এসব মানে অন্ধকার তো – বলো ?
– সত্যিই তাই – মমতা, প্রেম, ভালোবাসা যেমন আলোয় আলোময়, তেমনিই ঘৃণা, হিংসা, রিরংসা এসবই গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন !

একটি হৃদয় যখন আলোকিত হয় বিশুদ্ধ মমতায়, প্রেমে, ভালোবাসায়, তখন সেই আলো চন্দ্র সূর্যকেও ছাপিয়ে যায় । কারণ, চন্দ্র সূর্যের আলো শুধু বাইরেরটায় আলো দিতে পারে । আর মমতা দেয় অন্তরকে আলো ! সেই আলোকিত অন্তরের সাধনাতেই তো মানুষের সমস্ত জীবনই কেটে যায় ।

কেউ কেউ তার জন্যে সংসার ছেড়ে যায়, বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, বিবাগী বাউল হয়ে যায়, সেই মমতার অসীমতার সন্ধানে! আর কেউ সংসারের গন্ডীতেই নিভৃতে চর্চা করে চলে সেই মমতার আলোর সাধনা । তেমন মানুষের দেখা খুব কমই মিলে মানুষের জীবনে। আর সেই মানুষটির দেখা যখন কখনও নিজেদেরই সংসারের আঙিনায় মিলে যায় – তখন অভূত ভালোলাগায় মনটি ভরে যায় ।

বলছিলাম আসলে আমার বড় মামার ছেলেমেয়েদের কথা । ওরা এমনই ভালোবাসায়, মমতায় ঋদ্ধ ওদের বাবার মত । সারা পৃথিবীর এই বিপর্যয়ের সময়ে ওরা যে কতবার আমাদের খোঁজ নিচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই । ছোট বোনটি কতবার আমাকে ম্যাসেজ করছে, বাড়িতে ফোন করে মা’কে বলছে- আমি যেন কিছুতেই বের না হই। আমি ওর আতঙ্ক দেখে অবাক হই। কি পরিমাণ মমতা যে আমার এই ছোট বোনটি তার ওই ছোট্ট শরীরে ধারণ করে – তা’ আমার বোধেরও অতীত!

বড় মামার ছোট মেয়েটি, ঝুমা, ওর কথাই বলছি, একে প্রথম দেখেছি ছয়মাস বয়স মনে হয় তখন ওর। বড় মামা সবাইকে নিয়ে দেশে এসেছিলেন বেড়াতে । তারপরে কত কত বছর কেটে গেছে । ওদের বিয়ে হয়ে গেছে, সন্তানাদিও হয়ে গেছে। আমিও আর দেশে নেই । সম্ভবত: ২০০৭ এ একদিন সন্ধ্যায় পেলাম ঝুমার স্বামী পিনাকীর ই-মেইল – যে ওরা আসছে এই আমেরিকাতেই । খুশীতে মন ডগমগ হয়ে গেল আমাদের সবারই । ভাবলাম, এসে আমাদের কাছেই উঠবে ওরা। কিন্তু, ওরা জানাল, নিউজার্সিতে উঠবে ওরা । ওখানেই বাসার ব্যবস্থা হয়েছে, কারণ অফিসটা ওখানেই । ওরা এসেই ফোন করে জানাল, ওরা নিরাপদে পৌঁছেছে । এদিকে আমার আর তর সয় না! ওদের দেখতে যেতে হবে।

আমার মা’ বারেবারে বলেন, একটু সময় দে ওদের – ওরা একটু থিতু হোক ! আর আমার কথা হচ্ছে -থিতু হবার কি আছে – আমি যাব আর ওদের দেখে চলে আসব। একটু দেখে তো আসি। খোঁজ নিলাম পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশনে কিভাবে যাওয়া যায় । এক শনিবারের সকালে চড়ে বসলাম নিউজার্সির ট্রেনে একা । অনেক দৌড়ঝাঁপ করে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে ।

এতদিন পরে দেখা, ওরা আমার কথা শুনেছে শুধু, আমিও তো তাই ! গিয়ে পৌঁছানোর মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে গেল বোনটির একটা পরে একটা কিছু সামনে এনে দেয়া । দুপুরের খাবারের পরেও তাই । এই নাও দাদা – একটু পিঠা করেছি খাও। এই নাও দাদা একটু মুখে দিয়ে দেখোতো – কেমন হলো এই নুডলসটা ! সামনে এগিয়ে দিয়েই চুপটি করে সে তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে । কি যে অপরিসীম মায়া ওর মুখে । ওর সেই মায়াবৃত মুখের উপরে খাবো না বলাও মনে হয় পাপ হবে । ও’তো আর বুঝতে পারছে না, তার দাদা পেটুক বটে – কিন্তু অত খাবার সাধ্য তার নেই এখন আর – তারও যে ভাটির দিকে টান এখন !

ওর জামাই পিনাকী এক অসাধারণ মানুষ । অদ্ভূত শান্ত স্বভাবের, প্রায় নির্বিকার এক নির্বিরোধ মানুষ । আমার মত অমন রাগী, ছটফটে নয়। ওই একবেলাতেই আমাকে নিয়ে সে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিয়ে এলো। ভাগ্নে ভাগ্নিরাও ওদের বাবা মা’র মতোই। আমার সাথে বেশ জমে গেল ওদের ।

সেই থেকে সাত বছর ওরা ছিল এখানে। কতবার যে ওদের ওখানে গিয়েছি, ওরাও এসেছে আমাদের কাছে ! এই আত্মীয়হীন শহরে সবসময়েই মনে হতো কাছেই আমার একটি বোন আছে। এক দেড় ঘন্টার দূরত্বে মাত্র ।

তারপর একদিন ওরা জানাল, ওদের সময় হয়েছে ফিরে যাবার, আর আমার ভেতরে এক অস্থিরতা কাতরানো শুরু করেছে! বোনটাও চলে যাবে ! ওরা চলে যাবার আগেই বড় মামীও এলেন ওদের কাছে । অনেকদিনের পরে আমাদেরও আবার বড় মামীর সাথে দেখা হলো। মাও খুব খুশি বৌদির সঙ্গ পেয়ে। সেবারে মা পুরো একসপ্তাহ ওদের সাথে ছিলো । আর আমি শুধু মা’কে ক্ষেপাই – ‘মা- তোমার কি ভাগ্য। আমেরিকাতে এসেও বাপের বাড়ির নাইয়র খাচ্ছো !’

বোনটা ফিরে যাবার আগে একবার বেড়াতে এলো । আমাদের সবারই মন খারাপ, আমি নানাভাবে বুঝিয়ে ওদের এখানে থেকে যাবার কথা বলতে থাকি। কোন কাজ হয় না তাতে। ওরা চলেই গেলো আমেরিকা ছেড়ে । উঠল গিয়ে ব্যাংগালোরে । সেখানেও বোনটা দেখি কদিনেই গুছিয়ে নিয়েছে । আশপাশের সবার সাথে এক মধুর ভাবের পরিবেশ গড়ে তুলেছে । এইগুণটি একটি বিশেষ গুণ । যা সবার থাকে না। ওর মমতা দিয়ে সে আমাদের সবাইকেই জয় করেছে । সবসময়েই মনে হয়, আমাদের মহাভাগ্য যে এমন ভাই বোন আছে – যাদের বুকে মমতার এক সমুদ্র আছে।

নিউইয়র্কের এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের কালে ওদের কণ্ঠ শুনলেও মনে শক্তি পাই, যদিও জানি যার যা নিয়তি তা’ খণ্ডানো সম্ভব নয় । আবার কখন যে ওদের সাথে দেখা হবে, আদৌ হবে কিনা জানি না। তবু বোনদের, ভাইদের মমতার মধুতে প্লুত হয়ে থাকে মন। মনে মনে সবসময়েই প্রার্থনা করি – ওরা সবাই ভালো থাকুক, ওদের যা কামনা জীবনের – সবই পূর্ণ হোক । সেই সাথে সমস্ত পৃথিবীর সব মানুষেরা ভালো থাকুক, এই পৃথিবী গাঢ়তম এ অসুস্থতা কাটিয়ে আবারও মানুষের বাসযোগ্য হয়ে উঠুক!

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ” জীবন “- বরুন নাথের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধলক ডাউন -ডাঃ শ্যামল বৈদ্য’র ছোট গল্প

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে