অসুখ – সমরজিৎ সিংহের গল্প

0
289

অসুখ
সমরজিৎ সিংহ

‘বুঝলেন, বাঙালির বড় দোষ, বাঙালি ভাবে না।’ কথাটা কাকে বলা হল? কাকে? ট্রেনের কামরায়, এই মুহূর্তে, আমি একা। সামনে তিনি, দীর্ঘকায়, তবে ছিপছিপে নয়, মেদময় শরীর। শুকনো তামাক পাতা রং। মনে হয়, অনেক দিন স্নান করেননি। অকামানো মুখ।
সাহেবগঞ্জ নামার কথা। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে নামতে পারিনি। সাহেবগঞ্জ পেরিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। কাল রাতে ১০টা পর্যন্ত অর্থাৎ মিডিল বার্থে উঠে ঘুমোতে যাবার সময় অবধি, লক্ষ করেছি, কামরা ভর্তি লোক ছিল। আমার উলটোদিকে, জানলা ঘেঁষে, এক অসমদম্পত্তি, কলকল খলখল করছিল সারাপথ। আর কয়েকজন বিএসএফ ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। দম্পতির পাশে ত্রিশ-বত্রিশের এক তরুণী। এখন, কেউ নেই। বরং, সামনে বসে রয়েছেন তিনি। কাল তিনি ছিলেন না।
ডিসেম্বরের শেষ, ঠান্ডা পড়ে গেছে। সঙ্গে কুয়াশা। এসব ভেদ করে ভোরের ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। জানলার কাচ দিয়ে, দেখা যাচ্ছে, শীতে জবুথবু ধানখেত, ন্যাড়া, মাঝে মাঝে ঘরবাড়ি, কাঁচা রাস্তা। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে আশ্চর্য এক ফড়িঙের ডানার মতো রং পত পত করছে। সেইদিকেই তাকিয়ে রয়েছি আমি। রেলে বা বাসে চাপলে, আমার জানলা চাই। এইসব দেখতে দেখতে যাওয়ার আনন্দ আর কোথাও নেই। হ্যাং, এই আনন্দে নিঃসহায়তার বিষাদ স্পর্শও থাকে, যা অনুভব করতে হয়। লেগে থাকে গত জন্মের কোনো স্মৃতিও।
সাহেবগঞ্জে আমার এক আত্মীয় থাকেন, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরি। ঘুরতে ঘুরতে, সেখানেই সেটেল করেছেন তিনি। তাঁকে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম, দিল্লি থেকে ফেরার পথে দিনচারেক থাকব। আসল উদ্দেশ্য তাঁকে বলিনি।
আসল উদ্দেশ্য মানে? আমার কি কোনো উদ্দেশ্য আছে? অর্থহীন এক জীবনযাপন করতে করতে, এবং, থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। চাকরিও ভালো লাগছিল না আর। দিল্লি এসেছিলাম অফিসের কাজে। মামুলি কাজ। তবু অফিস পাঠাল আমাকেই। এমডি বললেন, ‘এবার আপনিই যান, চক্রবর্তী সাহেব।’
এমডি আমাকে চক্রবর্তী সাহেব বলে ডাকেন। চিটাগাঙের লোক, বয়স ষাটের কাছাকাছি। কেন যে আমাকে এভাবে সম্বোধন করেন, আমি জানি না। এটুকু শুধু বুঝি, একটা প্রশ্রয় রয়েছে এই ডাকে। হয়তো, অন্তর্গত কোনো স্নেহ। আমি তাঁর আদেশ উপেক্ষা করতে পারিনি। সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া, এই সুযোগে, ভাবলাম, খানিকটা বেড়িয়ে আসা যাবে। এই মনোটনাস লাইফ আর ভালো লাগছিল না আমার।
দিল্লিতে এসে মনে হল, না, আর নয়। যথেষ্ট হয়েছে। চাকরি-বাকরি করে, এভাবে নিজেকে নিঃশেষ করার কোনো মানে নেই। এই জীবন, মা মারা যাবার পর থেকে, অর্থহীন হয়ে পড়েছিল, টেনে, বয়ে, হ্যাঁচড়াতে, হ্যাঁচড়াতে বেড়াচ্ছিলাম এতদিন। এবার ক্ষান্তি দিতে হবে।
দিল্লি থেকেই আমার আত্মীয়কে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম। দিন-চারেক সাহেবগঞ্জে থাকব। বিরক্তিকর, একঘেয়ে জীবন। যদি এই একঘেয়েমি কাটে, যদি কেটে যায়! অসুবিধা নেই তো?
আত্মীয় খুব খুশি। তিনিও মেসেজ পাঠালেন, চলো এসো। সেই সাহেবগঞ্জ নামা হল না আমার। গুয়াহাটিগামী ট্রেন। সহযাত্রীদের বলে রেখেছিলাম, সাহেবগঞ্জ এলে ডেকে দেবেন। নামব।
এখন সহযাত্রীরা কেউ নেই। আমিই রয়ে গেছি, একা। আর, সামনে তিনি। গতরাত্রেও এই কামরায় ছিলেন না তিনি।
বললাম, ‘আমাকে বলছেন?’
মনে হল, ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন খানিকটা। কপালের ভাঁজ কুঁচকে গেল যেন। ওই ভাঁজে বিরক্তির ছায়া। ‘আরা কাকে বলব? ট্রেনের কামরাকে? হাওয়াকে? কাল রাত থেকে নাক ডাকছেন, জাগার নাম নেই। একা আর কাঁহাতক ভালো লাগে?’
ভদ্রলোকের অবস্থা টের পাই। ট্রেনে একা বসে থাকা বোরিং। নিজেকে অসহায় মনে হয়। এই অসহায়তা বোধ থেকে সহযাত্রীদের সঙ্গে যেচে আলাপ করে লোকে, কখনো-কখনো যাত্রাপথে সঙ্গী করে তোলে তাকে।
‘আপনি কোন স্টেশনে নামবেন?’ ভদ্রতাবোধ থেকে আমি তাঁকে জিগ্যেস করি।
‘রায়পুর।’
‘রায়পুর! মানে?’ ভদ্রলোক কী বলছেন? গুয়াহাটির পথে রায়পুর কোথায়? আলিপুরদুয়ার আছে, কোচবিহার আছে, কোকরাঝাড় আছে, রঙ্গিয়া আছে। রায়পুর সেখানে কোথায়? অবশ্য নর্থবেঙ্গল বা অসমের ভেতরে কোথাও রায়পুর বলে কোনো জায়গা থাকতেই পারে। ইটস্ পসিবল্। কিন্তু স্টেশন?
বুঝতে না পেরে পুনরায় জিগ্যেস করলাম, ‘রায়পুর?’
‘হ্যাঁ, রায়পুর। সেখানে তিন-চারদিন থাকব। তারপর ভাবছি, পশ্চিমে মহারাষ্ট্র বা গুজরাট কোথাও যাব। তারপর…’
আমি আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? ভদ্রলোকের মাথার ঠিক নেই? আমি তাঁর দিকে তাকালাম। না, পাগল নন। পাগলের চেহারা আরেকরকম থাকে। চোখের ভাষা থাকে আলাদা। তাঁর দুচোখের ভেতরে আশ্চর্য এক গভীরতা। মনে হয়, বহুকালের পুরনো কোনো দুই দিঘি। টলটল করছে তার কালো জল। জলের নীচে, তারও নীচে, ওমা, একটা সিঁড়ি নেমে গেছে পাতালের দিকে!
আমার হঠাৎ ভয় করতে লাগল। কেন, কিসের ভয়, জানি না। মনে হচ্ছে, সারা শরীর কাঁপছে। কাঁটা দিচ্ছে। আর সকল রোমরাজি একসঙ্গে গেয়ে উঠছে, আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে…।
তিনি এবার আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আপনি বুঝি পশ্চিমে যাচ্ছেন?’
পশ্চিমে? আমি যাচ্ছিলাম সাহেবগঞ্জ। পাটনা-মালদার মাঝখানে কোথাও এই স্টেশন। রাত দুটোয় ট্রেন এসে থামার কথা এই স্টেশনে। হয়তো থেমেছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সহযাত্রীরা সবাই নেমে গেছে। তবে ওই তরুণী, তাঁর তো যাবার কথা শিলিগুড়ি, কোথায় নামলেন?
বললাম, ‘ভেবেছিলাম সাহেবগঞ্জ যাব। নামতে পারিনি। ভাবছি, মালদা এলে নেমে পড়ব। সেখান থেকে যে কোনো একটা ব্যবস্থা করে সাহেবগঞ্জ চলে যাব। ট্রেন না পেলে বাস ধরব।’
‘মালদা? সাহেবগঞ্জ? আপনি এসব কী বলছেন ! এটা সেদিকে যাচ্ছে না। এই ট্রেন যাচ্ছে পশ্চিমে। আমরা চক্রধরপুর পেরিয়েছি, এই তো, কিছুক্ষণ আগে। আপনি যখন নেমে বসলেন, তখন।’
চক্রধরপুর ! ট্রেন যাচ্ছে পশ্চিমের দিকে! ভদ্রলোকের নির্ঘাৎ মাথা খারাপ। আমি পুনরায়, জানলা দিয়ে তাকালাম। ছোট ছোট টিলা, অবাক করা পাথর, রুক্ষ কাঁকুড়ে জমি কুয়াশা থেকে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। রোদ এসে পড়ছে পিঠের ওপর। মনে হচ্ছে প্রাচীনতম কোনো কচ্ছপ। হেঁটে যাচ্ছে অনন্তকালের দিকে। তার পিঠে জনপদ, আকাশ, রোদ, শূন্য চরাচর।
আমি নর্থ ইস্ট এক্সপ্রেসে চেপেছিলাম। ভোরে, খুব ভোরে। প্ল্যাটফর্ম উড়িয়ে হাওয়া বইছিল। সেই হাওয়ার ভেতর, কনকনে ঠান্ডার ভেতর, পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, এস ফোর বগি খুঁজে বের করেছি ছুটতে ছুটতে। ৬টা ৪০ মিনিটে ট্রেন ছেড়ে দিল। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। তার আগে, কয়েকটা খবরের কাকজ, জলের বোতল কিনেছি। ব্যাগ উপরের বাংকে রেখে, একটা পত্রিকা খুলে পড়তে শুরু করেছিলাম। আমেদাবাদ টেস্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে সৌরভকে। কোটলার শ্রীলঙ্কার জয়ের গৌরব ম্লান হয়ে গেল নির্বাচকদের এই অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তে। খেলা সম্পর্কিত সংবাদেই আমার আকর্ষণ বেশি। বাদবাকি সবই কেচ্ছা। রাজনীতির কেচ্ছা পড়তে আর ভালো লাগে না।
ভোরে দিল্লিতে, প্ল্যাটফর্মে, বাংলা পত্রিকা দেখে অবাক হয়ে পড়েছিলাম। এটা ঠিক, দিল্লিতে বাঙালিরা বেশ দাপিয়েই আছেন। মূলত গ্রেটার কৈলাসের দিকে। বাইরে এসে, বাংলাভাষার কাগজ দেখলে, মন আনচান করে। মনে হয়, চাঁদ পেলাম হাতে। না, ভুল বললাম। এ যেন দীর্ঘ তেষ্টার পর একগ্লাস ঠান্ডা জল। অমৃত, অমৃত।
আমার কেনা ইংরেজি পত্রিকা টেনে নিলেন বিপরীতে বসা দম্পতি। পত্রিকা দিতে গিয়ে, লক্ষ করলাম, পাশে এক বিষাদগ্রস্ত তরুণী। একা বসে আছে। পনিটেল। ব্ল্যাক জিনস। নীল-সাদা পুলওভার। আশ্চর্য সুন্দর এক বিষাদপ্রতিমা।
বেশিক্ষণ তাকাতে পারলাম না। শিষ্টাচারে বাঁধে। মহিলাদের দিকে এভাবে তাকানো যায় না। উচিত নয়। তা-ও পরিচিত হলে একটা কথা ছিল। ট্রেনের কামরায় কেউ আমার পরিচিত নয়। আমিও কারো পরিচিত নই। ফলে এই ভিড়ের মাঝে আমি একা।
বিষাদপ্রতিমা, কানপুরে এসে মুখ খুললেন। ‘আপনি বাঙালি। গৌহাটি যাচ্ছেন?’
মাথা নাড়লাম। গৌহাটি নয়, সাহেবগঞ্জ নামব, তবু কোনো কিছু না ভেবে, মাথা নাড়লাম।
‘হ্যাঁ।’
‘আমি শিলিগুড়ি। সেখানেই থাকি।’
কামরায়, এতক্ষণ দমবন্ধ করা অবস্থা ছিল আমার। দম্পতি যে ভাষায় কথা বলছিলেন, আমার বোধগম্য নয় তা। তিব্বতি-বার্মিজ কোনো গ্রুপের ভাষা হতে পারে। নাগা বা মিজোও হতে পারে। টুংটাং শব্দ হচ্ছে যেন। এর বেশি বোঝার উপায় নেই। বিএসএফ জওয়ানরা হিন্দিতে আদিরসাত্মক কথাবার্তা বলছিল। কেউ কেউ, মাঝে মাঝে গেয়ে উঠছিল ‘কালি কালি আঁখে…’। বুঝতে পারছিলাম, সবই ওই বিষাদ প্রতিমার উদ্দেশে। সে-ও, হয়েতা, এই কারণে, এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বাঁচতে, পরিত্রাণ পেতে, আমার সঙ্গে কথা বলছে। যেচে যেচে।
ত্রিশ-বত্রিশ। ছোটখাটো চেহারা। বিয়ে করেছে, নাকি এখনও অনূঢ়া। বোঝার উপায় নেই। দিল্লিতে কি আত্মীয়বাড়ি এসেছিল? নাকি, সে-ও আমার মতো? ভাবলাম জিগ্যেস করি। তারপর ভাবলাম, এটা বাড়াবাড়ি হবে। এটা উচিত নয়।
সন্ধে পর্যন্ত জমে উঠেছিল আলাপ। একসময়, নামও বলল। পরী। সেবক রোডে থাকে, এমইএস অফিসের কাছে। মাঝে, এলাহাবাদে ট্রেন থামলে, আমরা দুজন নেমে হাঁটলাম খানিকটা। পরী বলল, ‘আপনি দিল্লি প্রায়ই আসেন?’
‘না না। এ নিয়ে, ছ-সাত বার হল মোটে।’ কথাটা বললাম বটে, আসলে আরও দুবার এসেছিলাম। দুবার দিল্লির উদ্দেশে নয়। একবার, গঙ্গোত্রী যাবার পথে, আর একবার সিমলা যাবার পথে।
‘আমি এই প্রথম। একটা ইন্টারভিউ দিলাম। প্রোডাকশনে। জানি না, চাকরিটা হবে কি না।’ সামান্য থেকে, পুনরায়, পরী বলল, ‘বুঝলেন, চাকরিটা আমার খুব দরকার। তা না হলে, বাবা-মা, জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে আমার। আর আমি, আমি বিয়ে করতে চাই না।’
মনে হল, পরী নয়। একটা পাখি সে। খাঁচা থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করছে। আমার তখনই মনে পড়ে গেল, আমার বাড়ির মালিক কিছুদিন ময়না পুষেছিলেন। খুব যত্ন করতেন। পাকা কলা, ছোলা সেদ্ধ, লাল টকটকে লংকা – সব খাওয়াতেন নিজের হাতে। রোজ স্নান করাতেন। যখনই, সময় পেতেন, কথা বলাবার চেষ্টা করতেন। বলতেন, ময়না, হরেকৃষ্ণ কও।
ময়না কি আর কথা বলে? লক্ষ করতাম, একা খাঁচায়, বসে বসে, ঝিমিয়ে থাকত ময়না। মনে হয়, গতজন্মের কথা ভাবত সে। একদিন, সন্ধেবেলা, অফিস থেকে ফিরে এসে, দেখি ময়না, একা একা কাঁদছে অদ্ভুত এক শব্দ করে। তার দুচোখ বেয়ে, গড়িয়ে পড়ছে জল। জলের ফোঁটাগুলি আশ্চর্য সুন্দর। এক-একটা রুপোর দানা যেন।
চারদিকে তাকালাম সন্তর্পণে। কেউ নেই। চুপিচুপি, চোরের মতো, খাঁচার কাছে গেলাম। ময়নাটা তখনও কাঁদছে। ওই শব্দটা আমার বুকে এসে কোথাও যেন কুঁ-কুঁ-কুঁ। গোধূলির রং লেগে, ময়নাকে তখন মনে হচ্ছে, এই ধূসর জগতের সে কেউ নয়। সে আকাশের। হয়তো-বা অন্তরীক্ষের।
ফিসফিস করে বললাম, ‘কাঁদছ কেন?’
ময়নাটা নড়ে উঠল।
‘আবার আকাশে ফিরে যেতে চাইছ? অথবা সেই জঙ্গলে, গাছের ডালে? যাবে?’
আবার মুখ তুলে তাকাল সে।
‘খাঁচা খুলে দেব? উড়ে যাবে?’ কথা বলতে বলতে, সন্তর্পণে খাঁচার দরজা খুলে দি। অবাক হয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ময়না। কিছুক্ষণ। কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল। আবার, ফিরে এল কাছে। আমার চারদিকে এক চক্কর খেয়ে, উড়ে গেল আকাশের দিকে। লক্ষ করলাম, তার ডানায় সে মেখে নিচ্ছে লাল মেঘের গুঁড়ো।
পরী কি সেই ময়না? যে খাঁচা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে? বাবা-মা, সংসার, স্বামী-পুত্র নামের এক খাঁচা যেন জোর করে আটকে রাখতে চাইছে। শুধু কি তাকেই? আমরা প্রত্যেকেই কি কোনো খাঁচায় আটকে নেই? সে খাঁচার আরেক নাম। চাকরি, সংসার, প্রতিষ্ঠান, আশ্রম – আরও কত নাম। মা মারা যাবার পর আমিও ভেবেছিলাম, এবার মুক্তি। যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাব। বমডিলা অথবা লাদাখ।
তবু, যেতে পারলাম কোথায়? একা থাকি, তবু বেঁচে থাকার এক অন্ধ মোহপাশ বেঁধে রেখেছে, যা থেকে রেহাই নেই, এবার, দিল্লি এসে, মনে হল, যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়।
তবু কেন সাহেবগঞ্জের আত্মীয়কে ফোন করলাম? কেন?
আমি তো চলে যেতে পারতাম মানস সরোবর বা অন্যত্র। যেদিকে মন চায়। গেলাম না কেন? তাহলে কি এখনও খাঁচায় আটকে থাকতে চাইছি? সেই ময়নাটার মতো উড়ে যেতে পারলাম না কে?
রাতে শুতে যাবার আগে, পরীকে বললাম, ‘সাহেবগঞ্জ এলে ডেকে দেবেন। দেবেন তো?’
‘ও শিওর। ট্রেনে আমার ঘুম আসে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’ বলে পরী হালকা নীল রঙের একটা কম্বল টেনে নিল গায়ের ওপর।
ভোরে, যখন ঘুম ভাঙল, ট্রেনের কামরায় কেউ নেই। না, পরীও নেই। নীচে জানলার কাছে, বসে রয়েছেন তিনি। সাহেবগঞ্জ ট্রেন থামার কথা রাত দুটোয়। এখন ভোর পাঁচটা। তার মানে সাহেবগঞ্জ পেরিয়ে এসেছি। তারা সব গেল কোথায়? পরী তো শিলিগুড়ি যাবে বলেছিল। তাহলে?
সেলফোনে পরীকে ধরার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। নেটওয়ার্ক নেই।
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। আসলে ট্রেনটা কোথায় যাচ্ছে? গুয়াহাটি যাচ্ছে না? সত্যি? পশ্চিমে, মানে বোম্বে যাচ্ছে। আমি তাহলে কী করে এলাম? গালে চিমটি কাটলাম। উফ্। ব্যথা লাগছে। তার মানে, আমি জেগে আছি। তাহলে?
তিনি গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। এই কামরায় আর কেউ নেই, জিগ্যেস করব, এই ট্রেন কোথায় যাচ্ছে। গুয়াহাটি না বোম্বে?
জানলার দিকে মুখ সরিয়ে, তিনি বললেন, ‘বাঙালির বড় দোষ, বুঝলেন, বাঙালি ভাবে না। হুজুগে মাতে। এই ধরুন, সৌরভ টিম থেকে বাদ গেল, অমনি হুজুগে মেতে উঠল সবাই। বুদ্ধদেববাবু বললেন, পশ্চিমবঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে শিল্পপতিরা লগ্নি করবেন। ব্যস, মেতে উঠল সবাই।’
চুপ করে শুনতে থাকি। বুঝতে পারছি, এসব কথা আমাকে উদ্দেশ করে বলছেন বটে, তবে আমাকে নয়। এ যেন নিজেকেই বলে যাচ্ছেন। এরকম মানুষ অনেক দেখেছি। কথা বলে, হালকা হতে চায়, হালকা হয়। ভার মোচন করে।
‘আরে, কেউ ভেবে দেখল না, ওই মেতে ওঠা লজিক্যাল নয়। দেখুন না, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত ক্যাপ্টেন হয়ে পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। সেই যেবার শচীনের অভিষেক হল। দল দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছিল সেবার। ড্র করেছিল সিরিজ। পাকিস্তানের মাটিতে এর আগে জেতা দূরে থাক, কোনো দলই সিরিজ ড্র করতে পারেনি। আর নেক্সট সিরিজে শ্রীকান্ত বাদ, ক্যাপ্টেনসি থেকে। তামিলরা কি মেতে উঠেছিল হুজুগে? না, মাতেনি।’
আমি এরপর তাঁর মুখের দিকে তাকাই। তিনি কে? কেন এসব কথা বলছেন? আমি তো ট্রেনের কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, সাহেবগঞ্জ যাবার কথা। মালদা যদি না যায়, তাহলে আমি কী করে সাহেবগঞ্জ যাব! ভাবছিলাম, পরীর কথা। মেয়েটা শিলিগুড়ি যাবে বেল, মাঝপথে, কোথায় যে নেম গেল! খোঁজ নেব, তারও যো নেই। নেটওয়ার্ক কাজ করছে না।
‘আচ্ছা, আপনিই বলুন।’ তিনি যেন, এবার নড়েচড়ে বসলেন। ‘যে ইন্দোনেশিয়া ঋণভারে জর্জরিত, ৮৫ শতাংশের উপর ঋণ যার মাথায়, সেখান থেকে কেউ পশ্চিমবঙ্গে এসে লগ্নি করবে ভাবা যায়? নিজের দেশে করল না কেন?’
হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছি তাঁর দিকে। চোখের গভীরে দিঘি। টলমল করছে জল। জলের নীচে, আরও নীচে, একটা সিঁড়ি নেমে গেছে পাতালের দিকে। পাতাল কি ওই সিঁড়ি বেয়ে নীচে? কী আছে সেখানে? তাঁকে মনে হল, এ জগতের কেউ নয়। চোখে দিঘি বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
‘এজন্য, বুঝলেন, বলছিলাম, বাঙালি আজকাল ভাবে না। ভাবতে পারে না।’
তাঁর কোনো কথাই কানে ঢুকছে না আমার। পাতালের সিঁড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে, মনে পড়ে গেল, মালদা না গেলেও আমাকে নামতে হবে। কিন্তু কোন স্টেশনে নামব? এই ট্রেন কোনদিকে যাচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে, আর কোনোদিকে না তাকিয়ে, পাশের কামরার দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে নিশ্চয় কেউ না কেউ থাকবে। তাদের কাছে জেনে নেওয়া যাবে তথ্য। ও মা! পাশের কামরাতেও কেউ নেই। খালি, ফাঁকা এক কামরা। মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত। অদ্ভুত, গা গুলিয়ে যাওয়া এক পুরনো গন্ধ উঠে আসছে এই কামরা থেকে।
আমার ভয় করতে লাগল। এবং শীত। প্রচণ্ড শীত। না, ডিসেম্বরের শেষের শীত নয়। দিল্লির প্ল্যাটফর্ম কাঁপানো শীত নয়। এ যেন প্রাণকূট থেকে উঠে আসা এক আদিম শীত। সৃষ্টিরও আগে হয়তো, এই শীত ছিল, যার কোনো তল নেই, দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই। আমি তড়িঘড়ি করে পাশের কামরায় গেলাম। এই কামরাতেই কোনো লোক নেই। একটা নেড়ি কুকুর শুয়ে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। আমার শব্দে জেগে উঠল কুকুরটা, এবং কুঁই কুঁই করতে লাগল আমায় দেখে। তাহলে কি এই ট্রেনে কোনো লোক নেই? আমিই একা যাচ্ছি? আর তিনি? তাঁর চোখে পাতালের সিঁড়ি কেন? তিনি কে? এই ট্রেনে লোক নেই কেন? কোথায় গেল সবাই? কাল রাতেও তো সবাই ছিল। দিল্লিতে, ট্রেনে ওঠার জন্য তো সবাই ধাক্কাধাক্কি করেছে। আমিও বহু কষ্টে উঠেছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, ভিড়ের চাপে পড়ে যাচ্ছিলাম আমি। একজন বিএসএফ জওয়ান টেনে তুলল আমাকে। বলল, ‘সম্ভালকে।’
তারা গেল কোথায়? সবাই কি নেমে গেছে? কখন নেমে গেল? আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারা কোথায় নামল। সাহেবগঞ্জ? না, তারও আগে, কোথাও?
আমি, এরপর, টলতে টলতে, পরবর্তী কামরার দিকে পা বাড়ালাম। সিটি বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। এই কামরায় পা দিয়ে দেখলাম, চারটে চ্যাংড়া ছেলে গামছা পেতে তাস খেলছে। প্রত্যেকের মুখে একটা করে সাদা করবী। যেন গাঁজার কলকে মুখে নিয়ে টানছে, হাতে না ধরেই। আমাকে কেউ লক্ষ করছে না। আমার দিকে তাকাচ্ছে না তারা।
তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আস্তে আস্তে। তবু তো, এই কামরায় লোক আছে। ছেলেগুলি রামি খেলছে। তাদের হাতের তাসগুলি অদ্ভুত। সাহেব বিবি গোলাম নয়, তাদের কঙ্কাল ছবিতে। হরতন, চিড়তন নয়। এ কেমন ধরনের তাস? নাভি, ঠোঁট, স্তন, যোনি। একটা ছেলে বারোটা কার্ড মিলিয়ে বসে আছে। একটা কার্ড জুৎসই পাচ্ছে না অনেকক্ষণ। নাভির তিরি বা পাঞ্জা হলেই মেট।
আমি শ্বাসরুদ্ধ, অপলক। কোনোরকমে শ্বাস টেনে নিলাম বুক ভরে। বললাম, ‘আচ্ছা, বলতে পারেন, এই ট্রেনটা কোথায় যাচ্ছে?’
হাতের তাস রেখে চারটি ছেলেই আমার দিকে তাকাল। আঁতকে উঠলাম আমি। তাদের কারো চোখ নেই। সেখানে সাপের হাঁ, লকলক করছে জিভ। টের পাচ্ছি, আমার মাথা ঘুরছে, পড়ে যাচ্ছি আমি। পড়ে যেতে যেতে, দূর পাতাল থেকে, যেন শুনতে পেলাম, চারটি ছেলেই, একসঙ্গে বলল, বলে উঠল, ‘দক্ষিণে, দক্ষিণে যাচ্ছে এই ট্রেন।’

সমরজিৎ সিংহের গল্প এই গল্পটি পড়ে বাসব রায় লিখেছিলেন তার অনুভুতি

বছর পাঁচেক আগে এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলাম লামডিং। ছিলাম বনবাংলোতে। তো, তখন, উত্তর-পূর্বের নির্বাচিত বাংলা সংকলনের কাজ চলছিল। সঙ্গে ছিল বেশ কয়েকটা বই। কেননা গল্প বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজটা ছিল আমার দায়িত্বে। বিভিন্ন লেখকের বেশ কয়েকটা গল্প পড়তে পড়তে রাত হল। এরপর পড়তে শুরু করলাম ‘রাত্রিমথ’ গল্প সংকলন। এবং আমি আটকে গেলাম একটা গল্পে। টানা দুবার পড়লাম… আস্তে আস্তে অদ্ভুত এক বোধ আমায় ঘিরে ধরল, ঠিক জীবনানন্দের সেই বিপন্ন বিস্ময়ের মতো। মাথার ভেতর এক বোধ জন্ম লয়। তো, তখন রাত পৌনে চারটে, হালকা শীত পড়েছে, পাহাড়ের পদতলে লামডিঙে। আমি কল করলাম, লেখককে। তিনি ঘুম-গলায় ফোন ধরে বললেন… ‘কে? এত রাতে… মানে এত সকালে, আপনি কে?’ এরপর প্রায় অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি! আমার গল্প পড়ে ফোন করলেন! এখন! আপনি! আমার গল্প পড়ে ফোন করলেন! এখন! আমি কী বলব! এরকম আমার জীবনে কখনো ঘটেনি!’

সেই গল্পটি আজ পোস্ট করছি। আড়াই হাজার শব্দের গল্প। আশা করছি, আমার ফেসবুক-বন্ধুরা পড়বেন। আর বলবেন, কীভাবে সময়কে ব্যবহার করা হয়েছে গল্পের একটি চরিত্র হিসেবে, অথচ একবারও তার উল্লেখ নেই। বলবেন, কীভাবে অন্য পৃথিবী মানে পোস্ট-ট্রুথ জগতের কথা বলা হয়েছে। কীভাবে ভাঙা হয়েছে ন্যারেটিভ ফর্মকে। আর সর্বোপরি গল্পের ফর্ম কেমন যেন অন্যরকম। এই গল্প গল্পহীনতার গল্প। কী লিখছেন যেখানে মুখ্য নয়, কীভাবে লিখছেন… যা এই সময়ের গদ্যের মূল কথা, সেটাই বলার। ওঃ হ্যাঁ, গল্পকারের নাম সমরজিৎ সিংহ।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধচামারী ইউনিয়নে উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই-সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদৎ
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে সাংবাদিক নাঈমুরকে হত্যার হুমকি, জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জিডি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে