আমার দু’টি কথা – জি এম ইকবাল হাসান (প্রয়াত সাংবাদিক)

0
282
GM, ইকবাল, হাসান

আমার দু’টি কথা – জি এম ইকবাল হাসান (প্রয়াত সাংবাদিক)

আমার ওস্তাদের কথার সুত্র ধরে দু’টো কথা বলি। কথায় আছে- কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়। তাই বলে কি কুকুরের পায়ে কামড় দেয়া মানুষকে মানায়? আমার ওস্তাদ বলেন, আমি কুকুরের পায়ে কামড় দিতে যাব কোন দুঃখে? কুকুরকে মুগুর মেরে করব সোজা। ওস্তাদের আরেকটি কথা, তোমার ঢোল যদি কেউ বাজায়। নির্দ্বিধায় তুমি কাঁধে তুলে নিয়ে নিজেই বাজাও। মানুষ ঢোলের তাল শুনবে। কে বাজাল, তা দেখতে আসবে না। ওস্তাদের কথামত আজ নিজের ঢোল নিজেই বাজিয়ে বন্ধুদের তার তাল শোনাতে চাই। তাতে আর কিছু নয়, বুকের ভেতর আটকে থাকা বাতাসটা বেরিয়ে আসবে। এতে বুকটা হবে হালকা। শ্বাস নিতে সুবিধা হবে।

সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্কুল জীবন থেকে। তখন ছড়া-কবিতা লিখে পাঠাতাম। সবগুলো ছাপা হতো না। তবে তাতে ক্লান্তি ছিল না। ফের লিখে পাঠাতাম। এভাবে সংবাদপত্রের সঙ্গে একসময় গড়ে ওঠে আত্মার সম্পর্ক। কলেজে পড়ার সময় ছুটির দিনগুলো কেটেছে সংবাদপত্রপাড়ায় ঢুঁ মেরে। ঢুঁ মারতে মারতেই একদিন হয়ে গেলাম রিপোর্টার। ঢাকায় হাতেখড়ি নেয়ার পর অনিবার্য কারণে চলে যেতে হয় নাটোরে। নাটোর থেকে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছি অন্তত ২৫ বছর। খবরের কাগজে খবর লিখে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছি। তবে পরবর্তীতে সেসব কথা কেউ আর মনে রাখেনি। আমার নির্যাতনের কোন মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি আমি যে গণমাধ্যমে চাকরি করি, তারাও মূল্যায়ন করেনি।

২০০৪ সালের ঘটনা। দিনটি ছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। বন্ধুদের নিশ্চই বহুল আলোচিত বাংলাভাইয়ের কথা মনে আছে। বাংলাভাই তথা জেএমবির গডফাদার হিসাবে সে সময় বিশেষ পরিচিত বিএনপি নেতা চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সাব্বির আহমেদ গামাকে ৭ ফেব্রুয়ারি হত্যা করে সশস্ত্র চরমপন্থী দলের সদস্যরা। ঘটনাটি ঘটে দুলুর বাড়ি নাটোরে নলডাঙা থানার রামশারকাজীপুর গ্রামের কামারপাড়ায়। ঘটনাস্থল উপমন্ত্রীর বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচশ’ গজ দূরে। ভাতিজা নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই রাতেই দুলুর নির্দেশে রামশারকাজীপুর ও পার্শ্ববর্তী শাহপাড়ার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে ছাই করা হয়। ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি তিনদিনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ৪৮টি বাড়িঘর-দোকান গান পাউডার ছিটিয়ে আগুনে ছাই করা হয়। এলাকাটি পরিণত হয় সন্ত্রাসের জনপদে। প্রাণ বাঁচাতে বাড়িঘর স্ত্রী ছেলেমেয়ে পরিবার-পরিজন ফেলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়।

তা-বের তিনদিনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পুকুরের মাছ, বাগানের ফল, মাঠের ধান-ফসল সবই করা হয় লুট। এসব খবর ‘লিড আইটেম’ হিসাবে ১০ ফেব্রুয়ারি আমার পত্রিকায় ছাপা হওয়ায় দুলুর রোষানলে পড়তে হয় আমাকে। দুলুর নির্দেশে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সশস্ত্র ক্যাডাররা চড়াও হয় আমার বাসস্থানে। তারা টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে আমাকে। পাশের জনসাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের ঘেরাও চত্বরের মধ্যে ঢুকিয়ে আমাকে বেধড়ক মারপিট ও রক্তাক্ত জখম করে ফেলে রেখে যায়। আমাকে তারা হাসপাতালে ভর্তি হতে দেয়নি। কোন ডাক্তার আমার বাসস্থানে আসতে দেয়নি। ফোনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আমাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। পরদিন ১১ ফেব্রুয়ারি দেশের প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে আমাকে আহত করার ঘটনা ফলাও করে ছাপা হয়। দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিক সংগঠনগুলো কঠোর ভাষায় ঘটনার নিন্দা জানায়।

বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমে এ খবর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। এ ঘটনায় আমি মামলাও করেছিলাম। কিন্তু দুলুর নির্দেশে চুড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে পুলিশ মামলাটি খেয়ে ফেলে। সন্ত্রাস ও তা-বের জনপদ রামশারকাজীপুর ও শাহপাড়ার ধ্বংসলীলা দেখতে আসেন সে সময়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। তাঁরা আমার বাসস্থানেও আসেন আমাকে দেখতে। তাঁদের আশ্বাস আমাকে উজ্জীবিত করে। তাঁরা বলেছিলেন, সত্য ও ন্যায়ের পথে আঘাত আসবেই। এতে বিচলিত হবার কিছু নেই। তাঁরা আরও বলেছিলেন, কোন ত্যাগই বৃথা যায় না। তাঁদের সেই কথা পরবর্তীতে সত্যে পরিণত হয়। নির্বাচনে ভরাডুবি হয় বিএনপির নেতৃত্বাধিন জোটের।

আমি দরিদ্র সাংবাদিক। সাংবাদিকের চাকরি করে যা পাই, তা দিয়ে কোনরকমে খেয়ে পরে বেঁচে-বর্তে আছি। বিএনপি ক্যাডারদের নির্যাতনের শিকার হয়ে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা করাতে না পেরে তার জের আজও আমাকে টানতে হচ্ছে। আমার কোমর থেকে পা পর্যন্ত এখন আর সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। খুবই কষ্ট করে আমাকে চলাফেরা করতে হয়। পাশাপাশি আমি জটিল প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগে ভুগেছি অন্তত কুড়ি বছর। পিত্তথলিতে পাথর বয়ে বেড়িয়েছি অন্তত দশ বছর। ২০১০ সালে জীবন রক্ষার তাগিদে মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে দু’টো অপারেশন করাতে বাধ্য হয়েছি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এ বছর হলো হার্ট এ্যাটাক। সেদিন ভাগ্যক্রমে ঢাকায় ছিলাম বলে দ্রুত চিকিৎসা পেয়ে বেঁচে গেলাম।

ইব্রাহীম কার্ডিয়াক সেন্টারে ভর্তি হয়ে জানলাম, আমার ডায়াবেটিস তুঙ্গে। এখন আমার যে অবস্থা, তাতে চিকিৎসা নিতে ঘুরেফিরে ঢাকায় যেতে হচ্ছে। ঢাকা-নাটোর করতে করতে আমার তো ফতুর হবার জোগাড়। এ জন্য ঢাকায় যদি একটা চাকরি পেতাম, তাহলে এ যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার পেতাম। দু’এক জায়গায় যে এ জন্য বলিনি, তা নয়। তবে তেমন করে সাড়া পাইনি। বন্ধুদের যদি তেমন জায়গার খোঁজ থাকে। আওয়াজ দিলে আমি বর্তে যাই।

বি: দ্র: ২০১৪ সালের ৭ আগোস্ট প্রয়াত নাটোরের সিনিয়র সাংবাদিক দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার নাটোর প্রতিনিধি সবার শ্রদ্ধাভাজন জি এম ইকবাল হাসান তার ফেসবুক পোস্টে এই লেখাটি লিখেছিলেন। সমস্ত জীবন দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে যাওয়া এই মনিুষটির সাথে আমাদের অনেক স্মৃতি, অনেক ভালোবাসার অভিব্যাক্তি, অনেক উপদেশ বানী যা আজো চলার পাথেয়, কাকু আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আপনাকে জান্নাতবাসী করেন। নাটোরকন্ঠ পরিবার তার আত্মার শান্তি কামনা করছে।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরের নলডাঙ্গায় বন্যার্তদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ এমপি শিমুলের
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের সিংড়ায় হাত পা বেঁধে আড়াই লক্ষ টাকা লুট

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে